আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধনে পবিত্র কোরআন

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৪৮ এএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩

আমরা আল্লাহপাকের দরবারে হাজারো শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি এজন্য যে তিনি এমন এক মহান ঐশী কিতাব বিশ্ববাসীর জন্য নাজিল করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। এটি আল্লাহতায়ালার অপার বৈশিষ্ট্য যে তিনি যুগে যুগে নবি-রাসুল প্রেরণের মাধ্যমে তার সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা ও দয়া প্রদর্শন করে আসছেন। শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদের (সা.) কাছে পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন, যা পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত জীবন বিধান। এতে মানবজাতির জন্য সব চাহিদা ও জ্ঞানের উপকরণ রয়েছে।

পবিত্র কোরআনই একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যার ব্যাপারে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে এতে কোনোরকম বিকৃতি ঘটবে না। আজ পর্যন্ত আল্লাহপাক শব্দ ও অর্থের দিক দিয়ে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে আসছেন। পবিত্র কোরআনের আর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো যে এতে সব দেশ, জাতি, বর্ণ ও ধর্মের মানুষের জন্য বার্তা রয়েছে। কোরআন সব ধর্মের নবিকেই সত্য নবি এবং তাদের ধর্মগ্রন্থকে তাদের সময়ের জন্য সঠিক বলে ঘোষণা দেয়।

মহানবির (সা.) আগমনের সময় আরবজাতি চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। বাকি বিশ্বও এই অন্ধকার থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। এই চরম বিশৃঙ্খল ও অন্ধকারচ্ছন্ন সময়ে আরবের মাটিতে সূর্যের উদয় হয়। পবিত্র কোরআন অন্ধকারচ্ছন্ন আরব জাতিকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে ফেলে এবং তারা পরে বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়।

পবিত্র কোরআন স্বল্প সময়ে আরব জাতির মধ্যে এক আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন করে। এতে তারা এক আল্লাহর ইবাদতকারীতে পরিণত হয়। কোরআনে সুরা আল ফুরকানে তাদের সম্বন্ধে বলেছে, “রহমানের প্রকৃত বান্দা তারা, যারা তাদের প্রভুর সমীপে সেজদাবনত ও দণ্ডায়মান অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করে” (২৫:৬৫-৬৬)।

হজরত উমর (রা.) ইসলামের একজন মহান খলিফা হয়েছিলেন এবং তার সময়ের একজন মহান শাসক ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে পবিত্র কোরআনের বাণী শোনার মাধ্যমে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এটি কোরআনের এক বিপ্লব, যে উমর (রা.) পূর্বে ইসলামের চরম শত্রু ছিলেন তাকেও কোরআন সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ফেলে। তিনি আনুগত্যে এতটাই অগ্রসর হয়ে যান যে পরে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হন।

একইভাবে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.) যিনি ইসলামের মহান শাসক ছিলেন এবং যার সময়ে ইসলামিক সাম্রাজ্য মদিনা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল, তিনিও পবিত্র কোরআনের আয়াত শুনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

মহানবির (সা.) সাহাবি হজরত ইবনে আব্বাস (সা.) বলেন সে যখন হজরত জাফর ইথিওপিয়া থেকে ফিরে আসছিলেন তখন তার সাথে কয়েকজন খ্রিস্টান নাবিক ছিল। মহানবির (সা.) কোরআন তেলাওয়াত শুনে তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে এবং তারা সেই মুহূর্তেই ইসলাম গ্রহণ করে। মহানবি (সা.) জানতে চান যে ইথিওপিয়ায় গিয়ে তারা কি আবার তাদের পূর্বের ধর্মে ফিরে যাবে কি না। তারা বলে যে তারা কখনো ইসলামকে পরিত্যাগ করবে না। এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে পবিত্র কোরআন সব প্রকারের অন্ধকারকে আধ্যাত্মিক আলোতে রূপান্তর করেছে।

এখন আমি পবিত্র কোরআনের এমন এক বিপ্লবের কথা বলবো যা মানবতা, নাগরিক অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শান্তি, সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে। পবিত্র কোরআন মানবাধিকারকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যেটি পূর্বে কোনো ধর্মগ্রন্থ করেনি। এটিই প্রথম এবং একমাত্র কিতাব যা কেবল নারীদের পক্ষে কথাই বলেনি বরং নারীদের অধিকারকেও প্রতিষ্ঠিত করেছে। আল্লাহপাক সুরা নিসায় বলেছেন “এবং যে কেউ সৎ কাজ করে, সে পুরুষ হোক বা নারী এবং সে মোমেন, এই প্রকারের ব্যক্তিগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি বিন্দুমাত্রও অন্যায় করা হবে না” (৪:১২৬)।

ইসলামের পূর্বে কিছু আরব গোত্রে সম্মানের নামে মেয়ে সন্তানদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। ইসলাম চিরতরে এই প্রথাকে বিলুপ্ত করে এবং মহানবি (সা.) ঘোষণা দেন যে ব্যক্তি তাদের কন্যাদের বড় করবে এবং শিক্ষা প্রদান করাবে, পবিত্র কোরআন ঘোযণা দিচ্ছে যে তাদের জান্নাতে স্থান দেওয়া হবে।

ইসলামের পূর্বে নারীদের সম্পদের মালিকানা ছিল না কারণ তাদেরই পুরুষদের সম্পত্তি মনে করা হতো। এমনি বিধবাদেরও মৃত স্বামীর সম্পতি হিসেবে বণ্টন করা হতো এবং তাদের নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তাদের কোনো মতামত দেওয়ারই অধিকার ছিল না। ইসলাম নারীদের উত্তরাধীকারের অধিকার প্রদান করে, যার ফলে তারা নিজেদের ঘরের রানি হয়ে থাকে। মহানবি (সা.) স্ত্রীদের সম্মান প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বলেন “তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে উত্তম যে তার স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করে এবং আমি তোমাদের মধ্যে স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম।”

 

বর্তমান বিশ্ব দেখতে পাচ্ছে, পবিত্র কোরআন কীভাবে মানুষের হৃদয়ে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধন করছে। পবিত্র কোরআন যে মহান আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন করছে আমরাও যেন তা থেকে কল্যাণমণ্ডিত হতে পারি। আল্লাহপাক আমাদের সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।

 

পবিত্র কোরআন ১৪০০ বছর পূর্বে নারীদের অধিকার প্রদান করেছে। আর বর্তমান উন্নত বিশ্ব কিছুদিন হল নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলছে এবং এজন্য গর্ববোধ করছে। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য পবিত্র কোরআনের মূলনীতি হল যেসব বিষয়ে ধর্মের মধ্যে মিল রয়েছে সেগুলোর জন্য একত্র হওয়া। মহানবি (সা.) যখন মদিনায় যান তখন তিনি কুরআনের এই শিক্ষার ওপর আমল করেন। তিনি মদিনার ইহুদি, মুসলমান ও পাগানদের সাথে এক চুক্তি করেন যেটি মদিনা সনদ হিসেবে স্বীকৃত।

পবিত্র কোরআন আমাদের শিক্ষা দেয় আমরা যেন সকল ধর্মের মানুষ ও তাদের নবি ও সন্ন্যাসীদের সম্মান করি এবং পারস্পরিক সহনশীলতার পরিবেশ গড়ে তুলি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন “ধর্মের ব্যপারে কোন বল প্রয়োগ নেই” (২:২৫৮)।

মদিনা সনদে ইসলামের এই শিক্ষা দেখা যায়, যার মাধ্যমে সকল মানুষের অধিকার, ধর্মীয় ও ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা হয়। এই সনদ সব ধর্মের মানুষকে তাদের অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করে যার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ ও একতাবদ্ধ দেশ গড়ে উঠে। একইভাবে নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথে যে চুক্তি হয় তাতেও একই শিক্ষার অনুসরণ করা হয়। সেখানে বলা হয় সব ধর্মযাজক, ইবাদতের স্থান ও সেখানে বসবাসরত মানুষকে আল্লাহ ও তার নবি (সা.) পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করবেন। কোনো ধর্মযাজককে তার ইবাদতের স্থান থেকে সরানো হবে না।

পবিত্র কোরআনে সুরা আল মায়েদায় আল্লাহপাক বলেন “হে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায়পরায়ণতার ওপর সাক্ষী হিসেবে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হও এবং কোনো জাতির শত্রুতা যেন তোমাদের এ অপরাধ করতে আদৌ প্ররোচিত না করে, যে তোমরা ন্যায়বিচার না কর। তোমরা সুবিচার কর, এটা তাকওয়ার অধিকতর নিকটবর্তী” (৫: ১০)।

কোরআনের এই আয়াত ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ মানদণ্ড নির্দেশ করে। এই শিক্ষা নামধারী মুসলমানকে ইসলামের নামে অত্যাচার ও নৃশংসতা করার কোন সুযোগ দেয় না। যারা ইসলামকে হিংস্র ও সন্ত্রাসী ধর্ম বলে প্রমাণ করতে চায় তাদেরও এই শিক্ষা কোনো সমালোচনা করার সুযোগ দেয় না। কারণ এই আয়াতে পবিত্র কোরআন ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করেছে।

মহানবি (সা.) এরকম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে কোনো বিশেষ দল তার কাছে কোনো বিশেষ অনুগ্রহ পেত না, কারণ আল্লাহপাক এরকম পক্ষপাতিত্বহীন আচরণেরই নির্দেশ দিয়েছিলেন। একবার একজন মহিলা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল যিনি অনেক সম্ভ্রান্ত বংশের ছিলেন। এতে আরব গোত্রের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে কারণ তার মতো একজন সম্ভ্রান্ত মহিলাকে শাস্তি দিলে তার গোত্রের সম্মানহানি হবে। মহানবির (সা.) একজন প্রিয় সাহাবি ওসামা বিন যায়েদকে মহানবি (সা.) কাছে পাঠানো হয় যেন তিনি অনুরোধ করেন মহানবি (সা.) যেন সেই মহিলাকে ক্ষমা করে দেন।

মহানবি (সা.) তাকে তিরস্কার করে বলেন “হে ওসামা, মন দিয়ে শোন! আমাদের পূর্বের অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে কারণ তারা সমাজের সম্ভ্রান্ত শ্রেণিদের বিশেষ সুবিধা দিতো এবং নিচু শ্রেণিদের সাথে অবিচার করতো। ইসলাম এরকম পক্ষপাতিত্বের অনুমতি দেয় না এবং আমি কখনো এরকম করতে পারবো না। আল্লাহর কসম! আমার মেয়ে ফাতিমাও যদি এই অপরাধ করতো, আমি তাকেও শাস্তি প্রদান করতাম” (সহিহ মুসলিম)।

বর্তমান বিশ্ব দেখতে পাচ্ছে, পবিত্র কোরআন কীভাবে মানুষের হৃদয়ে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধন করছে। পবিত্র কোরআন যে মহান আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন করছে আমরাও যেন তা থেকে কল্যাণমণ্ডিত হতে পারি। আল্লাহপাক আমাদের সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।