নির্বাচনের ট্রেনে কি লাগবে উৎসবের রঙ?

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৪৫ এএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ট্রেনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে গত ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে। তারপর মনোনয়নপত্র দাখিল, বাছাই এবং আপিল নিয়ে নানা নাটকীয়তা চলেছে এতদিন। গতকাল রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে সকল নাটকীয়তা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে সকল কৌতুহল, উত্তেজনা, আগ্রহ, নাটকীয়তা শেষ হয়ে গেছে গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের মধ্য দিয়েই। যারা রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন, তারা মোটামুটি বলে দিতে পারবেন কে কোথায় পাস করবেন। ৭ জানুয়ারির ভোটগ্রহণ এখন নিছক আনুষ্ঠানিকতা। তারপরও আজ প্রতীক বরাদ্দের পর শুরু হবে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। চলবে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত।

গত কদিন ধরেই আওয়ামী লীগের সাথে ১৪ দলীয় জোটের শরিক এবং জাতীয় পার্টির দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে কোন দলকে কোন আসন ছাড়া হবে, তার সমঝোতা হয়েছে। সমঝোতায় ১৪ দলের শরিক বা জাতীয় পার্টি সন্তুষ্ট এমন বলা যাবে না। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও’ তত্ত্বে তাদের তা মেনে নিতে হয়েছে। দেন দরবার করে ১৪ দলের তিনটি দল পেয়েছে ৬টি আসন। জাসদ পেয়েছে তিনটি, ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি এবং জাতীয় পার্টি-জেপি পেয়েছে একটি।

তবে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি অনেক দেন দরবার করে পেয়েছে মাত্র ২৬টি আসন। অন্তত ৪০টি আসনের জন্য মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিনেও গোস্যা করে বসেছিল জাতীয় পার্টি। এমনকি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর হুমকিও দিয়েছিল তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২৬ আসনেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে জাতীয় পার্টিকে।

একসময় জাতীয় পার্টি ছিল স্বামী-স্ত্রীর দল, এরশাদও মনোনয়ন পেতেন, তার স্ত্রী রওশন এরশাদও মনোনয়ন পেতেন। এখনও জাতীয় পার্টি স্বামী-স্ত্রীর দলই। তবে বদলে গেছে পাত্র-পাত্রী। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং তার স্ত্রী শেরীফা কাদেরের আসন ছাড় দিয়েছে আওয়াম লীগ। আরেকটা কথা এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় পার্টিতে রওশন যুগের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। একাদশ সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশান এরশাদ নাও থাকতে পারেন দ্বাদশ সংসদে।

দেবরের সাথে অভিমান করে রওশন তার দলবল নিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। তবে আওয়ামী লীগ চাইলে রওশনকে সংরক্ষিত আসনে এমপি বানিয়ে বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসাতে পারে। জাতীয় পার্টির মধ্যে এরশাদ বা জি এম কাদের মাঝে মধ্যে বিপ্লব করলেও রওশন এরশাদ বরাবরই আওয়ামী লীগকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে গেছেন। তার একটা বিনিময় নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ তাকে দেবে। তবে নির্বাচনের আগে গজিয়ে ওঠা তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, বিএসপি বা শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে আসা কল্যাণ পার্টিসহ অন্যান্য খুচরা দলগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের কী সমঝোতা হলো তা এখনও পরিষ্কার নয়। যারা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক প্রমাণে এত কষ্ট করলো, নিজেদের জাতীয় বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত করলো; তাদেরও কিছু না কিছু দিতে হবেই।

কিংস পার্টির অংশটুকু বাদ দিলে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর এখন গোটা বাংলাদেশের নির্বাচনী চিত্র অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। সমঝোতায় শরিক দলগুলো আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও বসিয়ে দেয়ার আবদার করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে দায়িত্ব নেয়নি। ছেড়ে দেয়া আসনগুলোতে নৌকার প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেও স্বতন্ত্ররা এখনও রয়ে গেছেন।

নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, উৎসবমুখর করতে, ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে এবং ২০১৪ সালের মত এবার যাতে কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ এবার স্বতন্ত্র এবং ডামি প্রার্থীদেরও নির্বাচনে উৎসাহ দিচ্ছে। আসনভিত্তিক সমঝোতায় জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে এবার তাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ভোটারদের কেন্দ্রে আনা। এই চ্যালেঞ্জে জয় পাওয়াটা অত সহজ হবে না। আপনি যখন আগেই জেনে যাবেন, কে কোথায় জিতবে; তখন আপনার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতেও যেতে আগ্রহী হবেন না আপনি। সারাদেশে আওয়ামী লীগের ভোটাররা আসলেও কেন্দ্রের সামনে বিশাল লাইন হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। তাই যেই দলকেই সমর্থন করুন, কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ নেই বললেই চলে।

 

দেবরের সাথে অভিমান করে রওশন তার দলবল নিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। তবে আওয়ামী লীগ চাইলে রওশনকে সংরক্ষিত আসনে এমপি বানিয়ে বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসাতে পারে। জাতীয় পার্টির মধ্যে এরশাদ বা জি এম কাদের মাঝে মধ্যে বিপ্লব করলেও রওশন এরশাদ বরাবরই আওয়ামী লীগকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে গেছেন। তার একটা বিনিময় নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ তাকে দেবে।

 

কেন্দ্রে ভোটার আসা নিয়ে কদিন আগে সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু ফেসবুকে একটা ইন্টারেস্টিং হিসাব দিয়েছেন, ‘সারাদেশে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটিতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, তাতী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, মহিলা লীগ ও যুব মহিলা লীগের পদধারী নেতা আছেন, ২ কোটি ১৭ লাখ ৩ হাজার ৮০৪ জন। আওয়ামী লীগের ডাটা অনুযায়ী কর্মী সমর্থকদের হিসেব বাদ দিলেও দলীয় নেতাই আছেন মোট ভোটারের ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। দেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন।

বর্তমানে কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি এই দলটিতে একজন নেতা যদি একজন করে ভোটারকে কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারেন তাহলেই ৩৬ দশমিক ২৬ শতাংশ ভোট কাস্ট হওয়ার কথা। আওয়ামী লীগের নেতারা কী একজন করে ভোটার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারবেন না? মনে হচ্ছে সেই ভরসা আওয়ামী লীগের নেই। তাই দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে!’ জায়েদুল আহসান যা লিখেছেন, তা একদম সহজ পরিসংখ্যান। আবার জায়েদুল আহসান যা লিখেছেন, সেটাই বাস্তবতা। একজন করে ভোটার নিয়ে আসা তো দূরের কথা পদধারী নেতারা সবাইও ভোট দিতে যান না।

নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৯টি এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। পরিসংখ্যানের হিসাবে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলকই হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি অংশ না নিলে সে নির্বাচনকে পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে না। যে ২৯টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের সমমনা। তাই নির্বাচনে সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা সামান্যই। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলের কাছে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যভাবে উপস্থাপনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ দেখানো, ভোটারদের উপস্থিতি জরুরি।

আরেকটা জরুরি বিষয় হলো, নির্বাচনে উৎসবমুখর আবহ তৈরি করা। একসময় বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই ছিল উৎসব। আমার মনে আছে, ছেলেবেলায় আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংসদ সব নির্বাচনেই সব প্রার্থীর মিছিলে সামিল হতাম। ‘নাইচ্যা নাইচ্যা কইয়া যাই, অমুক মার্কায় ভোট চাই, মা বোনেরে কইয়া যাই, অমুক মার্কায় ভোট চাই’ নির্বাচনী মিছিলের যে ছন্দ, তা আমাদের রক্তে দোলা দিতো। পোস্টারে ছেয়ে যেতো গোটা এলাকা। দিনরাত মাইকের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যেতো। তবে নির্বাচন কমিশন নিয়ম করে নির্বাচনী উৎসবের রাশ টেনেছে। এখন আর যেখানে সেখানে পোস্টার লাগানো বা যখন তখন মাইক ব্যবহারের সুযোগ নেই। তবুও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হলে তাতে এমনিতেই উৎসবের রং লেগে যেতো।
এবার সে সুযোগও কমে আসছে। নির্বাচন হচ্ছে, আমরা আর মামুরা স্টাইলে। সব দলের প্রার্থিতা চূড়ান্ত হয়েছে এক জায়গা থেকেই। এখন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির দায়িত্ব হলো নির্বাচনকে উৎসবমুখর করে তোলা। সেটা তারা কতটা পারবে, নির্বাচনী ট্রেনে কতটা রং লাগবে; সেটা দেখার জন্যই অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।