দুই বাংলায় নববর্ষ একদিনেই
চার বছর পর আবার দুই বাংলার বাঙালি হাজার বছরের প্রিয় পার্বণ পহেলা বৈশাখ এক দিনে উদযাপন করার সুযোগ পাচ্ছেন। ১৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বাংলা পঞ্জিকানুসারে বাংলা বছরের প্রথম দিন ১ বৈশাখ। আর সেদিনই অধিবর্ষ থাকায় ইংরেজি বছরের ১৪ এপ্রিল। প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর বাংলা ও ইংরেজি তারিখের মধ্যে ১৪ এপ্রিল এইভাবেই ‘পহেলা বৈশাখ’ হিসাবে মিলে যায়।
এবছর একদিনে দুই বাংলার এই উৎসব হলেও আগামী তিন বছর কিন্তু আগে-পরে এই উৎসবের সূচি নির্ধারণ হবে। বাংলাদেশের মতো কলকাতায় এই দিনটি উদযাপনে তেমন সাড়ম্বরতা না থাকলেও ঢাকার মতো বেশ কিছু জায়গায় মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন এপার বাংলার বাঙালি মনস্করা। মেগা সিটি কলকাতার চেয়ে জেলা শহর গুলোতে নববর্ষ উদযাপনের সাড়ম্বরতা চোখে পড়ে বেশি। শহর কলকাতায় এমনিতেই অবাঙালিদের দাপট। এর মধ্যে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারও আগের চেয়ে বহু গুণ বেড়েছে।
প্রয়াত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই বাংলা ভাষা বাঁচাও আন্দোলন এখন প্রায় স্তিমিত। কোনও তৎপরতা নেই। কলকাতায় এখন আতশকাঁচ দিয়ে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড খুঁজতে হবে। আর সেই শহরে বাঙালিদের প্রিয় এই উৎসব রক্তহীন শরীরের মতোই ফ্যাকাসে লাগবে, বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার এখন এই শহরে নির্বাচনী উত্তাপ। শুধু শহরে কেন, গোটা রাজ্যে চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারপ্রচারণা। তবে এটা ঠিক, কলকাতাতেই সবচেয়ে বেশি জিগির ভোটের। কেনই বা হবে না, তৃণমূল সভানেত্রী মমতা ব্যানার্জি কিংবা মমতার প্রতিদ্বন্দ্বি কংগ্রেস নেত্রী দীপাদাশ মুন্সি, তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে বহু হেভিওয়েট নেতা-নেত্রী কলকাতার বিভিন্ন আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিধানসভা নির্বাচনের পোস্টার ফেস্টুনেই কার্যত ঢাকা এখন প্রাচীন শহর কলকাতা। কলেজ স্ট্রিটের লেখা বাঙালির বর্ষবছরের ‘এসে হে বৈশাখ’ ব্যানার-পোস্টারও দেখা যাচ্ছে না রাজনৈতিক প্রচারপ্রচারণায়।
তবে কলেজ স্ট্রিট বই পাড়ায় এখনও বৈশাখের আমেজ পাওয়া যায় দেখেছি। সেখানে বই বিক্রেতা থেকে প্রকাশক-লেখকরাও মিলিত হন হালখাতার উৎসবে। কিছুদিন আগে কবি জয় গোস্মামীর সঙ্গে কথা হয়, তাকে বই পাড়ায় পহেলা বৈশাখ এবং ঢাকার মতো মঙ্গল শোভাযাত্রা না হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কবির মন্তব্য ছিল, আসলে ঢাকার মতোই বাঙালির আবেগ নেই কলকাতায়। এই শহরে অনেকভাষার মানুষের বসবাস, অনেক রীতিনীতি সংস্কৃতি। কলেজ স্ট্রিটে বই পাড়ায় হালখাতা হয়। সেখানে কিছুটা বাঙালির এই উৎসবের আমেজ আছে। হালখাতা অনুষ্ঠানে আমি যাই। ভাষা ও চেতনা সমিতির ইমানুল হক প্রায় এক দশক ধরে কলকাতা ছাড়াও জেলা শহরে বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। ১৪ এপ্রিল সকালে তারাও পান্তাভাতে লঙ্কা ডুবিয়ে বাংলা একাডেমির সামনে বর্ষবরণের আয়োজন করেছেন।
বাংলা ভাষার জন্য যে জাতি রক্ত দিয়েছে, শহীদ হয়েছেন রফিক-বরকত-সালাম-জব্বাররা। ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যে জাতি মায়ের ভাষার দাবিকে পুঁজি করে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে একটি দেশ পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা করেছে। বাঙালি ভূমিপুত্ররা যে মাটিতে রয়েছেন, সেই দেশে বাংলা বছরের সাড়ম্বরতা সৌধের মতোই পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
লেখক : ২০১০ সাল থেকে কলকাতা ব্যুরো প্রধান হিসাবে দৈনিক কালের কণ্ঠে কাজ করছেন। সময় টেলিভিশনে ভারতীয় খবরের পুরো দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ২০১১ সাল থেকে। সংবাদ প্রতিদিন, প্রথম আলো, মুক্তকণ্ঠ, একুশে টেলিভিশন ছাড়াও কলকাতার চ্যানেল টেন, সর্বভারতীয় সিএনএন-আইবিএন টেলিভিশনেও কাজ করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। ২০০৮ সাল থেকে ভারতীয় সাংবাদিক হিসাবে রেডিও টুডে-এর ভারতের রাজনীতির খবরা-খবরের বিশ্লেষণও শোনা যায় তাঁর কণ্ঠে। ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সাংবাদিকতা করছেন দুই দশকের বেশি সময় ধরে।
এইচআর/এমএস