ভোট বর্জন মানেই কি নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি?
বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল। যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একই দল বার বার ক্ষমতায় আসে, সেটিও অগণতান্ত্রিক নয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর কিংবা প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোটই একমাত্র পন্থা। এটি সাধারণ নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার। যখন কেন ব্যক্তি বা দলের কারণে কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, তখন সেখানে সাধারণ নাগরিকদের এই সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুণ্ণ হয়।
দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনই অংশগ্রহণমূলক হওয়া জরুরী। যেহেতু আমাদের সংবিধানে বলা নেই যে, ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে। সেখানে কোনো একটি নির্বাচনে যদি ১০-২০ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়, তারপরও ওই নির্বাচনকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই। ওই সামান্য সংখ্যক ভোট পেয়ে যিনি নির্বাচিত হয়েছেন, তাকেও অবৈধ বলা যাবে না।
আমাদের দেশে নির্বাচনী মাঠে প্রতিপক্ষকে দমন-নিপীড়ন করার ঐতিহ্য বহুকালের। আইয়ুব খানের আমল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বিরোধীপক্ষের কর্মীদের তুমুলভাবে দমন-নিপীড়ন করা হয়েছিল। ফলে ভোটের মাঠে নিজেদের কর্তৃত্ব রাখার পথ সুগম হয়েছিল।
আইয়ুব খানের সৃষ্টি মৌলিক গণতন্ত্রীরাই তৎকালীন দুই পাকিস্তানে ভোট দিয়েছিলেন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি এবং পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় আইয়ুব খানের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। এতে ভীষণ রকম খেপে গিয়েছিলেন আইয়ুব খান। করাচির বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ইত্যাদি চালানো হয়েছিল স্বয়ং আইয়ুব খানের ছেলে গওহর আইয়ুবের নেতৃত্বে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার জনকও মনে করা হয় আইয়ুব খানকে। খুবই অবাক করা বিষয় হলো, সে সময় যদি সম্মিলিত বিরোধী দলের ঐক্য বজায় থাকত, তাহলে আইয়ুব খানের প্রতি অনাস্থার বিষয়টি সহজেই প্রমাণিত হতে পারত বলে অনেকে মনে করেন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, তাতে জনগণের ভোট দেওয়ার পথ সুগম হয়। এবার আর মৌলিক গণতন্ত্রীরা ভোট দেননি; বরং সাধারণ জনগণ তার নিজের ভোট প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। ইদানীং কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, সেই নির্বাচনেও কারচুপি হয়েছিল। এই হঠাৎ ‘হয়ে ওঠা’বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচন-পরবর্তীকালে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, এ রকম অভিযোগ কোনো পক্ষ থেকেই করা হয়নি। নির্বাচনের ফলাফল এ রকম হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল এই, জাতি তত দিনে ঠিক করে ফেলেছিল, কে হবে তাদের মূল নেতা।
ঐ সময় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে ভাসানী ন্যাপ যে দোদুল্যমানতার পরিচয় দিয়েছে, সেখানেও ভাসানী-ইয়াহিয়ার মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন উঠেছিল তখন। আওয়ামী লীগ ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানে ভাসানী ন্যাপের জনপ্রিয়তা ছিল। কেন তারা নির্বাচনে অংশ নিলো না, তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার।
১৯৭৩ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল তাতেও কারচুপির বেশকিছু ঘটনা ঘটেছিল বলে লেখালেখি হয়েছে। জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন বিরোধী দলকে একশর মতো আসন ছেড়ে দিতে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল সংসদে বিরোধীদের প্রায় ঠাঁই নেই বললেই চলে। সে সময় গণতন্ত্র পাকা-পোক্ত করার একটি সুযোগ সৃষ্টি হতে পারত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার মাধ্যমে। কিন্তু সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা, সরকারের পিঠে ছুরি মারার মতো ষড়যন্ত্র ইত্যাদির মিশেলে যে নির্বাচন হয়েছে, তা যে খুব গণতান্ত্রিক উপায়ে হয়েছিল, সেটাও বলা যাবে না।
খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ৮২ দিন। এই সময়কালে তিনি দেশের পাকিস্তানীকরণের লক্ষে যে দুটি বড় কাজ করেছিলেন, তার একটি হলো জেল হত্যা এবং অপরটি হলো ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচার করা যাবে না, এই মর্মে ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তির অধ্যাদেশ জারি করা। এরপর বেশ কিছু ঘটনার মধ্যদিয়ে একসময় জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসীন হন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো তাঁর চারপাশে কোনো ফাঁক-ফোকর রাখেনি।
তিনি সে সময় ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, ছিলেন সেনাপ্রধান, ছিলেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ; অর্থাৎ মোট চারটি গুরুত্বপূর্ণ পথ দখল করে রাখলেন তিনি। ১৯৭৭ সালের মে মাসে তিনি আন্তর্জাতিক অনুমোদনের জন্য একটি গণভোটের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই গণভোটে তিনি পেয়েছিলেন শতকরা ৯৮.৯ ভাগ ভোট। এটা যে স্বয়ং জিয়াউর রহমানের জন্য বিব্রতকর ছিল সে কথা বলার অপেক্ষায় রাখে না।
কর্মকর্তাদের বলা হয়েছিল ভোট দাতার সংখ্যা যেন মোট ভোট দাতার শতকরা ৭০ ভাগের বেশি না হয়। কিন্তু অতি উৎসাহী কর্মকর্তারা নিজেদের উৎসাহ এবং দক্ষতা প্রমাণ করার জন্য ভেলকি দেখিয়েছিলেন। শতকরা ৮৮.৫ ভাগ ভোট পড়েছিল এই সুপরিকল্পিত নির্বাচনে।
১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ওসমানীকে দেওয়া হয় ২১.৭ ভাগ ভোট আর জিয়াউর রহমানের ভাগে পড়ে ৭৬.৭ ভাগ ভোট। কারচুপি হয়েছিল কি না, সে কথা না বলে আমরা বরং বলতে পারি ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছিল বিকেল ৫টায়, আর কেরানীগঞ্জের একটি ভোটকেন্দ্রের ফলাফল বেতারে প্রচারিত হয়েছিল সাড়ে ৫টার আগেই।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, তিনি যে গণভোটের আয়োজন করেছিলেন, তার সঙ্গে আইয়ুব খানের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার যথেষ্ট মিল আছে। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি আইয়ুব খানের দেখানো পথ ধরে হেঁটেছেন। বঙ্গবন্ধুর সমাজবাদী অর্থনীতির পরিবর্তে তিনি ব্যক্তি মালিকানা বা ফ্রি এন্টারপ্রাইজের জয়গান করলেন। সত্যিকার অর্থেই এ দেশে নির্বাচন নামক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জিয়াই নষ্ট করেছেন।
১৯৭৯ সালে জিয়া একটি সংসদ নির্বাচন আয়োজন করেছিলেন। সেই নির্বাচনের ফল তাৎক্ষণিক প্রচার না করে পরদিন প্রচার করে জানিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে ‘জয়ী’ হয়েছে। ১৯৮৮ সালে দেশের দ্বিতীয় সেনাশাসক জেনারেল এরশাদ সংসদ নির্বাচন করেছিলেন, যা দেশের সব বিরোধী দল বর্জন করেছিল।
এরশাদ তাঁর স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা এমনভাবে চালিয়েছিলেন যে তাঁর আমলে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এরশাদ-পরবর্তী গণতন্ত্রের যুগে বিএনপি আমলের একটি নির্বাচনের উল্লেখ না করলেই নয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির সেই নির্বাচন প্রমাণ করেছে, কারচুপির সুযোগ পেলে বিএনপি তা হাতছাড়া করে না। সেই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ২১ শতাংশ। বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে ২৭৮টি আসন লাভ করেছিল। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচন বর্জন করেছিল।
বিগত ২০১৪ সালের মতো দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করার সেই মানসিকতা এবং অপচেষ্টা বিএনপির এখনো চলমান রয়েছে। আসন্ন ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনেও একই ধারায় বিএনপি অংশগ্রহণ থেকে বিরত আছে এবং পুনরায় অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতা করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধনসহ জনজীবন বিপন্ন করার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে।
রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে ব্যর্থ হয়ে, পরবর্তী সময়ে দেশের জনগণকে ভোট বর্জন ও দূরদৃষ্টিহীন হাস্যকর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। বিএনপির এসব নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জনসমর্থন মেলেনি এবং অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি এখন যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন ও দিশাহারা।
অথচ সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে ভোটারদের নির্বিঘ্ন উপস্থিতিতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০২৪ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার ক্ষেত্রে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
বর্তমান বাংলাদেশের আইনি কাঠামো অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে সুষ্ঠু নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য বদ্ধপরিকর এবং তারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটা আদর্শ নির্বাচনের নজির স্থাপন করতে চাইছে। সেই মোতাবেক নির্বাচন কমিশন সচেষ্ট ও যথাযথ ভূমিকা রেখে চলেছে।
নির্বাচন কমিশন কতটা সাহসী ভূমিকা পালন করছে, তা দেখছে দেশবাসী, সারা বিশ্ব। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছু আশার আলো দেখছি। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপগুলো ছিল নিরপেক্ষ ও নির্মোহ। বিশেষ করে ওসি, ইউএনও, ডিসি-এসপি বদল করে কমিশন প্রশংসিত হয়েছে।
নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘনকারী যেই হোক না কেন, তাকে কারণ দর্শানো হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের এ অবস্থানে সাধারণ মানুষ খুশি। ফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যারা প্রার্থী হয়েছেন তারাও সাহস পাচ্ছেন।
পলায়নপর ভোট বর্জনকারী বিএনপি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট কাজে লাগাতে চেয়েছিল। ভেবেছিল তাদের অনুপস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০২৪ অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দিতামূলক হবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন গণতান্ত্রিক অবস্থানের কারণে সবকিছু আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ফলে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ভোটের মাঠ এখন উৎসবমুখর এবং নির্বাচন অবাধ ও প্রতিদ্বন্দিতামূলক হতে যাচ্ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনীতিতে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ও ধারাবাহিকভাবে নেতিবাচক অবস্থানের কারণে বিএনপির অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন। তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো এখন জনসম্পৃক্ততাহীন প্রমাণিত হয়েছে। তাই আগামী ৭ই জানুয়ারি যে নির্বাচন আসছে, তাতে কোন দল অংশ নিলো আর কোন দল নিলো না, সেটা সাধারণ জনগণের জীবনে কোন প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয়না। কাজেই গনপ্রত্যাখিত বিএনপির ভোট বর্জনের ফলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি, বর্তমান সময়ে এমন কথা বলার সুযোগ নেই।
লেখক: প্রক্টর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
এইচআর/জিকেএস