বিএনপির আন্দোলনের গিয়ার বদল!
৪৩ দিন পর মাঠে নামলো বিএনপি। ৪৩ দিন পর অবরোধমুক্ত একটি রোববার পেলো বাংলাদেশ। রাজনীতির জন্য এটা সুখবরই হওয়ার কথা। কিন্তু আদৌ সুখবর কি না, এ স্বস্তি টিকবে কি না; সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। বিএনপি অনেক বছর ধরেই নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। এ দাবিতে তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল। তবে সেই তারাই দাবি থেকে সরে এসে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়।
বিএনপি নেতারা আড়ালে বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও আসলে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে আসেননি। মূলত নিজেদের নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে, মনোনয়ন বাণিজ্য করতে এবং দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়; এটা প্রমাণ করতেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এবং বিএনপি তাদের লক্ষ্যে ষোলআনা সফল। পুলিশ আর প্রশাসন মিলে ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রহসন বানিয়ে ‘দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়’ এ দাবির পক্ষে যুক্তি আরও জোরালো করে।
২০১৮ সালে বিএনপির পাতা ফাঁদেই পা দেয় সরকার। কিন্তু সেই ফাঁদ থেকে ফসল তুলতে পারেনি বিএনপি। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক বক্তৃতা দিলেও মাঠে, মাঠের বাইরে, আদালতে কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি বিএনপি। বরং একবার সংসদে যাবো না বলে, আবার শেষ মুহূর্তে সংসদে যোগ দিয়ে, আবার সংসদ থেকে পদত্যাগ করে নিজেদের অস্থিরতাই বারবার প্রমাণ করেছে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক ভাবে অনেক প্রশ্ন উঠলেও সেই নির্বাচনের ফল দিয়ে পাঁচবছর দেশ চালাতে কোনো অসুবিধা হয়নি আওয়ামী লীগের।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। গত বছর দেশজুড়ে বিভাগীয় সমাবেশ করে জনমনে দারুণ চাঞ্চল্যও সৃষ্টি করে বিএনপি। কর্মীদের মধ্যেই দারুণ উৎসাহ সৃষ্টি হয়। আগের বছর আন্দোলনে পাওয়া সাফল্যে ভর করে গত জুলাইয়ে আন্দোলনের গিয়ার বদল করে বিএনপি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে নামে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে সমাবেশ, মহাসমাবেশ, মানববন্ধন, মিছিল করে বিএনপি। এসব কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণ। সরকারও আন্দোলনের ব্যাপারে যথেষ্ট সহনশীল ছিল। কিন্তু সবকিছু বদলে যায় গত ২৮ অক্টোবর। সেদিন বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে ঢাকায় ব্যাপক সংঘাতে জড়ায় বিএনপি নেতাকর্মীরা। পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, গাড়িতে আগুন, ভাংচুরের ঘটনা ঘটে।
বিএনপি সহিংসতায় ফিরলে সরকারও দমন-পীড়নে ফিরে আসে। তাতে বদলে যায় পুরো পরিস্থিতি। ২৮ অক্টোবর সহিসংতার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার করা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সক্রিয় প্রায় সব নেতা এবং বিপুল সংখ্যক কর্মীকে। বিএনপিও সমাবেশ, মানববন্ধন ছেড়ে হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াওয়ে ফিরে যায়।
২৯ অক্টোবর থেকে ১০ দফায় ২০ দিন অবরোধ, তিন দফায় চারদিন হরতাল পালন করে দলটি। এই ৪৩ দিনে বিএনপির কর্মসূচি দেশের সবার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। রোববার-সোমবার হরতাল অবরোধ, মঙ্গলবার বিরতি, বুধবার-বৃহস্পতিবার হরতাল/অবরোধ, শুক্রবার-শনিবার বিরতি। এ হরতাল আর অবরোধে পার্থক্য কী, সেটাও পরিষ্কার ছিল না।
কাগজে-কলমে ৪৩ দিনে ২০ দিন অবরোধ আর চারদিন হরতাল পালিত হলেও বাস্তবে মাঠে এর কোনো প্রভাব ছিল না। ঘোষণা থেকে শুরু করে পালন, পুরোটাই আসলে হয়েছে ভার্চুয়ালি। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী গোপন জায়গা থেকে ভিডিও বার্তায় কর্মসূচি ঘোষণা করতেন। অবরোধ বা হরতালের আগের দিন কয়েকটা যানবাহনে আগুন দিতো। ব্যস আন্দোলন শেষ। এ আন্দোলনে জনগণ তো অনেক দূরের কথা, দলের নেতাকর্মীদেরই কোনো ভূমিকা বা অংশগ্রহণ ছিল না।
বিএনপির দাবি নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। বিরোধীদল সরকার পতনের আন্দোলন করতেই পারে। দাবি যতই যৌক্তিক হোক, তা আদায় করতে হলে তেমন চাপ দিতে হবে, জোরদার আন্দোলন করতে হবে। এমনকি আন্দোলন করে অযৌক্তিক দাবি আদায়ের উদাহরণও আছে। কিন্তু বিএনপি যেমন ঢিমেতালে ভার্চুয়াল আন্দোলন করছে, তাতে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটবে, তেমন পরিস্থিতি কখনোই সৃষ্টি হয়নি। বিএনপির প্রবাসী সমর্থকরা ইউটিউবে বারবার সরকার পতনের সময়সূচি ঘোষণা করলেও বাস্তবে তা ঘটানোর মতো আন্দোলন তারা গড়তে পারেনি।
বিএনপির বিপুল জনসমর্থন আছে। কিন্তু তারা তাদের আন্দোলনের পক্ষে সেই সমর্থকদের কখনো মাঠে নামাতে পারেনি। জনসম্পৃক্ততার কথা বললে, বিএনপি নেতারা বলেন, সরকারের মামলা-হামলার ভয়ে তারা আন্দোলন করতে পারছেন না। কোনো সরকারই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সুবিধা করে দেয় না। তারা যে কোনো উপায়ে আন্দোলন দমন করতে চায়। বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা যেদিন ভয়কে জয় করে মাঠে নামতে পারবে, সেদিনই আন্দোলন সত্যিকারের গতি পাবে, আন্দোলনের গিয়ার চেঞ্জ হবে।
বিএনপি যখন ভার্চুয়াল আন্দোলনে ব্যস্ত, নির্বাচন কমিশন তখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির আসার সম্ভাবনা যেহেতু নেই, তাই তফসিল পেছানোর সম্ভাবনাও নেই। তার মানে আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি বর্জন করলেও নির্বাচন ঠেকানোর সামর্থ্য কি তাদের আছে। গত ১৫ বছরে বিএনপির আন্দোলনের ধরন এবং গত ৪৩ দিনের আন্দোলনের গতি দেখে এটা পরিষ্কার, তাদের পক্ষে আন্দোলন করে সরকার হটানো সম্ভব নয়। আমার ধারণা এটা বিএনপিও ভালো করেই জানে। তারা আসলে তাকিয়ে ছিল অন্য কোনো আশায়।
আন্দোলনের ঘোষণাটা কেবল চক্ষুলজ্জার খাতিরে। তারা ভেবেছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো বিদেশি শক্তি চাপ দিয়ে সরকারের পতন ঘটিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসাবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে চায়। আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনা তাদের এজেন্ডা নয়।
বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে অবতার বা ভগবান হয়ে ওঠা মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও বিএনপিকে আন্দোলনে রেখে অবকাশ যাপনে চলে গিয়েছিলেন। ফিরে এসেও তিনি আর আগের মতো তৎপর নন। তাতে ভেঙে গেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবল। এমনটি পিটার হাসকে ‘অবতার ও ভগবান’ বলা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর এখন আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন করছেন। এ অবস্থায় বিএনপির এখন না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থা।
৪৩ দিন ভার্চুয়াল আন্দোলন করার পর ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে মানববন্ধন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে বিএনপি। ফলে ৪৩ দিন পর অবরোধমুক্ত রোববারের দেখা পায় বাংলাদেশ। ১০ ডিসেম্বর দিনটিও বিএনপির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ইস্যুতে র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর আরও নিষেধাজ্ঞা আসছে ধরে নিয়ে ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকে বিএনপি। তখন তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল, সরকারের পতন বুঝি ঘটেই যাচ্ছে। কিন্তু ২০২২ সালে নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি। এবারও বিএনপি আশায় ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝি নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা দেবে। কিন্তু তাদের সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। বিএনপির মধ্যে আশা জাগিয়ে এখন এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পিছিয়ে যাওয়া তাদের বিপাকে ফেলেছে।
সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায় করতে হলে বিএনপিকে তাদের আন্দোলনের গিয়ার চেঞ্জ করতে হবে। চলমান স্টাইলের আন্দোলনে হবে না। ১০ ডিসেম্বর যে হরতাল-অবরোধে বিরতি দিয়ে মাঠে নামলো, এটা কি তাদের আন্দোলনের গিয়ার বদলের জন্য? এখন থেকে কি আন্দোলনের নতুন ধাপ শুরু হবে?
এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। মানববন্ধন শেষেই বিএনপি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সেই আগের স্টাইলে অবরোধ। তবে এবার রুটিনে একটু পরিবর্তন এসেছে। এতদিন মঙ্গলবার বিরতি ছিল। এবার মঙ্গল ও বুধবার টানা অবরোধ ডাকা হয়েছে। তবে নির্বাচনের আর মাত্র ২৭ দিন বাকি। এখনই বিএনপিকে তাদের আন্দোলনকে টপ গিয়ারে তুলতে হবে। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা বলছে, তাদের আন্দোলন ব্যাক গিয়ারে যাচ্ছে। এ স্টাইলে আন্দোলন করে লাভ হবে না।
একটা বিষয় পরিষ্কার, আন্দোলনে জিততে হলে তাতে জনগণের সম্পৃক্ততা লাগবে। বিএনপির বিপুল জনসমর্থন আছে। কিন্তু তারা তাদের আন্দোলনের পক্ষে সেই সমর্থকদের কখনো মাঠে নামাতে পারেনি। জনসম্পৃক্ততার কথা বললে, বিএনপি নেতারা বলেন, সরকারের মামলা-হামলার ভয়ে তারা আন্দোলন করতে পারছেন না। কোনো সরকারই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সুবিধা করে দেয় না। তারা যে কোনো উপায়ে আন্দোলন দমন করতে চায়। বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা যেদিন ভয়কে জয় করে মাঠে নামতে পারবে, সেদিনই আন্দোলন সত্যিকারের গতি পাবে, আন্দোলনের গিয়ার চেঞ্জ হবে।
১০ ডিসেম্বর, ২০২৩
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস