ভার্চুয়াল সমাজ


প্রকাশিত: ০১:৫৩ এএম, ২৫ এপ্রিল ২০১৬

সমাজে বসবাস করার কিছু সাধারণ শিষ্টাচার আছে, সোজা কথায় ভদ্রলোক হতে হয়। আগের দিনে, এখনও বেকায়দার কাজ-কাম করলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সমাজচ্যুত করার নিয়ম আছে। সমাজ সম্পর্কে মানুষের ধারণা পাল্টায়। আগে গ্রামের চারপাশ কিংবা মহল্লার কয়েক গলিতে সমাজ হতো, এখন ফ্ল্যাট বাড়ি নিয়ে সমাজ। আবার কোথাওবা পাশের বাড়িকে বাদ দিয়েই গড়ে উঠেছে এক ভিন্ন সমাজ। পার্টি, ক্লাব, সোসাইটি, সিভিলিয়ান, ডিপ্লোমেট কতো রকম সমাজ। এদের নানা চরিত্র, নানা রঙ-রূপ। আর নতুন সমাজ হলো ফেসবুক সমাজ। এই একবিংশ শতাব্দী আমাদের শেখালো কম্পিউটার, মোবাইল, সফটওয়্যার, এ্যাপের সুবাদেও সমাজ গড়া যায়। ভার্চুয়াল এই সমাজে অনেক সময় কিন্তু রিয়েল মানুষও থাকে না।

‘উঁচু পাহাড়’, ‘একলা পথিক’, ‘প্রিন্সেস রাইদা’, ‘প্রিন্স রতন’, ‘জেনারেশ জিরো’, ‘আমি একা’, ‘পরের জন্ম’, ‘নটআউট’, ‘গুটিবাজ’, ‘প্লেবয়’ - এমনি সব নাম পাওয়া যায় ফেসবুকে। এইসব নামের আড়ালে কোনো মানুষ আছে তা জানা বড় কঠিন। আবার আজাদ, অঞ্জন, রাব্বি, সাঈদ, দিপ্তী- এমন প্রচলিত নামও পাওয়া যায় কম না। এদের অনেকের প্রোফাইল পিকচার বা কাভার ফটোতে দেখি আকাশ, মেঘ, পাখি, কঙ্কাল, হার্ট চিহ্নসহ নানা কিসিমের ছবি। এই লোকগুলোও আসলে কারা, কি করে ঘাটাঘাটি করে বোঝা যায় না। কাজেই ভার্চুয়াল এই ‘মুখবই’তে সব সময় সব মানুষকে পাওয়া যায় না। মানুষ এমনিতেই জটিল ও বিচিত্র প্রাণী। বহু বছর এক সাথে বসবাস করেও মানুষ মানুষকে আবিষ্কার করতে পারে না। চিনতে পারে না। সেই বিবেচনায় ফেইবুক নামের একটি নেটওয়ার্কে চিনে ফেলাটা আসলেই বড় দূরূহ।

তবু এরমাঝেই যখন দেখি ফেসবুকের পরিচয়ে প্রেম, বিবাহ হয়ে যাচ্ছে অবাকই হই। শুধু প্রেম বিয়ে নয়, আরও অনেক কিছুই ঘটে যাচ্ছে চারপাশে ফেসবুকের পরিচয় সূত্র ধরে। হতে পারে, নতুন যুগের নতুন যোগাযোগ মাধ্যম নতুন জেনারেশনকে অনেক কিছুই দিয়েছে। কিন্তু ওই যে শুরুতে বললাম, ধরনটা যেমনই হোক, ফেসবুককেও একটা সমাজ মানা যেতে পারে। আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানীরাও তাতে একমত।

যদি ফেসবুক, তারসাথে টুইটার, ভাইবার, হোয়াটসএ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম ইত্যকার এপ্লিকেশনগুলোকে সমাজ ধরে নেয়া যায় তবে সামাজিক রীতিনীতিও তো মানা যেতে পারে। সমাজে যেমন শস্তা জনপ্রিয়তা, অর্থ উপার্জন কিংবা নানা ফায়দার লোভে যে কোনো কাজ গ্রহণযোগ্য নয় ভার্চুয়াল সমাজেও তাই হওয়া উচিত নয় কি?

জনৈক নারী নানা রকম খোলামেলা ছবি দিয়ে লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার পেয়ে গেলেন, তারপর তিনি সেলিব্রেটি, সিনেমার আইটেম গার্ল হয়ে গেলেন। তার দেখাদেখি প্রতিযোগিতায় নামলেন বাংলাদেশের আরও দুচারজন। তারা বললেন, ‘অমুকে ক্ষেত, আমি তার চেয়ে অনেক স্মার্ট, আমার বয়স কম, ফিগার ভালো’ ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্নটা হলো এই সব ছবি আর ছবির সুন্দরীদের ফলো করছেন অনেক শিশুরাও। সংজ্ঞায়নের বিবেচনায় আঠারো অনূর্ধরা কিন্তু এখনও শিশু। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশে ভার্চুয়াল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুকের ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু শিশু তালিকায় পড়েন। কাজেই আমরা যারা প্রাপ্তবয়স্ক (বয়স অথবা বিবেচনার হিসাবে) তাদের কিন্তু দায়িত্ব পড়ে ফেসবুকে কী শেয়ার হচ্ছে, কেন শেয়ার হচ্ছে সেটা বিবেচনা করা। আমি বহু আধুনিক বাবা-মাকেই দেখেছি, চিনি, যারা প্যারেন্টাল গাইডেন্স ব্যাপারটা অন্তত অনলাইনের ক্ষেত্রে জানেনই না।

প্রায়শই ফেইসবুকে দেখি ধর্মীয় পোস্ট। একটা পোস্ট বহুবার দেখেছি। সেটি হচ্ছে আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (সা:)-এর পায়ের ছাপ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখা থাকে, এটা নবীজির পায়ের ছাপ, কেউ এড়িয়ে যাবেন না, এতোবার শেয়ার করলে এতো লক্ষ সোয়াব। এমন ধর্মীয় ফতোয়া দেয়ার অর্থটা বুঝি না। লক্ষ করার বিষয় হলো, নবীজির পায়ের ছাপের একাধিক পোস্ট দেখা যায় যার কোনোটার সাথে কোনোটার মিল নেই। স্থান, পায়ের ছাপের আকার, মাধ্যম (কোনটা হয়তো পাথরে, কোনটা মাটির উপর) কোনকিছুতেই মিল পাওয়া যায় না। যে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা এইসব ছড়ান তারা হয়তো জানেন না, এতে করে ধর্ম সম্পর্কেই মানুষের একটা বিরাগ ভাব আসতে পারে। যে কোনো ধর্ম সম্পর্কেই না-জেনে, অতি উৎসাহে কোনো কিছু প্রচার করা ঠিক নয়। ধর্ম বরাবরই সেনসেটিভ বিষয়, সেটা নিয়ে ফেসবুকে যা-ই লেখা হোক মনে রাখতে হবে, এটা যেন বুমেরাং না হয়ে যায়।

তনু হত্যার মতো সামাজিক অনাচারগুলো নিয়ে আমরা যখন সোচ্চার হই তখন কিছুটা হলেও আমাদের মানবিকবোধ জাগ্রত হয়। কিন্তু এ সব ক্ষেত্রেও আমরা কতোটা বুঝে কথা বলি। পরিবারে কিংবা সমাজে যেমন ভেবেচিন্তে কথা বলা উচিত ফেসবুকেও তাই। তনু হত্যার ইস্যুতে দেখা গেলো ভিয়েতনাম বা অন্যকোনো নির্যাতিত একটি মেয়ের ছবি দিয়ে দেয়া হলো। এই ছবিটা তো অন্যের উপরে ভিন্ন অভিঘাত সৃষ্টি করে। অনেকেই সেনাবাহিনীকে ধুঁয়ে ফেললেন এই বিষয় নিয়ে। কিছু প্রমাণ হওয়ার আগেই একটি পুরো কাঠামো নিয়ে সমালোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকাও ‘মুখবই’ সমাজে উঠে এলো জোরে-শোরে। বিচিত্র সব বিশেষজ্ঞ রাখলেন নানান মতামত। মতামত দেয়া একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু আপনার থিউরি যদি উদ্ভট তাতে যে শুধু আপনি হাস্যকর প্রমাণিত হন তা নয়, বরং আপনি পুরো ইস্যুটাকেও হাল্কা করে ফেলেন। রসবোধ থাকা ভালো কিন্তু সব বিষয় নিয়ে রসিকতা ভালো নয়।

কথাবার্তা পোস্ট করার সময় মনে রাখা দরকার আমি ফেসবুকে হাজার হাজার লোকের সঙ্গে সংযুক্ত। হাজার হাজার কখনোবা লক্ষ লক্ষ লোক নিয়ে আমাদের ফেসবুক সংসার। এই সংসার বা সমাজে আমরা যদি দায়িত্বশীল হয়ে কথা না-বলি ক্ষতিটা ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক বা রাষ্ট্রিক পর্যায়েরও হতে পারে। আগে বাসের গায়ে ছিলো, এখনও কোন কোনটায় লেখা থাকে, ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়।’ একটু রূপান্তর করে বলা যায়, ‘মুখবই’য়ে আপনার ব্যবহার আপনার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ইমেজকেও তুলে ধরে।

আপনি মদ খাচ্ছেন, নাকি আজ বাসর রাত উদযাপন করছেন সেটা মুখবইতে লিপিবদ্ধ করা কতোটা সমীচীন তা ভেবে দেখতে পারেন। আপনার স্বাধীনতা কিন্তু আমার নাকের ডগা পর্যন্ত। নইলে আপনাকে সমাজচ্যুত করে ফেলা খুব কঠিন নয়। আনফ্রেন্ড বা ব্লক করতে তেমন পরিশ্রম করতে হয় না। আমি অন্তত বহু লোককেই চিনি, যাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ‘মুখবই’তে আছি। দুঃখজনক হলেও সত্য তাদের একজনকে একবার সাম্প্রদায়িক মন্তব্যের জন্য ব্লক করেছি, একজনকে ব্লক করেছি যৌন উস্কানিমূলক কার্যকলাপের জন্য, আরেকজনকে...। মোদ্দা কথা, মুখবই থেকে তাকেই সমাজ বা সংসার চ্যুত করা উচিত যে সমাজ বা সংসারের জন্য হানিকর। ভার্চুয়াল সমাজ বলেই সেখানে আমরা আপোসহীন, ক্ষমাহীন থাকবো তা তো হতে পারে না।

লেখক : চলচ্চিত্র গবেষক, লেখক, প্রকাশক

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।