জাতিসংঘে পুতুলের অভিষেক, অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ

তাপস হালদার
তাপস হালদার তাপস হালদার
প্রকাশিত: ১২:১৭ পিএম, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন বঙ্গবন্ধুর সু্যোগ্য দৌহিত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।গত ২৩ জানুয়ারি জেনেভায় অবস্থিত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সদরদপ্তরে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারনী ফোরামে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নিয়োগ চূড়ান্ত ভাবে অনুমোদন হয়।তাঁর হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেন সংস্থাটির মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস।তিনি অভিনন্দন বার্তায় বলেন,‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সদস্য রাষ্ট্রগুলো ও নির্বাহী বোর্ডের আপনার উপর আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে।প্রায় দুই বিলিয়ন জনসংখ্যার ১১ টি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হয়েছে।আপনার প্রতি আমার ও সদর দপ্তরে আমার সহকর্মীদের পূর্ণ সমর্থন ও বিশ্বাস রয়েছে। আমি আপনার সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছি।'

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সায়মা ওয়াজেদ পুতুলই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলেন।এবং তিনি প্রথম বাঙালি ও দ্বিতীয় নারী আঞ্চলিক প্রধান। শুধু বিশ্বস্বাস্থ্য নয়, জাতিসংঘের যেকোনো সংস্থার নীতি নির্ধারক পদে তিনিই প্রথম বাংলাদেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে সাময়া ওয়াজেদ পুতুলই প্রথম বাংলাদেশি।এর আগে বাংলাদেশ থেকে আর কেউ এমন পদে নির্বাচিত হননি কিংবা দায়িত্ব পালন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।কেননা এই অঞ্চলের দেড়শ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা জড়িত। এখানে বিশ্বের মোট ৩৫ শতাংশ জনগণ বাস করেন।এখন তিনি এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবায় কাজ করবেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হল জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত সংস্থা।১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র গুলোর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে।এটি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন দলের অংশ।প্রধান লক্ষ্য ‘সর্বোচ্চ সম্ভাব্য সকল মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।’সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত মূল সদরদপ্তর থেকে বিশ্বব্যাপী ছয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়।সংস্থাটি গুটিবসন্ত,পোলিও নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সাম্প্রতিক কালে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি মোকাবেলায় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।এছাড়া এইচআইভি,ইবোলা,ম্যালেরিয়া,যক্ষ্মা,হৃদরোগ,ক্যান্সার নির্মূলে কাজ করে যাচ্ছে।সংস্থাটি বাংলাদেশে অব্যাহত ভাবে ম্যালেরিয়া,যক্ষ্মা,কালাজ্বর,ফাইলেরিয়া,নিপাহ,বার্ড ফ্লু,মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে জয়ী হওয়ার প্রক্রিয়া সহজসাধ্য ছিল না।সম্পূর্ণ রুপে নিজের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।২০২৩ সালে ২১ এপ্রিল আঞ্চলিক পরিচালক পদের জন্য মনোনয়ন আহ্বান করা হয়।৪ আগস্ট ছিল জমা দেওয়ার শেষ দিন। ১৮ আগস্টের মধ্যে সকল সদস্য রাষ্ট্র গুলোর কাছে প্রার্থীদের তালিকা পাঠানো হয়। তারপর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সেক্রেটারিয়েট দ্বারা পরিচালিত একটি ওয়েব ফোরাম খোলা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সকল সদস্য রাষ্ট্র ও প্রার্থীদের জন্য ফোরামটি উন্মুক্ত রাখা হয়।এখানে সকল প্রার্থী তার লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে বিশ মিনিটের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।এবং কোনো বিষয়ে বক্তব্যে অস্পষ্টতা মনে হলে সদস্যরা প্রশ্ন করছেন এবং প্রার্থী উত্তর দিয়েছেন।তারপর গত ১ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ১১ টি সদস্য দেশের ভোটে ৮-২ ভোটের বিশাল ব্যবধানে তিনি নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশ,ভারত,নেপাল,ভুটান,উত্তরকোরিয়া,ইন্দোনেশিয়া,মালদ্বীপ,শ্রীলংকা,থাইল্যান্ড,তিমুর লেস্টে এই দশটি দেশ ভোট প্রদান করে।মিয়ানমার ভোট দানে বিরত থাকে।সাময়া ওয়াজেদ পুতুলের বিজয় মোটেও সহজ ছিল না।কারণ তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন নেপালের শম্ভু প্রসাদ আচার্য।যিনি প্রায় তিন দশক ধরে দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করা একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন।আবারও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় ভারত।দেশটির সমর্থন সাময়মা ওয়াজেদের বিজয় সহজ হয়ে যায়।

সায়মা ওয়াজেদের মনোনয়ন যথার্থ ছিল বলেই তিনি সদস্য দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন।কারণ তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছেন।তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।বিশেষত অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে সারা বিশ্বেই পরিচিত।তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মহাপরিচালকের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।সায়মা ওয়াজেদের মনোনয়ন নিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত চিকিৎসকদের অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট অমিত চক্রবর্তী বলেছিলেন,‘সায়মা ওয়াজেদ পুতুল লাইসেন্স প্রাপ্ত মনোবিজ্ঞানী এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক আইনজীবী।তাঁর মনোনয়ন নিয়ে যারা কথা বলছেন,তারা পক্ষপাতদুষ্ট।এর মধ্যে কোনও সারবত্তা নেই।উনি এই পদের সেরা চয়েস।তিনি যদি এই পদে আসেন তা হলে ডব্লিউএইচও আরও অনেক বেশি মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবেন।অতিমারির পরে বিশ্বজুড়ে ৩০ কোটি মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভুগছেন।তিনি দায়িত্ব পেলে এই বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারবেন।'

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।এবং ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজির উপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জন করেন।তিনি ২০১৩ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন।এর স্বীকৃতিস্বরূপ সংস্থাটি তাঁকে ‘ডব্লিউএইচও এক্সেলেন্স’ পুরস্কারে ভূষিত করে।বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের উদ্যোগে ২০১১ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় অটিজম বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন।গঠিত হয় ‘South Asian Autism Network(SAAN)’।ঢাকায় যার সদরদপ্তর করা হয়।তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে ‘নিউরোডেভলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি ট্রাস্ট অ্যাক্ট-২০১৩’ পাশ হয়।একসময় অটিস্টিক শিশুরা সমাজের বোঝা ছিল,সমাজে অবহেলিত ছিল।তারা বিড়ম্বনার শিকার হতো।বাবা-মা বাধ্য হয়ে তাদেরকে লুকিয়ে রাখতো।সাময়া ওয়াজেদের কল্যাণে অটিস্টিক শিশুরা সমাজের মূলস্রোতে লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।তিনি এক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটা বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছেন।শুধু বাংলাদেশ নয়,সারা বিশ্বের অটিস্টিক শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

সাময়া ওয়াজেদ পুতুল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।জলবায়ু ঝুঁকির ৪৮ টি দেশের জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ), যার চেয়ারম্যান বাংলাদেশ।জোটের দূত হিসেবে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে দূত হিসেবে আরও আছেন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদ কামাল,ফিলিপাইনের উপ-স্পীকার লেন লেগার্দা ও রিপাবলিক অব কঙ্গোর জলবায়ু পরিবর্তন প্রধান বিশেষজ্ঞ তোসি এমপানু।সিবিএফের চার দূত জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সদস্য দেশগুলোর জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজান্ট ফ্যাকাল্টি,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং স্পেশালিস্ট এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হিসেবে কাজ করছেন।

আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন,রুয়ান্ডায় কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের সভা,জাপানে নারী বিশ্ব সমাবেশ,স্কটল্যান্ড ও মিশরে কপ-২৬ ও কপ-২৭,শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের গোলটেবিল বৈঠক,কম্বোডিয়ায় গ্লোবাল চাইল্ড নিউট্রিশন ফোরাম,ভারতে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম,পর্তুগালে ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব সাইকিয়াট্রিস সহ বিশ্বের বড় বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য দিয়ে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নাতনি,ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার দেশরত্ন শেখ হাসিনার কন্যা হওয়া স্বত্ত্বেও তিনি পারিবারিক পরিচয়ের বাইরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।নিজের মেধা-মনন দিয়ে দেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে কাজ করে যাচ্ছেন। তথাকথিত রাজনীতির বাইরেও যে মানব কল্যাণ করা যায় তিনি সেটা করে দেখিয়েছেন। রাজনীতির অর্থ যদি হয় মানব কল্যাণ তাহলে সেই রাজনীতি তিনি নিরলস ভাবে করে যাচ্ছেন।জাতিসংঘের অন্যতম মর্যাদাবান সংগঠনের আঞ্চলিক পরিচালক হওয়ার গৌবর শুধু সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের একার নয়, এই অর্জন পুরো দেশের।পুতুলের অভিষেকের মধ্যদিয়ে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেল বাংলাদেশ।সায়মা ওয়াজেদের হাত ধরে শুধুমাত্র বাংলাদেশই নয়,দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্বাস্থ্য সেবায়ও ঘটবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।