অবন্তিকার আত্মহত্যা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ হবে কবে?

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৪৩ এএম, ১৮ মার্চ ২০২৪

শুক্রবার রাতে হঠাৎ ফেসবুকে একটা খবর দেখে চমকে গেলাম। ফাইরুজ অবন্তিকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার আগে তিনি ফেসবুকে তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বিস্তারিতভাবে। আমার বাড়ি কুমিল্লা, ফাইরুজের বাড়িও কুমিল্লায়। এটুকু ছাড়া আর কোনো নৈকট্য নেই। শুক্রবারের আগে আমি কখনো তার নামও শুনিনি। কিন্তু ফুলের মতো মেয়েটির মৃত্যু আমাকে বেদনার্ত করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে।

অত দূর থেকে আমারই যদি অত কষ্ট হয়, তার সহপাঠী, তার স্বজনদের বেদনা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে অনেক বেশি। তারা ক্ষুব্ধ হয়েছে। প্রতিবাদ করেছে। আলটিমেটাম দিয়েছে। বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মানুষের জীবন একটাই। কোনো কিছুর বিনিময়েই জীবন ফিরে পাওয়া যায় না। তাই একজন মানুষ যখন নিজের জীবন দিয়ে দেয়, তখন বুঝে নিতে হবে, তার অসহায়ত্ব সীমা ছাড়িয়েছে, তার আর করার কিছু নেই।

ফাইরুজ অবন্তিকা মৃত্যুর আগে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। আম্মান যে আমাকে অফলাইন অনলাইনে থ্রেটের ওপর রাখতো সে বিষয়ে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করেও আমার লাভ হয় নাই। দ্বীন ইসলাম আমাকে নানান ভাবে ভয় দেখায় আম্মানের হয়ে যে আমাকে বহিষ্কার করা ওনার জন্য হাতের ময়লার মতো ব্যাপার। আমি জানি এখানে কোনো জাস্টিস পাবো না।’

ভাবুন একবার সহপাঠীর বিরুদ্ধে প্রক্টর অফিসে গিয়ে ন্যায়বিচার তো পায়ইনি, উল্টো বহিষ্কারের হুমকি পেয়েছে। জাস্টিস পাবে না জেনেই ফাইরুজের মতো একটা তাজা প্রাণ ঝরে গেলো অকালে। অভিযোগ করায় সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম তাকে বলেছে, ‘খানকি তুই এই ছেলেরে থাপড়াবি বলসস কেন? তোরে যদি এখন আমার জুতা দিয়ে মারতে মারতে তোর ছাল তুলি তোরে এখন কে বাঁচাবে?’

ভাবুন একবার সহপাঠীর যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে বিচার চাইতে গিয়ে প্রক্টরের কাছে আরেকবার হেনস্তার শিকার হলেন ফাইরুজ। সে আর যাবে কোথায়? কার কাছে বিচার চাইবে? একজন শিক্ষক, যিনি সবার অভিভাবক হওয়ার কথা, যিনি ন্যায়বিচার করার কথা। তিনিই যদি তার শিক্ষার্থীকে ‘খানকি’ বলে গালি দেয়, তার আর কী করার থাকে। এমন অসহায় অবস্থায় বাংলাদেশে একজন নারীর পক্ষে আত্মহনন ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না বুঝি।

ফাইরুজ লিখেছেন, ‘আমি ফাঁসি দিয়ে মরতেসি। আমার ওপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এতো ভালোবাসে যে মানুষ, সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না, বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইসিলাম! আর পোস্ট মর্টেম করে আমার পরিবারকে ঝামেলায় ফেলবেন না। এমনিতেই বাবা এক বছর হয় নাই মারা গেছেন আমার মা একা। ওনাকে বিব্রত করবেন না। এটা সুইসাইড না এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার। আর আম্মান নামক আমার ক্লাসমেট ইভটিজারটা আমাকে এটাই বলছিল, যে আমার জীবনের এমন অবস্থা করবে যাতে আমি মরা ছাড়া কোনো গতি না পাই। তাও আমি ফাইট করার চেষ্টা করসি। এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সহ্য ক্ষমতার।’

কতটা অসহায় হলে একটা মেয়ে মৃত্যু বেছে নিতে পারে শেষ আশ্রয় হিসেবে; আমরা কি একটুও অনুভব করার চেষ্টা করতে পারি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা যায় শিক্ষা নিতে, আলোকিত হতে, জ্ঞান অর্জন করতে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠেছে একেটা নির্যাতনের কেন্দ্র। কখনো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কখনো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থীরাও নিরাপদ নয়। কখনো ধর্ষণ, কখনো যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আসে।

 

ভাবুন একবার সহপাঠীর যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে বিচার চাইতে গিয়ে প্রক্টরের কাছে আরেকবার হেনস্তার শিকার হলেন ফাইরুজ। সে আর যাবে কোথায়? কার কাছে বিচার চাইবে? একজন শিক্ষক, যিনি সবার অভিভাবক হওয়ার কথা, যিনি ন্যায়বিচার করার কথা। তিনিই যদি তার শিক্ষার্থীকে ‘খানকি’ বলে গালি দেয়, তার আর কী করার থাকে। এমন অসহায় অবস্থায় বাংলাদেশে একজন নারীর পক্ষে আত্মহনন ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না বুঝি।

 

মাদরাসা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছেলেশিশুকে বলাৎকারের অভিযোগ আসে। তবে আমি নিশ্চিত, যতটা অভিযোগ সামনে আসে, আড়ালে থাকে তারচেয়ে অনেক বেশি অভিযোগ। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যখন যৌন হয়রানি বা সহযোগিতার অভিযোগ আসে, আমার বিশ্বাস হতে চায় না। একজন শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক মানেই অভিভাবক, শিক্ষক মানেই গুরু। একজন শিক্ষক তার ছাত্রীর দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকাবেন, এটাই অবিশ্বাস্য। তিনি ছাত্রীকে ব্ল্যাকমেইল করবেন, পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেবেন; এটা তো কল্পনাও করা যায় না। আমরা কল্পনা করতে না পারলেও, এটাও বাস্তবতা। সব শিক্ষক খারাপ নয়। বরং ভালো শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু পরিমলদের মতো শিক্ষকও কম নয়।

এখন যেমন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তাল। তেমনই কোনো অভিযোগ এলে বিভিন্ন ক্যাম্পাস উত্তাল হয়। কিন্তু তারপর আবার সব আগের মতোই চলে। আগের মতো চলে কেন? কারণ দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে দ্বীন ইসলাম ও আম্মান সিদ্দিকীকে প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত ও বহিষ্কার এবং পরে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একজন নারী, ড. সাদেকা হালিম। একজন নারী হয়েও তার ক্যাম্পাসটি একজন নারীর জন্য নিরাপদ রাখতে পারেননি তিনি। এটা তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা বলবো না আমি। এটা আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতারই প্রতিফলন। অবন্তিকা মৃত্যুর আগে লিখে গেছেন, ‘আমি উপাচার্য সাদেকা হালিম ম্যামের কাছে আপনি এই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে আপনার কাছে বিচার চাইলাম।’

এখন বিচার হলো কি হলো না, তাতে অবন্তিকার আর কিছু যাবে আসবে না। তিনি এখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তবু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ার স্বার্থে, প্রতিটি শিক্ষার্থী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে এর দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়াটা জরুরি। আমরা ড. সাদেকা হালিমের কাছে বিচার চেয়ে রাখলাম। যেন ফাইরুজের মৃত্যুই হয় শেষ ঘটনা। যেন জগন্নাথের দৃষ্টান্তে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নারীদের জন্য নিরাপদ হয়। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, গোটা বাংলাদেশটাই নারীদের জন্য নিরাপদ করে তোলা আমাদের সবার দায়িত্ব।

ফাইরুজের মতো ফাইটার মেয়েও যদি এভাবে লড়াইয়ের মাঠ ছেড়ে দেয়, এভাবে হাল ছেড়ে দেয়, এভাবে পরাজয় মেনে নেয়; তাহলে আমাদের নারীদের বিপদ আরও বাড়বে। সবাইকে হার না মানা ফাইটার হতে হবে। লড়াই করতে হবে বেঁচে থেকে। অবন্তিকা মরে গেছে বলে আজ সবাই তার পাশে দাঁড়াচ্ছেন। বেঁচে থাকতে যদি সবাই দাঁড়াতো, তাহলে হয়তো তাকে মরতেই হতো না।

শনিবার দুপুরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে যখন অবন্তিবার লাশ তার বাড়ি আনা হয়, তখন জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন তার মা তাহমিনা শবনম। এ সময় অবন্তিকার মাকে বলতে শোনা যায়, ‘আল্লাহ সবাইকে নিয়ে যায়, আমাকে কেন নেয় না। আল্লাহ আমার স্বামীও নিল, মেয়েও নিল। এ আমি কার লাশ দেখছি? এটা তো আমার তিল তিল করে গড়ে ওঠা স্বপ্নের লাশ।’ এভাবে আর কত তাহমিনা শবনমের স্বপ্ন লাশ হয়ে যাবে? আর কত ফাইরুজ আত্মহত্যা করলে আমাদের ক্যাম্পাস নিরাপদ হবে?

যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে জগন্নাথে, তা ছড়িয়ে দিতে হবে সব ক্যাম্পাসে। আর কোনো নারীকে যেন এভাবে জীবন দিতে না হয়। আর একজন নারীও যেন যৌন হয়রানির শিকার না হয়। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীর পাশে থাকবে অভিভাবকের মতো, সহপাঠী পাশে থাকবে বন্ধুর মতো। নারীদের জন্য একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস, একটি নিরাপদ দেশ গড়ে তুলতে না পারলে সেটা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য লজ্জার, পুরুষের জন্য অবমাননার।

১৭ মার্চ, ২০২৪
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।