আমলগুলো যেন বিফলে না যায়

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৮:৫৪ এএম, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

আলহামদুলিল্লাহ! সুস্থতার সাথে মাহে রমজানের রোজাগুলো রাখতে পেরে আল্লাহপাকের দরবারে হাজারো শুকরিয়া।

আমরা যারা রমজানের সবগুলো রোজা কেবল মাত্র আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির খাতিরে রেখেছি তারা অবশ্যই বড় সৌভাগ্যবান। এখন রমজানের বিভিন্ন সৎকর্মগুলো বছর ব্যাপী জীবিত রাখতে হবে। আমরা যদি বছরের প্রতিটি দিন আল্লাহপাকের আদেশ-নিষেধ মেনে চলে জীবন অতিবাহিত করি তাহলে অবশ্যই আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন।

আমরা কেউ জানি না, আগামী রমজান লাভ করার সৌভাগ্য আমাদের হবে কি না। রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা তাকওয়া, অন্তরের পরহেজগারি, হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা এবং আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি যাবতীয় গুণাহসমূহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে আর আল্লাহ ও রাসুলের শিক্ষা মতাবেক জীবন পরিচালিত করতে।

কিন্তু রমজানের রোজার দিনগুলো শেষ হতে না হতেই আমরা দেখতে পাই আমাদের স্বভাব-চরিত্র পূর্বের ন্যায় হয়ে যায়। রোজার দিনগুলোতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বাজামাত আদায় করার প্রতি যেমন আকর্ষণ ছিল রমজান শেষ হতে না হতেই নামাজের প্রতি কেমন যেন উদাসীন হয়ে যাচ্ছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকভাবে আদায় করার প্রতি দেখা দিচ্ছে আলস্য, কথা বলার ক্ষেত্রেও আবার মিথ্যা বলা শুরু করে দিয়েছি, নানান খারাপ কাজে আবার যোগ দিয়েছি।
এক কথায় বলা যায় রমজান শেষ হতেই সব ধরনের অপকর্ম আবার শুরু হয়ে যায়। আমরা যদি মনে করি রমজানের রোজাতো রাখলামই এখন আর ধর্ম-কর্ম ঠিকভাবে পালন করে কি করবো আবার আগামী বছর রোজা রেখে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিব। এমন চিন্তা-ভাবনা যদি কারো মনে জাগ্রত হয় তাহলে সে মারাত্মক ভুল করবে। রোজার দিনগুলো হচ্ছে প্রশিক্ষণের দিন, এই প্রশিক্ষণ মতাবেক বছরের এগারো মাস অতিবাহিত করলেই না আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভ সম্ভব হবে। আর না হয় এক মাস রোজা রাখার পর আবার যদি খারাপ কাজে জড়িয়ে যাই তাহলে এই রোজা আমাদের জীবনের কোন পরিবর্তন বয়ে আনবে না।

আমাদের রোজা তখনই আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হবে যখন আমরা রমজানের পর বাকী এগারো মাস রমজান মাসের দিনগুলোর মতই নিজের জীবন অতিবাহিত করব। রমজানে যে বিষয়গুলো প্রশিক্ষণ নিয়েছি তা বাকী দিনগুলোতে কাজে লাগাতে হবে তাহলেই আমাদের রোজা আল্লাহর দরবারে গ্রহণীয়তার মর্যাদা পাবে। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পাঁচ বেলার নামাজ, এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা এবং এক রমজান থেকে পরবর্তী রমজান পর্যন্ত মধ্যবর্তী পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায়। শর্ত হলো, মানুষ যদি বড় বড় গুনাহ এড়িয়ে চলে।’ (মুসলিম)

আমাদের জন্য মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই দিক-নির্দেশনা, যা শুধু পাপ থেকেই মুক্ত রাখে না বরং মুক্তি ও পরিত্রাণের ব্যবস্থা হয় এবং আধ্যাত্মিকতা লাভ হয়। যে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে, এক নামাজের পর পরবর্তী নামাজের কথা ভাববে, এটি হতেই পারে না যে, সে কোন ধরনের পাপে লিপ্ত হবে বা অন্যের ওপর জুলুম করা আরম্ভ করবে। আর কেউ যদি এমনটি করে তাহলে তার নামাজ, নামাজ নয় বরং সে সবচেয়ে বড় পাপে লিপ্ত।

রমজান মাসের রোজার পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। শাওয়াল মাসের রোজা সম্পর্কে হাদিসে বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে। যেমন হজরত আবু আয়্যূব আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হজরত মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখে এবং পরবর্তীতে (ঈদের দিন বাদ দিয়ে) শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখে সেক্ষেত্রে সে যেন গোটা বছরই রোজা রাখলো।’ (মুসলিম)
হাদিসে আরো বর্ণিত হয়েছে হজরত ছাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, তিনি মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা প্রতিটি নেকী ১০ গুণ বৃদ্ধি করেন। সুতরাং রমজানের এক মাস রোজা রাখার দ্বারা ১০ মাস রোজা রাখার সাওয়াব হবে এবং ঈদুল ফিতরের পর ছয়টি রোজা রাখার দ্বারা পূর্ণ এক বছর রোজা রাখার সাওয়াব হবে।’ (ইমাম নাসায়ি ফিস সুনানিল কুবরা)

অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে হজরত ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা রাখল, এরপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখল, সে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় গোনাহমুক্ত হয়ে গেল।’ (আল মুজামুল আওসাত)

হজরত আবু আইয়ুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল, এরপর শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখল সে যেন এক যুগ (পূর্ণ বছর) রোজা রাখল।’ (আবু দাউদ)

এসব হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারলাম শাওয়াল মাসের রোজার গুরুত্ব কত ব্যাপক। শুধু রোজা রাখলেই হবে না বরং প্রকৃত অর্থে আল্লাহর সন্তুষ্টির খাতিরে রোজা রাখতে হবে।

নামাজ আর রোজার সমন্বয়ে মানুষের মাঝে আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তা এভাবে যে, নামাজ আত্মাকে পবিত্র করে এবং রোজা হৃদয়কে আলোকিত করে। ফলশ্রুতিতে নিষ্ঠাবান ব্যক্তি রোজা দ্বারা আধ্যাত্মিকতার এক নতুন রাস্তায় পরিচালিত হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির ছায়াতলে চলে আসে। পবিত্র কুরআন বলে, ‘রোজা তোমাদের মাঝে তাকওয়া অর্থাৎ খোদা-ভীতি সৃষ্টি করবে।’ এই তাকওয়া কীভাবে সৃষ্টি হবে? বস্তুত রোজা এমন ইবাদত যা মানুষের প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। যদি ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ না রেখে কেউ রোজা রাখে তবে তা রোজা নয় বরং অন্য কিছু। খোদা-ভীতির সৃষ্টি এভাবেই হয় যে, মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের মন-মেজাজ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়। ফলে ধীরে ধীরে তার অবাধ্য আত্মা নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। ঐ সকল কর্ম হতে সে দূরে সরে পরে যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অসন্তুষ্টির কারণ হয়।
রমজানের দিনগুলো যেভাবে ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে কাটিয়েছি বছরের বাকী দিনগুলোও যদি সেভাবে কাটাতে পারি তবেই না আমরা আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির চাদরে আবৃত থাকবো। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষার ওপর আমল করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
[email protected]

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।