‘ক্রসফায়ার’ ভারত ও বাংলাদেশ
আজ থেকে ২৫ বছর আগে ১৯৯১ সালের ১২ জুলাই উত্তর প্রদেশের পিলিভিতে একটি বিলাসবহুল বাস থামায় পুলিশের একটি দল। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বাসটি শিখ তীর্থযাত্রীতে পূর্ণ ছিল। কয়েকটি পরিবারের নারী ও শিশুদের রেখে ১০ পুরুষ যাত্রীকে বাস থেকে নামতে বাধ্য করে পুলিশ। ঘটনাস্থলে আরো পুলিশ এসে যোগ দেয়ার পর তারা ওই ১০ জনকে কয়েকটি দলে ভাগ করে। এরপর তাদের জঙ্গলে আলাদা আলাদা জায়গায় নিয়ে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। ঘটনার পর পুলিশ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিবৃতিতে দাবি করে, নিহত শিখেরা চরমপন্থি এবং ঘটনার সময় সশস্ত্র অবস্থায় ছিল। বিবৃতিতে, ‘এনকাউন্টারে’ খালিস্তানপন্থি ১০ সন্ত্রাসী নিহত হয়েছেন বলে দাবি করে পুলিশ। এসব ‘সন্ত্রাসীর’ বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ছিল বলেও দাবি করা হয়।
ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে সিবিআই মামলাটির তদন্ত করে জানায়, পুরস্কার অর্জন ও ‘সন্ত্রাসী’ হত্যার কৃতিত্ব জাহির করাই ছিল এই খুনের উদ্দেশ্য। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৫৭ জন পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ১০ জন রায় ঘোষণার আগেই মারা যান। গত শুক্রবার অপর ৪৭ জনকে ভারতের বিশেষ একটি আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে।
এই উপমহাদেশে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম ক্রসফায়ার বা তাদের ভাষায় এনকাউন্টারে হত্যার সংস্কৃতি শুরু হয়। চরমপন্থি নকশাল দমনে কলকাতা পুলিশ ক্রসফায়ারের নামে হত্যা শুরু করে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা নামে এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে! সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে এমন তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে প্রায় দুশ মানুষ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পরেই ভারতীয় পুলিশের মত এদেশেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বিবৃতি বা বিজ্ঞপ্তিতে জানায় নিহতরা সন্ত্রাসী, তাদের নামে ফৌজদারি মামলা আছে।
ক্রসফায়ারে এসব হত্যাকাণ্ড এক ধরনের সামাজিক বৈধতাও পেয়েছে। দিনের পর দিন যখন কোন সন্ত্রাসীর বিচার হয় না, বা কোনো সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে আদালত কোনো সাক্ষ্য না পেয়ে তাকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয় তখন সাধারণ মানুষ বা ভুক্তভোগী ক্রসফায়ারকেই সমর্থন জানায়। সাধারণ মানুষ চায় তাৎক্ষণিক ফলাফল। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় প্রতিদিনই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই চলেছে। আর যখনই এ নিয়ে সমালোচনা একটু বেশি হয় তখন দেখা যায় গুমের ঘটনা বেড়ে গেছে।
গুটি কয়েক সামাজিক সন্ত্রাসীকে বিচারের আওতায় না এনে হত্যা করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমানো গেছে কিনা এ নিয়ে গবেষণা হতে পারে। যদি ক্রসফায়ারই সমাধান হতো তাহলে দিনের পর দিন ক্রসফায়ার করতে হতো না। অর্থাৎ নতুন করে সন্ত্রাসী সৃষ্টি হতো না। যেদেশে অন্যায় অবিচার, সামাজিক বৈষম্য থাকবে সেদেশে অপরাধও থাকবে। আর সেদেশটি যদি সভ্য হয় তাহলে থাকবে বিচার ব্যবস্থা। ক্রসফায়ার সেই বিচার ব্যবস্থাকেই অস্বীকার করে চলেছে বছরের পর বছর ধরে।
বাংলাদেশের রাজনীতি যদি সঠিক পথে চলে তাহলে ওই সামাজিক সন্ত্রাসীরা কোনোভাবেই টিকে থাকার কথা নয়। তাদের গডফাদার যদি না থাকে তাহলে তাদের অস্তিত্ব বিলীন হতে বাধ্য। এটা সত্য যে রাজনৈতিক শক্তিই ওইসব সন্ত্রাসীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়। তাদের বিচার করা যায় না বলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ক্রসফায়ার প্রথা চালু করেছে। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে কথিত চরমপন্থিদের দমন করে তারা ‘সফলতা’ও দেখিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য দেশের সবচেয়ে বড় হুমকি হলো জঙ্গি গোষ্ঠী। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো জঙ্গিকে ক্রসফায়ার করার কথা ভাবেও না। সামাজিক বা রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের বিচার করে শাস্তি দেয়া যায় না বলে অজুহাতে ক্রসফায়ার করা যায় কিন্তু জঙ্গিরাও জামিনে বের হয়ে আবারো একই অপরাধ করে গেলেও তাদের ক্ষেত্রে বিচারবহির্ভূত ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এর কারণ নিয়েও গবেষণা হতে পারে।
এবার দেখা যাক, বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের আইনী সুবিধা কতোটুকু দেয়া আছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, আইনের চোখে সকল নাগরিক সমান এবং প্রত্যেকে আইনের সমান সুযোগ পাবেন। অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে-কোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ বলছে, গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁর মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শের ও তাঁর দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না। অনুচ্ছেদ ৩৫ এর ৩ অনুযায়ী ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হবেন।
প্রতিদিন দেশে যে ক্রসফায়ারের ঘটনা চলছে তাতে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় রাষ্ট্র বা সরকারই সংবিধান লঙ্ঘন করে চলেছে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালত নানা সময় ক্রসফায়ারে হত্যা বন্ধে নানা রুল ইস্যু করেছে। ক্রসফায়ারের নামে হত্যা কেন বন্ধ হবে না তা জানতে চেয়ে সরকারকে কারণ দর্শাতেও বলেছে কয়েকবার। এখন পর্যন্ত একটিরও চূড়ান্ত শুনানি শেষ হয়নি।
কথা হলো ভারতের পুলিশ যারা এই উপমহাদেশে ক্রসফায়ারের সূচনা করেছিল তাদেরই ৪৭ জন আজ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত, বাংলাদেশের ক্রসফায়ারের কুশীলবদের কী কখনো বিচারের মুখোমুখি হতে হবে? ভারত অপেক্ষা করেছে ২৫ বছর, বাংলাদেশ কতো বছর অপেক্ষা করবে?
এইচআর/এমএস