এটাই কি সভ্যতা?


প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ০৬ এপ্রিল ২০১৬

সভ্যতার ইতিহাস, অভিবাসনের ইতিহাস। অভিবাসীরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে সভ্যতা ও সংস্কৃতির আদান প্রদানেও ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। যদি এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিবাসীরা না যায় তাহলে এক সময় আমাদের সভ্যতাই তো থেমে যাবে। দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে সভ্যতা-সংস্কৃতিরও কোনো বিকাশ ঘটবে না। অথচ ইউরোপজুড়ে অভিবাসীরা এখন অপাঙতেয়। জোর করে তাদের দেশে পাঠানো হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতা-সংস্কৃতির চরম উৎকর্ষের এই যুগে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কতোটা মানবিক সঙ্গত কারণেই এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এটা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিশ্ব বিবেককে তাই এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।   

মানবাধিকারকর্মীদের সমালোচনার মুখেই গ্রিস থেকে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ইইউ এবং তুরস্কের মধ্যে চুক্তির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো শুরু হয়েছে। ইউরোপের অবৈধ এবং অনিয়মিত অভিবাসীদেরও ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এসব অভিবাসীরা বিভিন্ন দেশের নাগরিক। এদের মধ্যে বহু বাংলাদেশি রয়েছে। এই সংখ্যা আনুমানিক ৮০ হাজার। অর্থাৎ ১ লাখের কাছাকাছি।

অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করতে এবং অবৈধভাবে ইউরোপে অবস্থানরতদের ফিরিয়ে আনতে  বাংলাদেশ সরকার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছে। কিন্তু একসঙ্গে এত মানুষকে দেশে ফেরত পাঠালে তাদের পরিবার এবং অর্থনীতির ওপর অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের পুনর্বাসনে সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু ইইউয়ের এই আশ্বাসের পরেও অভিবাসীদের পুনর্বাসন নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। আর পেছনেও যথেষ্ট কারণও রয়েছে।

বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে আমরা মোটামুটি ভালোভাবে অবগত। আমাদের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান দেশের মোট জনগণের তুলনায় মোটেও সন্তোষজনক নয়। আমরা এখনও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাহায্য ছাড়া চলতে পারি না। সব দিক দিয়ে আমরা এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।

বহু তরুণ, কারো স্বামী, কারো ভাই, কারো বাবা বা কারো সন্তান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। এদেশের একটা বড় অংশ ইউরোপে কর্মসংস্থানের জন্য রয়েছেন। তারা দিন রাত পরিশ্রম করে আমাদের জন্য টাকা পাঠান। ইউরোপের বহু দেশে বাংলাদেশিরা কর্মরত। ইউরোপে বাংলাদেশ থেকে বেশিরভাগই বৈধভাবেই গিয়েছেন। কিন্তু ওখানে গিয়ে তারা অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তবে বিষয়টা এমন নয় যে তারা অবৈধভাবে কাগজপত্র ছাড়াই সেখানে গেছেন। অনেকেই সেখানে স্থায়ী হওয়ার প্রতীক্ষায় রয়েছেন। কিন্তু এখন হুট করেই যদি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা অবৈধ এবং অনিয়মিত অভিবাসীদের ফেরত পাঠাবে সেটা হবে খূবই অমানবিক। প্রয়োজনের সময় তাদের মেধাশ্রম কাজে লাগিয়ে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের ছুঁড়ে ফেলা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিদেশে যাওয়া ব্যক্তিটিই হয়তো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার আয়ের ওপরই পরিবারের সব কিছু নির্ভর করে। জমিজমা বিক্রি করে বা বড় অংকের টাকা ধার নিয়ে অনেকেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তারা সেখানে গিয়ে পরিবারের দায়িত্ব নেন আবার একই সঙ্গে দায় পরিশোধ করেন। এ সম্পর্কে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ফর দা রাইটস অফ ইমিগ্রান্টসের কর্মকর্তা সাইফুল হক বলেন, এক সঙ্গে এত মানুষ বেকার অবস্থায় বাংলাদেশে ফিরে এলে অর্থনীতিতে খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের পরিবারগুলো। এদের মধ্যে অনেকেই দশ থেকে পনেরো বছর ধরে ইউরোপে আছেন। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন নিয়মিত হওয়ার জন্য। এখানে সরকারের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। রিটার্নিদের ইস্যু প্রবাসী নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

তাদের পুনর্বাসনে কিংবা কাজের সুযোগ তৈরিতে সরকারের দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারের এধরনের রিটার্নিদের বিষয়ে নীতিমালা থাকলেও এখনো কোনও কার্যকর ভূমিকা নেয়া হয়নি। পুনর্বাসনের বিষয়টি তো পরের বিষয় সবচয়ে ভালো হয় যদি ‘অবৈধ’দের বৈধ করে সেখানেই রেখে দেওয়া হয়। সরকার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বল্পমূল্যে অভিবাসীদের শ্রম এতদিন ঠিকই ব্যবহার করেছে ইউরোপের দেশগুলো। যারা অনেকদিন ধরে ইউরোপে আছেন এবং শ্রম দিয়ে অবদান রাখছেন তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের পদক্ষেপ মানবাধিকার লঙ্ঘন বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ইউরোপে যারা রয়েছেন তাদের বেশিরভাগই ছাত্র বা কাজের ভিসায় সেখানে গিয়েছেন। তারা নিয়মিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। তবে তাদের ‘অবৈধ’ বলা যাবে না। তারা সেসব দেশ থেকে শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করেছে। এক কথায় বলা যায় এদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শ্রম দিচ্ছে তারা বিভিন্ন দেশে। তাদের এই শ্রমের কি কোনো মূল্যই নেই?

এতোসংখ্যক বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হলে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু তাই নয় সামাজিক ও মানসিক ক্ষেত্রেও তারা হীনমন্যতায় পড়বে। আমাদের দেশের অর্থনীতিতেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। বৈদেশিক আয়ের একটা বড় অংশ বন্ধ হয়ে যাবে। দেশে শিক্ষিত জনগণের মধ্যে অর্ধেকই বেকার। বিশাল আকারের এই বেকার জনগোষ্ঠীদের নিয়ে এমনিতেই চাপের মুখে রয়েছে সরকার। এর মধ্যে বিদেশ থেকে আরো মানুষ বেকার অবস্থায় দেশে ফিরে আসলে তা কর্মসংস্থানের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে। দেশে যে পরিমান কর্মসংস্থান প্রয়োজন তা তৈরি করতেই হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। আরো একটা বিশাল জনগোষ্ঠী এর মধ্যে যুক্ত হলে তা সত্যিই খুব ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে।

অভিবাসীরা যেসব দেশে যাচ্ছে সেসব দেশের অর্থনীতিতেও তাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তাদের পরিশ্রমেই সভ্যতার ক্রমবিকাশ হচ্ছে। স্বল্পমূল্যে অভিবাসীদের শ্রম কাজে লাগিয়ে এখন এদেরকেই দেশে ফেরত পাঠাতে চাইছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপের দেশগুলোকে আমরা বরাবরই সভ্য জাতি বলে উল্লেখ করি। তাহলে এটাই কি তাদের সভ্যতা? এই অমানবিক কাজে তাদের সভ্যতার ভিত কি একটুও নড়বে না?

লেখক : সাংবাদিক

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।