লাগিয়ে পালে হাওয়া: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ অধিবেশনের পথ চলা
এ বছরের ৩০ জানুয়ারি শুরু হয়েছে বহুল কাঙ্খিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ এর পথ চলা। শুরুতেই সংবিধানের রীতি নীতি অনুযায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জাতীয় সংসদে তাঁর প্রথম ভাষণটি দিলেন। এই ভাষণ জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণ হলেও এটা যেন দেশবাসীরও মনের কথা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের বাংলাদেশকে চলতে হচ্ছে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে।
এদেশের গণতান্ত্রিক চর্চাকে বারবার বিঘ্নিত করার দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র বরাবরই তৎপর। এবারে নির্বাচন পূর্ববর্তী গত কয়েকমাস ধরে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এবং সরকারের বিরুদ্ধে লাগামহীন গুজব রটনা দেশে এক ধরনের বিপদের আশঙ্কা তৈরি করেছিল। নির্বাচনের দুইদিন আগে ঢাকায় বেনাপোল এক্সপ্রেস পুড়িয়ে দেওয়া প্রমাণ করে যে, দেশবিরোধী শক্তি কতটা তৎপর ও বেপরোয়া ছিল। এমনি অবস্থায় কোনোরকম সন্ত্রাস এবং বিতর্কিতবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশবাসীকে যেমন আশ্বস্ত করেছে, পাশাপাশি তেমনি বিশ্বের রাজনৈতিক মহলকে করেছে চমৎকৃত। এই ভোট থেকে একটা কথা বিশেষভাবেই প্রমাণ হয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। এই নির্বাচন ছিল রাষ্ট্রপতির জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্নিপরীক্ষা। তিনি দেশবাসীকে সাথে নিয়ে সেটা শতভাগ সফলভাবে উতরে গেছেন। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনী অনুষ্ঠানের সফলতার জন্য মহান জাতীয় সংসদের ভাষণে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যথার্থই বলেছেন, ‘দেশের গণতন্ত্রের জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন অত্যন্ত যুগান্তকারী ঘটনা, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় হয়েছে দেশের জনগণের, জয় হয়েছে গণতন্ত্রের।’
বলা বাহুল্য এই নির্বাচনের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে দেশবাসীর সাধারণ ইচ্ছা। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাঁর বক্তব্যে যথার্থই বলেছেন, “নির্বাচনকে ঘিরে একটি মহল সহিংসতা ও সংঘাতের সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের গণতন্ত্রবিরোধী ও সহিংস কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে জনগণকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখলেও গণতন্ত্রের শাণিত চেতনা ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সাধারণ মানুষের ব্যাপক আগ্রহ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সব পদক্ষেপ সার্থক হয়েছে। নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে।”
ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পরিহার করা উচিত। মহামান্য রাষ্ট্রপতি নেতিবাচক রাজনীতির এই অবাঞ্ছিত অবস্থার প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন- “ ষড়যন্ত্র করে কেউ যাতে জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কেউ যাতে আন্দোলনের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে মানুষের জানমাল ও জীবিকার ক্ষতিসাধন করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।” তিনি সরকারী দলকেও বিরোধী দলের প্রতি দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সরকারও এ ক্ষেত্রে সংযত আচরণ করবে, এটাই সবার প্রত্যাশা। মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার সার্থকতা এখানে নিহিত রয়েছে।
দেশের বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের কল্যাণে আওয়ামী লীগ সরকার যে অঙ্গীকারবদ্ধ – দ্বাদশ জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী ভাষণে একথা পুণরায় স্মরণ করিয়ে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন। সামাজিক সুরক্ষার প্রায় সবটাতেই গ্রামের প্রান্তিক মানুষ সুবিধা পাচ্ছে। মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, প্রতিবন্ধী এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ প্রান্তিক মানুষের জন্য বিভিন্ন ভাতা চালু হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মস‚চির আওতায় এখন প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ উপকৃত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়, বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে গত দেড় দশকে আর্থসামাজিক খাতসহ সব খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। এ জন্য দেশবাসীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনিও দেশের সাধারণ নাগরিকের মতো মনে করেন চলার পথে যে কোনও ধরনের বাধাই আসুক না কেন, জাতির আত্মবিশ্বাসের পথে তা কোনও অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারবে না। এজন্য তিনি বলতে সক্ষম হন একটি উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ অর্জন আমাদের লক্ষ্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পর পরবর্তী লক্ষ্য হলো স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মহান জাতীয় সংসদ জনগণের সব প্রত্যাশার ধারক ও বাহক। সংসদ সদস্যদের ইতিবাচক ভূমিকা দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আইনসভা সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। জনগণের বক্তব্য বা দাবি নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা আইনসভায় উপস্থাপনের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করতে পারে, যা গণতন্ত্রের জন্য, দেশের উন্নয়নের জন্য কল্যাণকর। রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে সেটাই প্রত্যাশা করেছেন।
সংসদে বিরোধী দলের গুরুত্ব ও ভূমিকা অপরিসীম। দেশের জনগণের অভাব, অভিযোগ, সুখ, দুঃখ, সুযোগ সুবিধা ও অসুবিধার কথা তুলে ধরাও বিরোধী দলের দায়িত্ব কর্তব্যেরই অংশ বিশেষ। দেশবাসী সব সময়ই একটি কার্যকর ও গতিশীল সংসদ দেখতে চায়। রাষ্ট্রপতির বক্তৃতাতেও গঠনমূলক বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির এই সতর্কবাণী কি তাদের চোখ খুলতে সহায়তা করবে? - এমন জিজ্ঞাসা দেশবাসীরও। এভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের সূচনালগ্নে তাঁর প্রথম ভাষণেই তিনি দেশবাসীকে সমগ্র জাতির উন্নতিতে আত্মনিয়োগের উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।
মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুসহ বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস চলে এসেছে। তাঁর ভাষণে তিনি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ জাতীয় চারনেতা এবং বাঙালি জাতির আন্দোলন সংগ্রামের তিন ব্যক্তিত্ব শেরে বাংলা একে ফজলুল হকসহ মওলানা ভাসানীসহ সকল বীর শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা সকলের প্রতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডে বঙ্গবন্ধু, মহীয়সী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদেরও তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ এবং তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। পচাত্তরের আগস্টের হত্যাকান্ডের বেদনার প্রতিফলন তাঁর ভাষণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ফুটে উঠেছে। তাইতো তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, “ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়। চরম ভায়োলেশন অব দি হিউমান রাইটস। এটা আনপ্রিসিটেনডেনট অব দি ওয়ার্ল্ড। যা এখনো এনডোর্স করা হয় নি।”
শীতের ঠান্ডা কুয়াশাচ্ছন্ন বিকেলে জাতীয় সংসদে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভাষণের সারাংশের শেষ পাঠে সকলকেই আবেগী করে তোলে। সেটা হলো রাষ্ট্রপতির অনুভূতি! অত্যন্ত আবেগভরা কন্ঠে রাষ্ট্রপতি বললেন- “ বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা। জাতি আপনার বেদনা জানে। আমি আপনার বেদনা জানি। আপনার প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে আপনি পা রেখেছেন মাত্র। পাড়ি দিতে হবে দুর্গম গিরি, কান্তার মরুপথ।” এই অনুভূতি শুধু রাষ্ট্রপতির নয়, সমগ্র দেশবাসীর। তাইতো রাষ্ট্রপতি বলেন, “যে জাতি ভাষার জন্য রক্ত দেয়, স্বাধীনতার জন্য বিসর্জন দেয় ত্রিশ লক্ষ প্রাণ, যে জাতি গণতন্ত্রের জন্য রাজপথ রঞ্জিত করে, অসীম ধৈর্যে অতিক্রম করে বন্ধুর পথ, সেই অমিত সম্ভাবনাময় জাতি নিশ্চয় পারবে সকল বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে বিশ্ব-দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে।” রাষ্ট্রপতির মতো আমরাও বলতে চাই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা গড়ে তুলতে পারব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। সেটাই হবে আগামীর বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ!
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জিকেএস