আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৪

এখনো মুরগির রান আর মাছের মুড়ো ছেলের পাতে দেওয়ার চিন্তা রয়ে গেছে

শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:২৩ এএম, ০৮ মার্চ ২০২৪

ছোটবেলায় একটি গল্প পড়েছিলাম। একটি লোক সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে তার স্ত্রীর কাছে সারাদিনের কাজকর্ম এবং সংসারের খোঁজখবর নিচ্ছে। লোকটি জিজ্ঞাসা করছে, ‘ঋণ শোধ করেছ? ঋণ দিয়েছ? ভস্মে ঘি ঢেলেছ?’ এখানে ঋণ শোধ করা বলতে লোকটি বোঝাচ্ছে বৃদ্ধ বাবা-মাকে যত্ন করার কথা। ঋণ দেওয়া হলো ছেলেসন্তানকে খাদ্য দেওয়ার কথা। আর ভস্মে ঘি ঢালার মানে হলো কন্যাসন্তানকে খেতে দেওয়া। হ্যাঁ এক সময় এটাই ছিল প্রচলিত চিন্তাধারা। মনে করা হতো মেয়ে তো বিয়ের পর পরের ঘরেই চলে যাবে, বাবা-মায়ের কোনো কাজেই আসবে না। তাই মেয়েশিশুকে যত কম যত্নে বড় করা যায়। মেয়ের পেছনে খরচ মানে ছাইয়ের গাদায় ঘি ঢালার মতো নিষ্ফল খরচ।

এ ধরনের চিন্তাভাবনা থেকে অবশ্যই সমাজ বেরিয়ে এসেছে। তবুও পুরোপুরি নয়। এখনও ছেলেসন্তানের লেখাপড়ার জন্য বেশি খরচ আর মেয়েসন্তানকে যেমন তেমনভাবে লেখাপড়া শেখানোর মানসিকতা রয়ে গেছে কোনো কোনো পিছিয়ে পড়া পরিবারে। এখনও মুরগির রান, আর মাছের মুড়ো ছেলের পাতে দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়ে গেছে। নারীর চিকিৎসায়ও পুরুষের তুলনায় কম ব্যয় করা বিশ্বজুড়ে। এখনও সারা বিশ্বে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি দরিদ্র।

নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হলো নারীর উন্নয়নে বিনিয়োগ। বলা হচ্ছে নারীতে বিনিয়োগ করুন: অগ্রগতি ত্বরান্বিত করুন। এর ব্যাপক অর্থ হলো জেন্ডার সমতার জন্য অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। এর বৃহত্তর অর্থ হলো নারীর শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, দক্ষতা বৃদ্ধিতে, চিকিৎসায়, পেশায় বিনিয়োগ। যেমন- শিশুবেলায় ছেলেসন্তানের পাশাপাশি কন্যাসন্তানের জন্য যদি একই রকম অর্থ বিনিয়োগ করা যায় তাহলে দক্ষ ও কর্মী পুরুষের মতোই সমাজ একজন দক্ষ ও কর্মী নারী পাবে। মেয়েশিশুকে প্রকৌশল, চিকিৎসা বিদ্যায় পড়ানোর জন্য অর্থব্যয়। মেয়েকে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ানো।

শুধু তাই নয়, নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্যও অর্থব্যয় করা উচিত। এ ধরনের অর্থ ব্যয় আসলে বিনিয়োগ যা থেকে পরবর্তীকালে পরিবার ও সমাজ উপকৃত হবে। বাংলাদেশে নারীর ওপর বিনিয়োগে বেশ কিছু বাধাও আছে। বাল্যবিয়ে বাংলাদেশের সমাজের একটি বড় সমস্যা। বিশেষ করে নারী উন্নয়নের পথে অন্যতম বড় বাধা হলো বাল্যবিয়ে। ১৮ বছর বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ে এবং মাতৃত্বের কারণে তাদের বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক মায়ের সন্তান প্রায়শই হয় অপুষ্টির শিকার। অপ্রাপ্তবয়স্ক মায়ের ও সন্তানের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। ফিস্টুলা, ঝুঁকিপূর্ণ প্রসব ইত্যাদিরও অন্যতম প্রধান কারণ অপ্রাপ্ত বয়সে মাতৃত্ব।
১৮ বছরের আগে বিয়ে হলে একজন নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসমাপ্ত রয়ে যায়। বিয়ের পর যে কয়জন নারী লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেন তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে ‘ঘরের বউ’কে স্কুলে বা কলেজে পাঠাতে কেউ রাজি হয় না। শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে হোস্টেলে রেখে বউকে পড়ানোর তো প্রশ্নই ওঠে না। সে কারণে অনেক মেধাবী ছাত্রীর শিক্ষাজীবন মাঝপথে থেমে যায়। যে মেয়েটি চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী বা কোনো অফিসের দক্ষ কর্মী হতে পারতো সে সংসারের চাকায় পিষ্ট হয়। দেশ ও সমাজ বঞ্চিত হয় তার অবদান থেকে। এতে অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশ।

 

১৮ বছরের আগে বিয়ে হলে একজন নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসমাপ্ত রয়ে যায়। বিয়ের পর যে কয়জন নারী লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেন তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে ‘ঘরের বউ’কে স্কুলে বা কলেজে পাঠাতে কেউ রাজি হয় না। শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে হোস্টেলে রেখে বউকে পড়ানোর তো প্রশ্নই ওঠে না।

 

আরেকটি বড় সমস্যা হলো যৌতুক। যতই আইন করে নিষিদ্ধ করা হোক না কেন ছদ্মবেশী যৌতুক এখনও প্রবলভাবেই আছে। ভাবতে অবাক লাগে যে বাবা অথবা ভাই বিয়ের সময় নারীর হবু স্বামীর হাতে নগদ টাকা থেকে শুরু করে আসবাবপত্র, গাড়ি বাড়ি এমন অনেক কিছুই দিচ্ছেন তিনি যদি সেগুলো না দিয়ে বরং মেয়েকে স্বাবলম্বী করার জন্য টাকাটা ব্যয় করতেন তাহলে কিন্তু টাকাটা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতো। যৌতুক দিয়ে কখনও নারীর বিবাহিত জীবনের সুখ নিশ্চিত করা যায় না বরং তার সমস্যাই বাড়ে। বিপরীতে একজন স্বাবলম্বী নারী নিজেও সুখে থাকতে পারেন পরিবারকেও সুখী করতে পারেন।

পৈতৃক সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকারও জেন্ডারবৈষম্য নিরসনে অন্যতম প্রধান বিষয়। অথচ মেয়ে পরের ঘরে চলে যাবে, জামাই সম্পত্তি ভোগ করবে এই অজুহাতে মেয়েকে ছেলের সমান সম্পত্তি দেওয়া হয় না। এজন্য পুরো সামাজিক ব্যবস্থার সংস্কার দরকার। ছেলে যেমন কর্মক্ষম হলে বাবা-মাকে ভরণপোষণ করতে পারেন তেমনি নারীও যদি স্বাবলম্বী হয়ে বাবা-মাকে ভরণপোষণ করেন এবং একই রকম দায়িত্ব পালন করেন তাহলে সম্পত্তিও সমান ভাগে ভাগ করতে কারও কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়।

মোট কথা সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার, ন্যায্য অধিকার এবং অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করার জন্য দরকার শিশু বয়স থেকেই তার পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পেশা, উত্তরাধিকার সব জায়গায় তার প্রতি সমমনোযোগ, সমবিনিয়োগ ও সমবন্টন।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।