হিজাব না পরায় চুল কেটে কি শিক্ষা দিলেন শিক্ষিকা?
জোর করে কাউকে দিয়ে ধর্মবিরোধী কাজ করানো মহাপাপ। জোর করে কাউকে দিয়ে ধর্মের কাজ করানোও কম অপরাধ নয়। ইসলাম ধর্মের প্রসঙ্গ এলে সরাসরি হজরত মোহাম্মদ সা. এর জীবনার্শের দিকে আমরা নজর দিতে পারি। তিনি কি জোর করে অমুসলিমদের ইসলাম গ্রহণ কিংবা পালনের কোনো উদাহরণ রেখে গেছেন?
আমি ধর্ম বিষয়ের পণ্ডিত নই। কিন্তু পণ্ডিত ব্যক্তিদের কাছ থেকেই জানতে পারি, রাসুল সা. এমন কাজটি করেননি। যে কারণে ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলা হয়। তাই ধর্ম বিরোধিতা করার জন্য যদি কাউকে জোর করা হয় এবং ধর্ম পালনের জন্য যদি কাউকে জোর করা হয় তাহলে এই দুয়ের একটিকেও কোনো ধর্মই স্বীকৃতি দেয় না। এটা আমার বিবেকবোধ থেকে বলছি। আর সেই কাজটি যদি কোনো স্বীকৃত স্কুলে হয়ে থাকে তাহলে তা দেশের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে হয়েছে তা স্পষ্ট বলা যায়।
এমন মন্তব্যই করা যায় মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার রাজানগর সৈয়দপুর আব্দুর রহমান স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ওই স্কুলের জীববিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষিকা রুনিয়া সরকার, সপ্তম শ্রেণির ৪ শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন ক্লাসের ভিতরে। তার দৃষ্টিতে এই শিক্ষার্থীরা হিজাব পরে ক্লাসে না আসাটা অপরাধ।
প্রধানশিক্ষক/অধ্যক্ষ বলেছেন রুনিয়া শিক্ষার্থীদের ভয় দেখানোর জন্য এই অন্যায় কাজটি করেছেন। অধ্যক্ষ মহোদয়ের বক্তব্য যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই শিক্ষিকা সরাসরি সরকারি নির্দেশনা অমান্য করেছেন। কারণ প্রচলিত আইন অনুযায়ী কোনো শিক্ষার্থীকে শারিরীক কিংবা মানসিকভাবে আঘাত করার সামান্যতম সুযোগও নেই। ফৌজদারি আইনে দণ্ডনীয় কাজ। এই প্রসঙ্গে সরকারি নির্দেশনার সূত্র উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিপত্র মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এহেন কাজকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে নির্দেশ করেছে।
এই বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ও আছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ২০১০ সালে করা একটি রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট বিভাগ থেকে কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয়। আদালতের নির্দেশনা সমূহ ছিলো- সরকারি কর্মচারী (শৃংখলা ও আপিল) রুলস ১৯৮৫-তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তির বিষয়টি অসাদচরণ হিসেবে অন্তুর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের বেত্রাঘাত করা, আটকে রাখা প্রহার করা, চুল কেটে দেয়া, শিকল দিয়ে আ্টকে রাখাসহ এই ধরণের শাস্তি অসাধাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।
নীতিমালার ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে -শিক্ষকরা ছাত্রীদের চুল ধরে টানতে বা কাটতে পারবে না।
‘মানসিক শাস্তি’ শিরোনামে বলা হয়েছে, শুধু শারীরিক শাস্তি নয় শিক্ষার্থীদের কোনোরুপ মানসিক শাস্তিও দেয়া যাবে না। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রী নিয়ে বাজে মন্তব্য করা যাবে না। এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের মা-বাবা, বংশ পরিচয়,গোত্র,ধর্ম,বর্ণ সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করা যাবে না। একইসঙ্গে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অশোভন অঙ্গভিঙ্গ বা এমন কোনো আচরণ করবেন না, যা তাদের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। যাদের ক্ষেত্রে ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা কার্যকর হবে না তাদের ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
আমরা প্রায়ই সংবাদে দেখি কোনো মাদ্রাসার শিক্ষার্থীকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে নির্যাতন করা হয় মাসের পর মাস,কিন্তু দেখি না এই অপরাধে কারো শাস্তি হয়েছে কি না। জানি না মুন্সীগঞ্জের ওই শিক্ষিকার পরিণতিও কি হবে। তবে এটা বলা যায়- এই ব্যাধি দূর করতে না পারলে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
মুন্সীগঞ্জের ওই শিক্ষিকা ইসলামের নামে যা করলেন তা ধর্মসম্মত নয়। তিনি হয়তো এটা জানেন,ইসলামে কোনো জোরজবরদস্তির স্থান নেই। কিন্তু সামাজিক শিক্ষা ও সামাজিক পরিবেশের কারণে তিনি সেই জোরজবরদস্তিরই আশ্রয় নিলেন। এই প্রসঙ্গে সময় নিউজ পোর্টালে ২৬ মে ২০২২ সালে প্রকাশিত ইসলামে জোর জবরদস্তির শিক্ষা নেই শিরোনামে মুফতী ফয়জুল্লাহ আমানের একটি নিবন্ধের প্রসঙ্গ আনা যায়। তাঁর লেখায় শুরুতেই তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘জোর করে কাউকে দিয়ে কোনো পাপ কাজ করানোর অপরাধ সম্পর্কে জানেন অনেকেই কিন্তু জোর করে নেকির কাজ করানোও যে অপরাধ সেটি হয়তো আমাদের সমাজের অধিকাংশেরই অজানা। আপনি অবশ্যই আপনার ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে পোশাক পরবেন। কিন্তু আপনি অন্য কোনো পুরুষ বা নারীকে কী আপনার পোশাক পরানোর জন্য জোর করতে পারেন?
আজকের মুসলিম সমাজের অনেকেরই ধারণা শরিয়াতের হুকুম মানানোর জন্য জবরদস্তির অবকাশ আছে। অথচ এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা’। তাঁর বক্তব্যের পক্ষে তিনি বলেছেন, ধর্মের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জবরদস্তি নেই। [সুরা বাকারা, আয়াত: ২৫৬]। এ ঘোষণার পর কোনো অস্পষ্টতা থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাদের সমাজে আজকাল গায়ের জোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠার এক মানসিকতা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। যেই লোকটা নিজে ঠিক মতো জুমার নামাজও পড়ে না তাকেও দেখা যায় অন্যদের পিটিয়ে ইসলামের পথে আনতে তৎপর। ধারালো ছোরা দিয়ে মানুষকে বুযুর্গ বানানোর বাসনা তাকে উত্তেজিত করে তোলে।’
মুন্সীগঞ্জের এই ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্তে কি বেরিয়ে আসবে জানা নেই। কিন্তু অধ্যক্ষ সাহেব যে মন্তব্য করেছেন তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনি বলেছেন, ওই শিক্ষিকা ছাত্রীদের ভয় দেখানোর জন্য এই কাজটি করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলাম পালনের জন্য এমন ভয় দেখানোর বিধান যে নেই সেই শিক্ষা ওই শিক্ষিকা পেয়েছেন কিনা।
একজন শিক্ষক তার প্রশিক্ষণকালে শিশুমনস্তত্ব সম্পর্কে শিক্ষা পেয়ে থাকেন, তাই ইসলামি বিধান না জানা থাকলেও শিশুমনস্তত্ব শিক্ষার সুবাদে তিনি জানার কথা- শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি কেমন আচরণ করতে পারবেন এবং কোনটা পারবেন না।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে উপভোগ্য করার সরকারি চেষ্টার পাশাপাশি যদি এমন নির্যাতন চলতে থাকে, তাহলে শিক্ষায়তন থেকে ঝরে পড়ার হার কমানো সম্ভব হবে না; কিশোর-তরুণদের শিক্ষাবিমুখ হওয়া এবং হতাশাগ্রস্থ হওয়া এমনকি মাদকাসক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
আমরা প্রায়ই সংবাদে দেখি কোনো মাদ্রাসার শিক্ষার্থীকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে নির্যাতন করা হয় মাসের পর মাস,কিন্তু দেখি না এই অপরাধে কারো শাস্তি হয়েছে কি না। জানি না মুন্সীগঞ্জের ওই শিক্ষিকার পরিণতিও কি হবে। তবে এটা বলা যায়- এই ব্যাধি দূর করতে না পারলে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
লেখক : সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস