বিজয়ের মাস এবং বাংলাদেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতির ইতিহাস

শেখ হাবিব বাবু
শেখ হাবিব বাবু শেখ হাবিব বাবু , কবি ও অর্থনীতির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক
প্রকাশিত: ০৯:৪২ এএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩

আশার প্রদীপের নিচে বড় হচ্ছে এক অকৃতজ্ঞ প্রজন্ম যারা নিজেদের অর্জিত স্বাধীনতা নিয়ে ব্যঙ্গ করে, উন্নয়ন নিয়ে ব্যঙ্গ করে। অথচ কবির ভাষায় যদি বলি- ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী, সেই সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ কিংবা ‘নিজ দেশ ছাড়ি কেন বিদেশ ন যায়’/ ‘আজও আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই, জাতির পতাকা খামছে ধরেছে সেই পুরনো শকুন।’- ইত্যাদি অসংখ্য কবিতায় কবিরা একশ্রেণির নষ্ট প্রজন্মকে চিহ্নিত করেছেন যারা নিজে দেশের প্রতিটি ভালো জিনিসকে, অর্জনকে অপমানিত করে। কবিতার লাইনে লাইনে নিহিত আছে নিজ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভাষাকে কটাক্ষ করা ঘৃণিত প্রজন্মের কথা।

মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সন্তানের সংখ্যা আজ এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে তারা আজ মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের চেয়েও যেন সংখ্যাধিক্য। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এক ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে নিজ দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরোধী অপশক্তি আছে যারা এখনো দেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি অথচ তারা এদেশের আলো বাতাসে বড় হচ্ছে, দেশের উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে।

এই ভ্রান্তপ্রজন্ম এবং তাদের পিতা-মাতারা এখনো পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে এবং আমাদের স্বাধীনতা লাভে যে প্রতিবেশী ভারতের মানুষ জীবন দিয়েছে সুযোগ পেলেই তাদের প্রতিও চরম বিদ্বেষ পোষণ করে। আমি সেই বিপথগামী প্রজন্মকে বলব তারা যেন তাদের পিতা-মাতাকে জিজ্ঞাস করে- তাদের জন্মের পূর্বে তাদের পিতা-মাতারা কেমন বাংলাদেশে বসবাস করত--তবেই জানবে জাতির ক্রমোন্নতির ইতিহাস!

এই বাংলার মানুষ সন্ধ্যায় কুপি বাতি জ্বালাতে পারত না, শহরেও হারিকেন লণ্ঠনের নিভু নিভু আলো জ্বলত, দেশের মানুষের তিনবেলা আহার জুটত না,পায়ে জুতা ছিল না, কাঠের খড়ম ছিল পায়ে, খোলা পায়খানা ব্যবহার করতো, একটা কাপড় সারা গাঁয়ে হাত বদল হতো, বিয়ে বাড়িতে কলা গাছ পুঁতে গেট সাজাতো। পালকি চড়ে বর যেত বিয়ে বাড়িতে, দোচালা কুঁড়েঘর ছিল, পাটকাঠির বেড়া ছিল, রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট ছিল না, ছিল না তেমন স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদরাসা।

মাইক ছিল না, কলের গান ছিল কতিপয় ঘরে। রেড়িও ছিল দু-তিন পাড়া পরপর। লুমিনা ব্যাটারি দিয়ে চলা রেডিওতে বয়লা ঘুরাতো ঘর্মাক্ত শরীরে, টেলিভিশন তো দূরের কথা, লুঙ্গি গামছা পরে খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতো। একসময় তারা গরুর গাড়িতে চড়তো, ছিল না কোনো এমবিবিএস ডাক্তার, কয়েক গ্রাম মিলে একটা হাতুড়ে ডাক্তার ছিল- সফদার ডাক্তার মাথা ভরা টাক তার বলা হতো। শিশু জন্মালেই মা-শিশু মারা যেত ধনুষ্টঙ্কারে। কলেরা, যক্ষ্মা, পেটের অসুখ ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী।

পাকিস্তানের শোষণের ফলে বাংলা মায়ের দুধশূন্য স্তনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বেঁচে থাকার এক ফোটা দুধও যখন ছিল না তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে এদেশের মানুষ বাঁচার জন্য স্বাধীনতা চাইলেন। কিন্তু হায়েনারা আমাদের বাঁচার দাবিকে মেনে না নিয়ে ’৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে শুরু করলো পৃথিবী জঘন্যতম নরহত্যা-চললো ১৬ ডিসেম্বর এর বিজয় দিন পর্যন্ত। ত্রিশ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ এ ক্ষমতা গ্রহণ করে পেলেন শুধু ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক ধু ধু করা বিরাণ ভূমি আর অসহায় এক জনসমষ্টি। কিন্তু মহান বাঙালি জাতির পিতা শূন্য হাতে ১৯৭২ এ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করল তখনা আমাদের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি, রিজার্ভ ছিল শূন্য, দেশের প্রথম বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার, যার সিংহ ভাগ ছিল বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করে আনা।

বঙ্গবন্ধু অর্থনীতি যখন শুরু হলো ’৭২ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় মাত্র ৯৩ মার্কিন ডলার, ১৯৭৫ এ এসেই সেই মাথাপিছু আয় দাঁড়ালো ২৭৩ মার্কিন ডলারে। বঙ্গবন্ধু দেশের গণমানুষকে সম্পৃক্ত করে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি টেকসই সুষম উন্নয়নের অগ্রযাত্রা শুরু করেছিলেন ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যার মধ্যে দিয়ে দেশের অগ্রযাত্রাকে আবার সেই পাকিস্তান আমলের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল অবৈধ সামরিক শাসকরা। ফলে ১৯৭৭ সালে সে আয় নেমে এল ১২৯ মার্কিন ডলারে। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া মাথাপিছু আয় ২৭৩ ডলারে পৌঁছাতেই বাংলাদেশকে প্রায় ১৪ বছর লেগেছিল।

 

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী নিক্সনের বিদেশ মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বর্তমান বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতির বাংলাদেশকে ব্যঙ্গ করে ’৭১ সালে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিল। এই হেনরি কিসিঞ্জার শতায়ু লাভ করে দেখে গেছেন তার বক্তব্য কতটা অসাড় ছিল- নিশ্চয় বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক উত্থান কিসিঞ্জারকে জীবিতাবস্থায় আত্মগ্লানিতে ভুগিয়েছে।

 

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আবার বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন নীতি অবলম্বন করে ক্রমশ সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিসহ বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি ত্বরান্বিত করতে লাগলো। ২০০৯ এ বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্ষমতায় এসে ঘোষণা করলেন ভিশন টুয়েন্টি ওয়ান। শুরু হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির অপ্রতিরোধ্য রেস। আজ ১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আমূল বদল দিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায়ই তিন হাজার মার্কিন ডলার, জিডিপির আকার প্রায় ৪৬০ বিলিয়ন ডলার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ বাজেট দিল প্রায় ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার। এ বাজেটের সিংহ ভাগ অর্থ আমাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে আহরিত। দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো বদলে দিয়ে এক নতুন বিস্ময়ের জন্ম দিল-দেশের সমুদ্রসীমা বৃদ্ধি পেল প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৪৬ বর্গ কিমি, শতভাগ বিদ্যুতায়নের সফলতা।

জোট সরকারের রেখে যাওয়া মাত্র ২৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জায়গায় এখন উৎপাদন ক্যাপাসিটি ২৬ হাজার মেগাওয়াট। ইতোমধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুতের যুগে প্রবেশ করলো জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই। তিনি ঘরে ঘরে বিদ্যুতের দ্যুতি ছড়িয়ে দিলেন। কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক বদলে দিল গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসা সেবা, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট প্রতিটি জেলায় আধুনিক হাসপাতাল, প্রতি বছর ডাক্তার, নার্স নিয়োগ পাচ্ছে।

৫৮ লাখ দুস্থ অসহায় বিধবা, বয়স্কদের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে এলেন তিনি, ১৩ লাখ গৃহহীনকে স্বাস্থ্যসম্মত বাড়িঘর দিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পর্যাপ্ত ভাতা দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। শুধু এনটিআরসির মাধ্যমেই এ পর্যন্ত ১ লাখের ওপর শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে কর্মসংস্থানের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, তাছাড়া অন্যান্য সরকারি শূন্যপদে নিয়মিত ভাবে নিয়োগ দিয়ে কর্মসংস্থানে বিপ্লব ঘটাচ্ছে, বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণের ফলে সেখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান হচ্ছে।

১০০ ইকোনমিক জোন বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে সরকার, এতে লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান হবে। সামাজিক অবকাঠামোর মধ্যে ৫৬০টির অধিক আধুনিক মসজিদ নির্মাণ, কওমি মাদরাসার সার্টিফিকেটে সরকারি চাকরি লাভের সুযোগ, ইমাম প্রশিক্ষণ এবং বেতন-ভাতার আওতায় আনার ফলে সামাজিক অবকাঠামো অত্যন্ত শক্তিশালী হচ্ছে। জাতীয় সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৫ শতাংশ। বিদ্যালয়ে শিশুদের গমন প্রায় শতভাগ করা হয়েছে। এতে শক্তিশালী সামাজিক অবকাঠামো গড়ে উঠছে, যা অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে বিকশিত করতে সহায়ক হবে।

কৃষি বিপ্লব: অন্যদিকে কৃষিতে ঘটেছে বিপ্লব, এ বছর বিদেশ থেকে কোনো চাল আমদানি করা হয়নি ফলে খাদ্যে পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সবজি এবং মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থতম, পোশাক উৎপাদনে ২য় অবস্থানে আছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে খাদ্য উৎপাদন হয় প্রায় ৫ কোটি মেট্রিক টন। জিডিপিতে কৃষির উপখাতের অবদান প্রায় ১১.২১ শতাংশ। যদিও জিডিপিতে কৃষির অবদান কমছে কিন্তু আধুনিক চাষাবাদ আর নতুন গবেষণার বদৌলতে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে, কৃষিজমি কমে গেলেও লাকসই প্রযুক্তিতে কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে কৃষিবান্ধব সরকার, যার নেতৃত্বে দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

অন্যদিকে শিল্প উৎপাদন বাড়ছে, জিডিপিতে শিল্পের অবদান ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৭.৫৬ শতাংশ। পাশাপাশি সেবা খাতের ব্যাপক প্রসারণের ফলে জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ক্রমশ বাড়ছে। ২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে সেবাখাতের অবদান প্রায় ৫১.২৪ শতাংশ। কৃষি, সেবা ও শিল্পখাতের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো বিশেষ করে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, রেলসহ বিদ্যুৎ খাতের সম্প্রসারণ।

বড় অর্থনৈতিক অবকাঠামোর মধ্যে পদ্মা সেতু-নিজস্ব অর্থায়নে পদ্ম সেতু নির্মাণে জননেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিস্তার ঘটিয়েছে ফলে দেশি বিদেশি অর্থায়নে একেএকে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফোর লেন হাইওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগও আকৃষ্ট হচ্ছে।

অন্যদিকে ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজারে রেল যোগাযোগ নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে ফলে দেশের পর্যটন খাত সম্প্রসারিত হবে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল এবং রেলপথ সম্প্রসারণের ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রায় ২ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই অঞ্চল বৃহৎ ইকোনমিক হাবে পরিণত হবে, যা ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে উন্নত অর্থনীতিতে রূপদানে সক্ষম হবে। অনুমান করা হচ্ছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে
জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৮ শতাংশ।

বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা :

১. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: ২০০৭-২০০৯ সাল ছিল বিশ্ব মহামন্দা। ২০১০ সালের দিকে বিশ্ব মহামন্দা থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু কোভিডে যেখানে বিশ্বের অনেক দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩.৪৫ শতাংশ তা ক্রমশ বৃদ্ধিপেয়ে ২০-২১এ ৬.৯৪ শতাংশ, ২১-২২ এ ৭.১০ শতাংশ এবং চলতি বছর তা দাঁড়াবে প্রায় ৭ শতাংশ। বাংলাদেশের ২৫-২৬ অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ৮ শতাংশ এর ওপরে।

২.সঞ্চয়: স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মানুষের আয় বৃদ্ধিতে যখন বঙ্গবন্ধু সমবায় সমিতি, সমন্বিত কৃষি, ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের মাধ্যমে দেশের মানুষের আয় ও সঞ্চয় বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করেন তখন দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে; ফলে বাংলাদেশ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি শোষণের ফলে এদেশের মানুষের আয় ছিল না ফলে সঞ্চয়ও ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যার নানামুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে দারিদ্র্যতার হার কমেছে, মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের বর্তমান জিডিপি প্রায় ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার, এই হিসাবে বর্তমান বছরে সঞ্চয়ের মাত্রা দাঁড়াবে জিডিপির ৩০.২২ শতাংশ, সেই হিসাবে মোট সঞ্চয় হবে দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকার সমান।

৩. বিনিয়োগ: এক সময় বাংলাদেশ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ ছিল, বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ভিশন-২১ এবং ভিশন-৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দেশে বিদেশি এবং দেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির ৩১.২৫ শতাংশ হবে, এতে বেসরকারি বিনিয়োগ হবে ২৩.৬৪ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগ হবে ৭.৬১ শতাংশ। এক্ষেত্রে কেইনিসিয়ান মডেলের বিনিয়োগ ইম্পেক্ট কাজ করছে, অর্থাৎ ১ টাকা বিনিয়োগ হলে জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে ৩ টাকা হারে, ফলে মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মাথাপিছু আয়: বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা গ্রহণ করেই নানামুখী কর্মসূচির মাধ্যমে ’৭৫ সালেই দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২৭৩ ডলারে উন্নতি করেন। পরে ’৭৭ সালে তা নেমে আসে ১২৯ ডলারে। ২৭৩ ডলারে ফিরে যেতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৪ বছর। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্ষমতা গ্রহণ করেই জাতীয় আয়বর্ধক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিগত ১৫ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করে দেশকে উন্নয়নশীল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন মধ্যম আয়ের দেশের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২৭৯৩ মার্কিন ডলারে, যা আগামী অর্থবছরে ৩ হাজার ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করবে। আর তা কেবল সম্ভব হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলে।

দারিদ্র্য বিমোচন: পাকিস্তানি শোষণ আর পরে সামরিক শাসক এবং তাদের উত্তরসূরিদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে দেশে অর্থনৈতিক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না হওয়ায় দেশের মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব হচ্ছিল না। বর্তমান সরকারের নানামুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশে দারিদ্র্যতার হার কমিয়ে ১৮ শতাংশ নেমে এসেছে, চরম দারিদ্র্যতা হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৫.৬ শতাংশ!

ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ- ইতোমধ্যে এই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন হয়েছে, মঙ্গা দূর হয়েছে, এখন দেশে না খেয়ে কোনো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে না।

রিজার্ভ : ২০০৮ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের রেখে যাওয়া মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নিত করেছিলেন। বর্তমানে বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করেও রিজার্ভ এর পরিমাণ প্রায়ই ৩০ বিলিয়ন ডলারে ওঠানামা করছে। রিজার্ভ পরিস্থিতি ক্রমশ উন্নত হচ্ছে।

আমাদের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যালেন্স অব ট্রেড প্রতিকূলে থাকে কারণ আমরা আমদানি বেশি করি রপ্তানি কম করি, কিন্তু আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অনুকূলে থাকে কারণ ফরেন রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ফলে তা অনুকূলে থাকে। সরকার রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধি করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। হুন্ডি রোধের উদ্দেশ্যে সরকার প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ৫ শতাংশ হারে মুনাফা ঘোষণা করেছে- নিঃসন্দেহে এতে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়বে এবং রিজার্ভ পরিস্থিতি আরও উন্নত হবে।

সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মসূচি জোরদারের ফলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে অগ্রগতি পাচ্ছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি, ২য় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ভিশন-৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে শেখ হাসিনা সরকার ‘ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০ এবং সুনীল অর্থনীতি' কৌশলসমূহ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে উন্নত অর্থনীতির দেশ এবং সমৃদ্ধ বাঙালি জাতি হিসেবে পরিচিত করবে। সেই সাথে আমাদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন-ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বৈষম্যহীন ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়ন হবে আর সেটাই হবে আমাদের প্রকৃত বিজয়োৎসব।

পুনশ্চ: মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী নিক্সনের বিদেশ মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বর্তমান বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতির বাংলাদেশকে ব্যঙ্গ করে ’৭১ সালে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিল। এই হেনরি কিসিঞ্জার শতায়ু লাভ করে দেখে গেছেন তার বক্তব্য কতটা অসাড় ছিল- নিশ্চয় বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক উত্থান কিসিঞ্জারকে জীবিতাবস্থায় আত্মগ্লানিতে ভুগিয়েছে।

লেখক: কবি ও অর্থনীতির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, বঙ্গবন্ধু গবেষক এবং সাবেক ছাত্রনেতা।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।