বর্ষবরণের দিন কার্ফ্যু নেই!


প্রকাশিত: ০৩:৪৫ এএম, ০৫ এপ্রিল ২০১৬

এক দেশে ছিল এক রাজা, বিশাল রাজ্যে তার অভাব নেই কোনো কিছুর, একদিন রাজা গেলেন বাগানে বেড়াতে। হঠাৎ একটি গাছের ফল পড়লো রাজার মাথায়। আর অমনি রাজা রেগেমেগে আদেশ দিলেন ‘এক্ষুণি গাছটি কেটে ফেলো’। রাজার আদেশ অমান্য করে সাধ্য কার।

কিছুদিন পরের কথা, একটি বৃস্টিস্নাত বিকেলে রাজা চললেন রাজ্য ঘুরে দেখতে। যে ঘোড়ায় চেপে রাজা সফর শুরু করেছেন, সে ঘোড়া যেন চলতেই পারছে না। রাজা প্রশ্ন করলেন ঘোড়ার কী হয়েছে? এত ধীরে চলছে কেন? রাজার উজির সবিনয়ে জানালেন ‘আপনার প্রিয় ঘোড়াটি পায়ে আঘাত পেয়েছে, তাই এতো ধীরে চলছে’। একথা শুনেই ক্ষেপে উঠলেন রাজা। ‘ঘোড়ার এতো সাহস? আঘাতের অজুহাতে ধীরে চলে? এক্ষুণি ঘোড়ার পা গুলো কেটে ফেলো।‘ যেই বলা সেই কাজ, রাজার প্রিয় ঘোড়াটি ছাড় পেল না রাজার ক্রোধ থেকে।

এর বেশ কিছুদিন পরের কথা। বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন রাজা। দাস-দাসী তাঁর সেবায় অস্থির হয়ে নিয়োজিত। কিন্তু কিছুতেই রাজার মাথার যন্ত্রণা যাচ্ছে না। রাজা হুকুম দিলেন, ‘কে কোথায় আছ, আমার মাথাটি কেটে ফেলো।` নির্বোধ রাজা কখনোই খুঁজেনি কোনো সমাধানের পথ। অথচ সহজ উপায় ছিল প্রতি ক্ষেত্রে। নিজের অযৌক্তিক রাগ, ক্ষোভ আর বোকামিতে শেষে প্রাণটাই দিতে হলো রাজার।

এবার পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হবে বিকেল পাঁচটার মধ্যে। তাছাড়া ভুভুজেলা, বাঁশি, মুখোশ পড়া, ইত্যাদি ব্যবহারেও আনা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ভুভুজেলার ভুতুরে উপদ্রব থেকে মুক্তির পথ খোঁজায় সরকারকে সাধুবাদ জানাতে হয়। কিন্তু শতবর্ষের ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতির অনন্য প্রকাশ, প্রাণের আয়োজন বাংলা নতুন বর্ষ বরণের উৎসবে এমন ধরাবাঁধা সময় আজকের ডিজিটাল যুগে বিস্ময় সৃষ্টি করে বৈকি।

সাবধানতা অবশ্যই ভালো কিন্তু তাই বলে সাবধানতার নামে যদি শৃঙ্খলিত হতে হয় পরাধীনতার শিকলে তবে তা কী মেনে নেয়া যায় নাকি মানা উচিত? ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত এক সংবাদের বিবরণ ছিল এমন-“পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে বখাটেদের তাণ্ডবে বর্ষবরণ করতে আসা অন্তত ১৫ জন নারী দৈহিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। এ সময় বাধা দেয়ায় বখাটেদের হামলায় আহত হয়েছেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি শাখা সভাপতি লিটন নন্দীসহ বেশ কয়েকজন। পহেলা বৈশাখের দিন মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী চলে এ তাণ্ডবলীলা। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশের সামনে এসব ঘটনা ঘটলেও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে তারা। এ ছাড়া ঢাবি প্রক্টরকে ঘটনার বিষয়ে বারবার অভহিত করা হলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পহেলা বৈশাখের দিন সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ঢাবিতে বর্ষবরণ করতে আসা নারীদের ওপর বখাটেদের কয়েকটি দল যৌন নির্যাতন করে। বিভিন্ন স্থানে অন্তত সাত থেকে আটটি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ ছিল টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের সামনে। টিএসসি এলাকার নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী লিটন নন্দী বলেন, মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কয়েকজন সঙ্গীসহ শাহবাগ থেকে টিএসসির দিকে আসছিলাম। এ সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের সামনে কয়েকজন যুবক চারপাশ থেকে এক নারীকে ঘিরে ধরে যৌন নির্যাতন চালাচ্ছিল। আমরা চারজন গিয়ে ওই নারীকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাই। এর কিছুক্ষণ পর ওই স্থান থেকে একটু দূরে আরেকজন নারীর চিৎকার শুনতে পাই। সেখানে গিয়ে দেখি আরেক নারীকে তার ছোট্ট শিশুর সামনেই একদল যুবক ঘিরে ধরে পাশবিক যৌন নির্যাতন চালাচ্ছে। যুবকদের কয়েকজন তার স্বামীকে মারধর করছিল। ওই নারীকে উদ্ধার করতে গিয়ে আমরা বখাটেদের প্রতিরোধের মুখে পড়ি। তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার সময় পেছন থেকে আমাদের ওপর হামলা করে বখাটেরা। এ সময় আমার হাত ভেঙে যায়। ওই ঘটনার সময় দুজন যুবককে পুলিশের হাতে তুলে দিলেও পুলিশ তাদের ছেড়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।"

বুঝতে বেগ পেতে হয় না গত বছরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার উদ্দেশ্যেই ‘৫টার’ ফেরে পড়া। কিন্তু ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার সবই আজো প্রশ্নবিদ্ধ। গৌরবমণ্ডিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে ১৫ নারীর লাঞ্ছনার ঘটনা কৌতূহল জাগায় প্রক্টরের মানসিকতা নিয়েও। কারণ নারীর প্রতি শব্দ চয়নে শালীন ছিলেন না তিনিও। বিস্মিত হতে হয় কার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব।

আর সে ঘটনায়তো এক মন্ত্রী মহোদয় বলেই ফেলেছিলেন- `এটা কোন ব্যাপার না, এমন দুএকটা ঘটনা ঘটতেই পারে।" যেদেশের মন্ত্রী বাহাদুর এমন বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন, পুলিশ নীরব দর্শক, প্রশাসন নির্লিপ্ত, প্রতিবন্ধী, সেদেশের উৎসবপ্রিয় মানুষকে উৎসবের আনন্দ ঘড়ির কাঁটার মতো মেপে করতে বলার ফরমান জারি করা নিঃসন্দেহে উদারতার লক্ষণ! সেদিন যে কারফিউ থাকবে না তাতেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাওয়া উচিত আমাদের।

সারা বছর জুড়ে যখন হাজারো নারী শিকার হচ্ছেন, ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নির্যাতন, শ্লীলতাহানির, তখন তো তাহলে নারীকে নিষিদ্ধ করা দরকার। ‘না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাশি’র মতো।

আর গল্পের রাজার মতো মাথা কেটে কোন্ রাজ্য শাসন করতে চায় আমাদের প্রশাসন? নিরাপত্তার নামে জাতিকে শৃঙ্খলিত নয় বরং নিজ দক্ষতার চিহ্ন আঁকুন, নজির স্থাপন করুন সুবিচারের, তবেই প্রশাসনের শাসন করা মানায়।

লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।