উন্নয়ন আর দুর্নীতি


প্রকাশিত: ০৪:৩৯ এএম, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানুষের মাথাপিছু আয়, সামাজিক খাতে অগ্রগতি যেমন আলোচনার বিষয়, তেমনি আলোচনায় দুর্নীতি। চায়ের টেবিলে, সেমিনারে, টেলিভিশন টকশোতে সবখানে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আছে। অনেকে এও বলছেন যে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি আর দুর্নীতি চলে এখন সমান্তরালে। অনেকেই বলতে চান যে উন্নয়ন আর দুর্নীতি মাসতুতো ভাই।  কিন্তু তা কি করে হয়?

বিতর্কে এও বলা হয যে, সমাজের সব স্তরেই দুর্নীতি আছে, ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুততার সাথে। আর কারণ হলো দুর্নীতি করার উপায় আর সুযোগ দুইই বাড়ছে। তাই দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা, তার অবসানের পরামর্শ দেয়া খুব সহজ কাজ নয়, সরলভাবে তা বলাও যাচ্ছে না।

বিচিত্র সব দুর্নীতির কথা প্রচলিত সমাজে। ঘুষ, অর্থ আত্মসাত, চাঁদাবাজি, রাষ্ট্রীয় বা অন্যের সম্পদ দখল, ব্যবসার জন্য ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা মেরে দেয়া, কর না দেয়াসহ অজস্র প্রকারে দুর্নীতি হয় আমাদের সমাজে। প্রতিবছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির যে ধারণা সূচক প্রকাশ করে তাতে আমরা দেখছি বেশ অনেক বছর ধরেই এক/দুই ধাপ এদিক হলেও, বিশ্বের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান বেশ পাকাপোক্ত।

সব দুর্নীতির অভিযোগ বিচারযোগ্য নয়, অর্থাৎ সেগুলি আদালত অবধি গড়ায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভাগীয় তদন্তই যথেষ্ট। কিন্তু তাও আসলে আমাদের দেশে ঠিকমতো হয় না। দুর্নীতি বাড়ে কারণ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ভাল উন্নতি লাভ করা যায়, ধরা পড়ার ঝুঁকি কম। অর্থনীতির যুক্তি বলে যে, দুর্নীতির সম্ভাব্য শাস্তির ‘খরচ’ যদি প্রত্যাশিত ‘আয়’-এর চেয়ে বেশি হয়, তবেই দুর্নীতি নিবারণের একটা সম্ভাবনা থাকে।  আমাদের দেশে এখন প্রত্যাশিত আয় বিপুল, সম্ভাব্য খরচ খুব কম। ফলে প্রচলিত ব্যবস্থায় দুর্নীতি উৎসাহিত হয়।

চিন্তার কারণটা হলো আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে আমাদের সমাজের মাথাব্যথা দিন দিন নিম্নমুখী। কেউ কিছু বলছে না। এমন একটা ভাব যেন, হচ্ছেতো হোক না। আর ঠিক একারণেই প্রশ্ন উঠে যে,  উন্নয়ন আর দুর্নীতি কি হাতে হাত ধরে এগোবে?  কিন্তু তার চেয়েও যে প্রশ্ন বেশি জটিল তাহলো দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থান বা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কোনও দীর্ঘস্থায়ী খারাপ ফল নিয়ে আমরা ভাবছি কিনা? যারা দুর্নীতি করে তারা আজ সমাজের পরাক্রমশালী অংশ। এদেরই গলার জোর বেশি। এরাই সন্মানিত। একটা সময় ছিল যখন দুর্নীতি থেকে মুক্ত মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলা মানুষদের সমাজ কিছু বাড়তি সম্মান দিত। তা আর এখন নেই। বিষয়টা এমন যে, সেই মানুষটি নিজের পরিবারের সদস্যদের কাছেই হয়তো সন্মান পান না।

আমরা হয়তো কোনোদিন ভেবে দেখিনি যে একটি শ্রেণি খুব সুচতুরভাবে দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থানকে ভঙ্গুর করে দেওয়ার চক্রান্ত করেছে এবং তারা সফল হয়েছে। প্রতিনিয়ত মাত্রাতিরিক্ত বৈভবের প্রদর্শনীতে সকলেই মত্ত কিছু না কিছু কামিয়ে নিতে। বড় দুর্নীতি যারা করে তারা সাধারণ মানুষকে ছোট ছোট দুর্নীতিতে ডুবিয়ে দিয়ে তাদের নৈতিক মনোবল ভেঙে দিয়েছে। ফলে এখন আর কোথাও প্রতিবাদ নেই।  

বড় দুর্নীতি আর দুর্নীতিবাজদের প্রতি সমাজের রাজনৈতিক সমর্থন থাকায় তারা অপ্রতিরোধ্য। প্রশাসনিক পর্যায়ে জবাবদিহিতার দুর্বলতায় বড় দুর্নীতিবাজদের ভয়টা চলে গেছে একেবারেই। কারণ তারা জানে তাদের কিছু হবে না। বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক কেলেংকারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ আত্মসাতসহ আর্থিক খাতের বড় দুর্নীতিগুলোর কোনো বিচার হয়নি। এরকম অসংখ্য ঘটনা বলা যাবে যেখানে বড় দুর্নীতিবাজরা বহাল তবিয়তে আছে সব সুবিধা নিয়ে। আর এর প্রভাব পড়ছে মাঝারি বা ছোটদের উপরও।  

আমরা জানি বৈষম্য বাড়ছে। উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্যের নাকি একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে। অর্থাৎ উন্নয়নের জন্য কিছুটা বৈষম্য নাকি মেনে নিতেই হয়। কিন্তু উন্নয়ন মানেই কি দুর্নীতি? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? উন্নয়নও হয়, দুর্নীতিও চলে, এমন একটা পরিস্থিতি না হয় তর্কের খাতিরে মানা গেল। কিন্তু যদি উন্নয়নের নামে শুধুই দুর্নীতি হয়, সেটা কি মানা যায়?

সমাজের সর্বত্র বৈষম্য আজ প্রকটভাবে প্রকাশিত। নিজের পড়শি থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন, অফিসের সহকর্মী সবার সঙ্গে নিরন্তর প্রতিযোগিতা এখন আমাদের সবার। কে কয়টি বাড়ি করেছে, কার গাড়ি কত দামি, কে চাকুরির টাকায় নয়, উপরি দিয়ে কি করেছে তার আলোচনা। একটা হাহাকার। তিনি এতকিছু করে ফেলেন, আমি পারছিনা, এমন একটা আফসোস। একটা সময় ছিল যারা উপরি কামাই করতো, তারা একটু রয়েসয়ে চলতো। এখন তারা নির্লজ্জ প্রদর্শনীতে মত্ত। প্রদর্শনমুখী চরম ভোগবাদের উৎকট রূপ।

আমরা দুর্নীতিকে নিয়ে যাচ্ছি একেবারে শেকড়ে। ছোট্ট সোনামনিকে স্কুলে ভর্তি করার সময় অর্থ ঢালা থেকে শুরু করে তার পিএসসি/জেএসসি/এসএসসি/এইচএসি এমনকি তাকে ডাক্তার বানানোর ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও বাবা-মা বা অভিভাবক বড় অংকের অর্থ ঢেলে জোগাড় করে দিচ্ছেন। ফলে এই ছেলে বা মেয়েটি আগামীতে তার পেশাগত জীবনে কোন সৎ চর্চাটা করবে?

দুর্নীতি কমানো যায় কি করে? প্রথম ভাবার জায়গা হলো সব দুর্নীতি কমানো যাবে না, দুর্নীতি করার সুযোগ কমাতে হবে। তাই টেন্ডার, ক্রয় এসব যতো বেশি ডিজিটাল করা যায় ততো সুযোগ কমে। যে দুর্নীতি সরাসরি দরিদ্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে সেদিকে নজর দেয়া বেশি জরুরি। যারা ভিজিএফ কার্ড, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, বয়স্ক ভাতা এসব নিয়ে দুর্নীতি করে তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিবেচনা ছাড়া ব্যবস্থা নিলে দরিদ্র মানুষ উপকৃত হয়। এসব দুর্নীতি শেষ বিচারে উন্নয়নের পথে বড় বাধা।

বড় আকারের দুর্নীতির তুলনায় মানুষকে সেবা দেয় এমনসব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি আটকানো তুলনায় সহজ। একচেটিয়া কর্তৃত্ব এবং যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার খর্ব করে, এসব সেবাদান কর্মকাণ্ডকে বিকেন্দ্রীকরণ করলে দুর্নীতির সুযোগ কমে। একটা বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতি-প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করে দৈনন্দিন দুর্নীতির প্রকোপ কমানো সম্ভব। তবে সবই সম্ভব যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। কারণ দুর্নীতিবাজদের সবচেয়ে বড় সহায়ক শেষ পর্যন্ত রাজনীতিকরাই।  

syed-Ishtiaque-Reza

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।