আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পফায়ার


প্রকাশিত: ০২:২৪ এএম, ১৫ এপ্রিল ২০১৬

কথায় বলে, যার মনে যা/ লাফ দিয়ে ওঠে তা। অর্থাৎ, মনের ভাব-অনুভব, রাগ-অনুরাগ দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এক সময় না এক সময় তা প্রকাশিত হবেই। নির্লিপ্ত জাতি হিসেবে পরিচিত আমেরিকানদের ট্রাম্পফায়ারে ছটফট করতে দেখে তো কথাটা হুবহু মিলে গেছে মনে হচ্ছে। কেন, সেটাই তো বলতে চাইছি!

সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আমেরিকা বলে নয়, গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির সবচেয়ে বড় হুমকির অন্যতম বলে রায় দিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। ১ থেকে ২৫ পর্যন্ত রেটিং করে দেখা গেছে এর ১২ নম্বর পেয়ে গেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প-ই। এই প্রথম আমেরিকার কোন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট এই তালিকাকে গৌরবান্বিত করলেন!
কিন্তু করছেনটা কি তিনি?

নির্বাচনী সমাবেশে প্রতিবাদকারীদের দেখলে তিনি তাদেরকে নক্ আউট করার প্রকাশ্য হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিবাদকারীদের স্ট্রেচারে ‘শুইয়ে’ দেওয়ার হুমকিও আছে, সমর্থকদের ‘পাঞ্চ’ মারতে উৎসাহিতও নাকি করছেন। আমেরিকার ইতিহাসে নির্বাচনী সমাবেশে সন্ত্রাসের এই প্রথম উপস্থিতি তাঁরই কারণে যে! সে তিনি এর দায় তিনি নিতে না চাইলেও তো নিতে হবে। কেননা মারামারির চোটে কোন কোন সমাবেশ পণ্ড হচ্ছে, কোনটা তিনি বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছেন। উত্তর ক্যারোলিনাতে এক ট্রাম্প-সমর্থক আরেক প্রতিবাদকারীর মুখে ঘুষি ছুঁড়ে মারছেন, এমন ভিডিও ভাইরাল হয়ে উঠেছিল।

শিকাগোতে হ’ল টা কি? শত শত প্রতিবাদকারীদের সাথে মারামারি শুরু করল ট্রাম্পের সমর্থকরা। এরকম এক ঘণ্টা চলার পর পুলিশ এসে সভা পণ্ড করতে অনুরোধ করলে তিনি পণ্ডই করলেন। জনাব ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি সান্ডার্স নাকি গুণ্ডা পাঠিয়েছিলেন সভা পণ্ড করতে, এ অভিযোগ ট্রাম্পের। ফক্স টিভির ক্যামেরার সামনে তিনি তাঁর সমর্থকদের মারামারিতে উৎসাহিত করার মত কোন কথা বলেননি বলে দাবি করেন। তবে এটাও বলে ফেলেন, তিনি এক দল মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যারা খুব ‘রাগী’। Ô I represent a large group of people that have a lot of anger.Õ
আমেরিকার এক দল মানুষ রেগে আছেন। আর তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। এর নামই ট্রাম্পফায়ার, যা সম্ভবত গোটা আমেরিকা, এমনকি গোটা বিশ্বকেও পুড়িয়ে ফেলতে পারে।

নির্লিপ্ত আমেরিকানদের, ইতিবাচক ভাবে বলা যায় সব কিছুকে ‘ভালই তো হচ্ছে’ ভাবতে অভ্যস্ত জাতির গায়ে বসে যাওয়া এই নতুন তকমা বিশ্বকে নড়ে চড়ে বসতে উৎসাহিত করছে বৈকি। জানার আগ্রহ জাগে, কেন আমেরিকানরা রেগে আছে?
প্রতিবাদকারীদের রাগ দেখে মনে হয়, হয়তো মূলধারা বহির্ভূত দুই প্রার্থী, যেমন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ডেমোক্রাট বার্নি স্যান্ডার্সের সাফল্য তাদের ভাল লাগছে না। না লাগতেই পারে। তবে ফুঁসে ওঠার পেছনে জ্বালানিটা কি?

সিএনএনএন ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জরিপ চালিয়ে এই রাগের আঁচ টের পায়।  জরিপের ফলাফলে উঠে আসে, শতকরা ৬৯ ভাগ আমেরিকান ‘যা কিছু ঘটছে তা ঠিক হচ্ছে না’ ভেবে রাগান্বিত। এদেরই এক অংশ ভাবছে, চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ‘কেবলমাত্র টাকা আর ক্ষমতা’-কে গণনার ভেতর রাখে। এনবিসি ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর জরিপে বলা হয়, অনেক মানুষ এক বছর আগে যতটা রাগী ছিল, ক্রমান্বয়ে তার চেয়ে বেশি রেগে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি ২০১৬-তে এনবিসি ও এসকোয়ার সার্ভে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখে, শতকরা ৬১ ভাগ রিপাবলিকান এবং ৫৪ ভাগ সাদা চামড়ার আমেরিকান তো বটেই, এদের সাথে সাথে ৪২ ভাগ ডেমোক্রাটস, ৪৩ ভাগ ল্যাটিনো আর ৩৩ ভাগ আফ্রিকান আমেরিকানরাও রেগে আছে।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এরকম রাগারাগি-মারামারির ঘটনা ঘটে নির্বাচনের সময়, এসব আমরা দেখে দেখে অভ্যস্ত। প্রথম বিশ্বে ঘটছে দেখে কৌতূহল জাগে। আরো বিস্ময় জাগে, মানুষের রাগ নামক অনুভূতিকে পুঁজি করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমেছেন দেখে। ডোনাল্ড ট্রাম্প চোখ-মুখ কুঁচকে বলছেন, তিনিও নাকি Ôvery, very angryÕ, এবং রাগের উত্তাপ আনন্দের সাথে উপভোগ করছেন। প্রতিদ্বন্দী বেন কারসন আমেরিকানদের রাগকে স্বীকার করে নিয়ে বলছেন, মানুষ তাদের স্বপ্নকে পিছলে পড়তে দেখে রেগে উঠেছে। ডেমোক্রাটিক দলের আশাবাদী প্রার্থী বার্নি সান্ডার্সও চোখ-মুখ কুঁচকে বলেছেন, ÔI am angry and millions of Americans are angryÕ, আর হিলারী ক্লিনটন গম্ভীর হয়ে বলছেন, তিনি নাকি বোঝার চেষ্টা করছেন কেন মানুষ রেগে গেছে।

রাগের কারণ জানতে তৎপর হতেই জানা গেল বেশ কিছু কারণ। প্রথমটি হচ্ছে, অর্থনীতি। গত ১৫ বছরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরিণত হয়েছে শ্রমিক শ্রেণিতে। এ কথা রাষ্ট্রপরিচালনা বিশেষজ্ঞ ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের থিংক ট্যাঙ্ক হিসেবে খ্যাত ইউলিয়াম গালস্টনের।  বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কা সামলে উঠে বেকারত্বের হার খানিকটা কমানো গেলেও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের অভাব, সুযোগ সীমিত সাধারণের জন্য। অন্য দিকে বিলিওনিয়ার, ব্যাংক আর ওয়াল স্ট্রিট ফুলে ফেঁপে উঠছেই। অন্য দেশগুলো, বিশেষ করে অভিবাসীরা বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সাথে আমেরিকান অর্থনীতির সুবিধায় ভাগ বসাচ্ছে, যা গাছেরটাসহ তলারটা খেয়ে ফেলার উদাহরণ।

আমেরিকার জনতাত্ত্বিক ভারসাম্য পাল্টে যাওয়া আরেকটা কারণ। ১৯৬৫ সাল নাগাদ প্রায় ৫৯ মিলিয়ন অভিবাসী ছিল, যার বেশির ভাগই অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করেছিল। ৪০ বছর আগে শতকরা ৮৪ ভাগ আমেরিকান হয়ে গেল নন-হিসপানিক সাদা মানুষ, গত বছরে এর পরিমাণ ছিল ৬২ ভাগ। ২০৫৫ সাল নাগাদ মোট জনসংখ্যার অর্ধেকে পরিণত হবে এরা। ২০৫৫ সাল নাগাদ আমেরিকা যদি এশিয়ানদের হয়ে যায়, এ ভয় নাকি খুব কাজ করছে! জনতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সাথে জড়িয়ে আছে জাতিগত, সংস্কৃতিগত, ধর্মগত আর প্রজন্মগত বিভেদ। মনস্তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের মতো, অভিবাসীদেরও রাগ তৈরি হয়। নিজেদেরকে বঞ্চিত মনে করতে থাকে। বৈষম্য, বেকারত্ব, সহজে কাজ না পাওয়া, সন্তুষ্টির অভাব, দুঃশ্চিন্তা ইত্যাদির সাথে সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার ভয় থাকে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ডিসেম্বরে ক্যালিফোর্ণিয়ায় সন্ত্রাসী আক্রমণে ১৪ জন নিহত হওয়ার সন্ত্রাসী ঘটনার সাথে মেক্সিকান অভিবাসী থেকে শুরু করে আমেরিকার মুসলমানদেরকেও টার্গেট করে বক্তব্য দেন, তখন অভিবাসীদের এবং স্থায়ী বাসিন্দা উভয়েরই মনের অবস্থাটা কি দাঁড়ায়?

সরকার বিশ্বাসযোগ্য নয়, এ বিশ্বাস করে শতকরা ৮৯ ভাগ রিপাবলিকান আর ৭২ ভাগ ডেমোক্রাট। ৬ থেকে ১০ ভাগ লোকের ধারণা, অতিমাত্রায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে সরকার মহোদয়। সরকারই আমেরিকার মূল সমস্যা, এ কথাও বিশ্বাস করে অনেকে। জনগণের সাথে সরকারের অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে বলে জন্ম নিয়েছে হতাশা। আইওয়াতে রিপাবলিকান ককেশাস জয়ী টেড ক্রুজ জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ রাজনীতিবিদদের কথা শুনছে না বলে প্রতিটি আমেরিকানকে ‘বিজয়ী’ আখ্যা দিয়েছেন!

সুপারপাওয়ার হিসেবে বিশ্বে আমেরিকার সম্মানজনক অবস্থান কতটা বহাল, এ নিয়েও হতাশাও রাগের অন্যতম কারণ। ২০১৩ সালের এক জরিপের ফলে জানা গেছে, শতকরা ৭০ ভাগ আমেরিকান মনে করে বিশ্ববাসী আমেরিকাকে সম্মান করে না। গত ১৫ বছরের আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতি সফল নয়, ৯/১১-এর আতঙ্ক আসলে কখনোই কাটবে না, আর তাই এখনকার আমেরিকা আসলে দিকভ্রান্ত নাবিকের মত দিশেহারা, কোন্ দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। ওদিকে চীনের উত্থান, তালেবান-নির্মূলে ব্যর্থতা, তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে নেওয়া ধীর পদক্ষেপ রাশিয়াকে সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে আবারো সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার। ন্যুয়র্ক টাইমস খুঁজে দেখেছে, এখন আমেরিকা সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে অনেক বেশি ভীতু, আর তা বোঝা যায় প্যারিস হামলার পর ফরাসী প্রতিক্রিয়ার সাথে সান বার্নারডিনো শ্যুটিং-এর পর আমেরিকার প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতা দেখলে। ফরাসীরা সরকারের সাথে থেকেছে আর আমেরিকানরা সরকারকে দোষারোপ করেছে। দেশ ও জনগণকে রক্ষায় আমেরিকান সরকার ব্যর্থ বলেই কি ধরে নিচ্ছে আমেরিকানরা?

আগামী নভেম্বরের নির্বাচনেই সম্ভবত প্রথম বারের মতো আমেরিকা মোটামুটিভাবে ডেমোক্রাট আর রিপাবলিকান শিবিরে মোটা দাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিরোধী দলের প্রতি মারমুখো ভাব দ্বিগুণ হয়ে গেছে, যা নাকি মুখ দেখাদেখি বন্ধের পাশাপাশি নিজেদের ছেলেপুলের বিয়েশাদির ভেতরও ঝামেলা টেনে আনছে। মেরুকরণের ফলে মধ্যপন্থীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। এদের বড় অংশই কিন্তু তরুণ ভোটার, কাজেই আগামী নির্বাচনে এরা বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে হচ্ছে।
এবার ট্রাম্পফায়ারের প্রসঙ্গে আবারো আসি। জনগণের রাগ কি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ‘রাগী’ প্রার্থীকে জয়ী হতে সাহায্য করবে? এ-ও তো আলোচনার বিষয় বটে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।