নেশার বিষ যাদের হাতে নাম দিয়েছি পথশিশু


প্রকাশিত: ০২:১১ এএম, ০৭ এপ্রিল ২০১৬

কিছুদিন আগের কথা। সারাদিন অফিস ক্লান্তির পর বাড়ি ফিরছি। অফিস ফেরতা এসময়টা ঢাকা শহরে জ্যাম থাকবেই। গুলশান একের মোড়ের সিগন্যালে জ্যামে আটকে আছি। এই সিগন্যালে বসে থাকার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা সকলেই অবগত আছেন, গাড়ি দাঁড়ালেই ক্রমাগত কিছু ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইতে থাকবে। তারা এমন কি গাড়ির কাঁচেও টোকা দেয়। যেহেতু আমি ভিক্ষাবৃত্তিকে সমর্থন করিনা তাই সবাইকে টাকা, সাহায্যও দেইনা। কিন্তু তাকিয়ে দেখলাম একটি দশ এগারো বছর বয়সী ছেলে শিশু দাঁড়িয়ে আছে। করুণ মলিন মুখ। গায়ে পোশাক বলতে শুধু একটি ছিন্ন হাফপ্যান্ট।

আমি কি এক মায়ায় গাড়ির জানালা খুলি। ছেলেটি জানালো সে সারাদিন কিছু খায়নি, আমি যেন তাকে দুইটা টাকা দেই। আমি একটি বড় নোট তার হাতে তুলে দিলাম এবং সে সেটা নিয়ে দৌড়ে চলে গেল। আমি মন খারাপ করে বসে আছি। আমার গাড়ির ড্রাইভার কথা শুরু করলেন। তিনি আমাকে এক ভয়াবহ খবর শোনালেন। আমি তাকে ঘটনা প্রমাণ করতে বললাম। সিগন্যাল ছেড়ে দিলে ড্রাইভার ভাই গাড়ি ঘুড়িয়ে রাস্তার উল্টোদিকে রোড ডিভাইডার ধরে ধীরে গাড়ি চালাতে লাগলেন।

ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। নিয়নের স্বল্প আলোয় রোড ডিভাইডারের ওপর দশ থেকে তের চৌদ্দ বছর বয়সী পাঁচটি ছেলে বসে আছে। আহ্লাদ করে ওদের নাম দেয়া হয়েছে পথশিশু। প্রত্যেকের হাতে পলিথিন। পলিথিনের ভেতরে কিছু একটা আছে যা ঠিক দৃশ্যমান নয়। মাঝে মাঝেই সেই পলিথিনের ভেতর তারা নাকসহ মুখ ডুবিয়ে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অবস্থাদৃষ্ঠে মনে হতে পারে, শিশুগুলো পলিথিনের ভেতর বমি করছে। আসল ঘটনা হলো, এই পলিথিনের ভেতর আছে ডানডি। ডানডি মানে একধরনের নেশাজাতদ্রব্য।

ডানডি একটি লোকাল নাম। এর উপাদান জুতা, কাঠ, রাবার জোড়া দেয়ার গ্লু। আশি নব্বই টাকায় কিনতে পাওয়া যায় এক কৌটা গ্লু। ওরা দশ টাকায় কিছু পরিমাণ গ্লু কিনে পলিথিনের ব্যাগে ভরে নেয়। এই গ্লু ইনহেল করলে একধরনের কড়া নেশা হয়। দামে সস্তা এবং সহজলভ্যতার কারণে ডানডি এধরনের শিশুদের কাছে জনপ্রিয় এক নেশাদ্রব্য। শুধুমাত্র যে গুলশান এলাকায় এই দৃশ্য দেখতে পাবেন তা নয়। কারওয়ান বাজার, কমলাপুর রেলস্টেশন, রমনা পার্ক এলাকায় পথ শিশুদেরকে নেশাসক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ঘটনা যে প্রশাসনের অগোচরে ঘটছে তাও না। কিন্তু সব দেখেশুনেও সকলে নিশ্চুপ।

বাংলাদেশে ইউনিসেফসহ অনেক ধরনের দাতাসংস্থা শিশুদের নিয়ে কাজ করে। আমি নিজেও দীর্ঘদিন শিশুদের সাথে কাজ করেছি। ইউনিসেফের ২০০৫ এর পরিসংখ্যান অনুযাযী শুধু ঢাকা শহরে পথশিশুদের সংখা ২৪৯,২০০। দারিদ্র্, বাবা-মায়ের মধ্যে অনৈক্য, বহু ভাইবোন, থাকার জন্য এমনকি বস্তিতেও কোনো জায়গা না পাওয়ায় ওরা পথে থাকে। অনেকে পরিবারসহ জীবিকার অন্বেষণে শহরে আসে। কিছুদিন অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করে টিকতে না পেরে পথে নেমে আসে। এইসব শিশুদের জন্য বিভিন্ন নীতিমালা প্রণিত হয়েছে। বড় বড় সভা সমিতি, সেমিনার হয়েছে। বাস্তবে ওদের অবস্থা তথৈবচ।

সারাদিন পথে পথে ভিক্ষা করে অথবা নীতিমালা বহির্ভূত কোনো শ্রমের সাথে জড়িত। কেউবা ব্যবহৃত হচ্ছে মাদকদ্রব্য বিক্রির কাজে। আবার কেউ নিজ স্বার্থে এদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক কাজে লাগাচ্ছে। শিক্ষার সুবিধা বঞ্চিত এইসব শিশুরা নিজেরা নিজেরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে থাকে। খাবার ভাগ করে খায়। লড়াই ঝগড়া করে, সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে। সন্ধ্যার পর নেশা করে আর রাতে রাস্তার আইল্যান্ড অথবা কোনো ঝলমলে শপিং মলের বাইরে শক্ত কংক্রিটের ওপর ঘুমিয়ে থাকে। স্কুলে যাওয়ার বাহুল্য তাদের কল্পনার বাইরে। ওরা পৃথিবীতে আসে অসুস্থ পরিবেশে। বেড়ে ওঠে অসুস্থ পরিবেশে। পরিণামে অবশ্যম্ভাবীভাবে জন্ম নেয় এক অসুস্থ জাতি।

আপনি যখন আপনার আদরের শিশুটিকে খাওয়ানোর বিজ্ঞাপন দেখে দেখে আকর্ষণীয় পণ্যটি কিনে দিচ্ছেন, তখন কোনো এক খাবারের দোকানের সামনে একটি অর্ধ উলঙ্গ শিশু উচ্ছিষ্ট খাবারটির জন্য আপনার পায়ে গড়াবে। জগতে মানবজাতিকে বলা হয় “আশরাফুল মাখলুকাত” অর্থাৎ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। এই শ্রেষ্ঠ জীবশিশুটি ময়লার ভাগাড়ে কুকুরের পাশাপাশি খাবার অন্বেষণ করে। উচ্চবিত্ত ঘরের শিশুটি যখন ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যায় তখন সেই শিশুটি তার ছোট্ট কাঁধে শ্রমের বোঝা বয়। রাতে ডানডি সমৃদ্ধ পলিথিনে মুখ ডুবিয়ে ফুলের মতো কোমল ফুসফুসে বিষগ্রহণ করে তার জীবনটাকে নিঃশেষ করে দেয়। আমরা শিশুদের জন্য ফুলের বাগানের মতো পৃথিবী চাই। আমি সেদিন সন্ধ্যার আধাঁরী আধাঁরী আলোতে যে দৃশ্য দেখলাম সেটাই কি সাজানো বাগান?

শুধু নথিপত্রে নয়। কেতাবে লেখা দলিল নয়, বাস্তবিকভাবেই চাই শিশুর উপযোগী পরিবেশ। প্রতিটি শিশুর জন্য বাসযোগ্য একটি আগামীর স্বপ্ন দেখি। ক্ষুধা দারিদ্র এবং নেশাবিহীন এক সুন্দর আগামীর।

লেখক : গল্পকার, মানবাধিকারকর্মী

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।