কর্মসূচি সংকটে বিএনপি!
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাসা থেকে আমার স্ত্রী ফোন করে জানতে চাইলেন, বিএনপির পরবর্তী কর্মসূচি কী? আমি বললাম, রোববার-সোমবার টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল। শুনে মুক্তি একটু অবাক হলো, বললো, এতদিন তাহলে কী হচ্ছিল। আমি বললাম, এতদিন ছিল অবরোধ, এবার আসছে হরতাল। মুক্তির কৌতূহল আরও বাড়লো, হরতাল আর অবরোধে পার্থক্য কী? তার প্রশ্ন শুনে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম, তাই তো হরতাল আর অবরোধে পার্থক্য কী!
অনেকের আশঙ্কা ছিল, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি কঠোর কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করবে। কারও কারও ধারণা ছিল টানা অসহযোগ আন্দোলনে যাবে বিএনপি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার তফসিল ঘোষণা করলেন গত বুধবার সন্ধ্যায়। তার প্রতিবাদে বিএনপি নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করলো এর ২৪ ঘণ্টা পর। আর সেই কর্মসূচি আসবে চারদিন পর। বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অবরোধ থেকে হরতাল কঠোর কর্মসূচি। কারণ এতদিন দফায় দফায় অবরোধ চলে আসছিল। আর তফসিল ঘোষণার পর এলো হরতাল।
এবার একটু পেছনে যাই। ২৮ অক্টোবর সহিংসতায় মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে বিএনপি ঘোষণা করলো পরদিন সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। একদিনের হরতালের পর এলো দুদিনের অবরোধ। তার মানে তখনকার বিবেচনায় বিএনপির হরতাল থেকে কঠোর কর্মসূচি অবরোধে গেলো। সেটাই যদি বিবেচনা হয়, তাহলে তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি আন্দোলন বেগবান করলো নাকি পিছিয়ে এলো। আমি আসলেই বুঝতে পারছি না হরতাল আর অবরোধে পার্থক্য কী, কোনটা বেশি কঠোর?
রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। তাই বাংলাদেশের জন্মের আগে পরে আমরা অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন দেখেছি। বিশেষ করে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন তো আমাদের যৌবনকে মহিমান্বিত করেছে। বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক আন্দোলনে আমরা নানা রকমের কর্মসূচি দেখেছি-সমাবেশ, মহাসমাবেশ, অবস্থান, ধর্মঘট, হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ, মিছিল, বিক্ষোভ মিছিল, মশাল মিছিল, মানববন্ধন, জনতার মঞ্চ, ঘেরাও।
রাজনৈতিক হোক অরাজনৈতিক হোক; যে কোনো দাবি আদায়ে বা ক্ষোভ প্রকাশে মানুষ সমবেত হয়, প্রতিবাদ করে। সমবেত হওয়া, কর্মসূচি পালন করা আমাদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। বিএনপিও অনেকদিন ধরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। গত জুলাইয়ে সে আন্দোলনকেই তারা সরকার পতনের এক দফায় উন্নীত করে। এক দফা দাবিতে তারা সমাবেশ, মহাসমাবেশ, মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে আসছিল। গত ২৮ অক্টোবর সহিংসতায় মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর থেকে আন্দোলনের নতুন ধাপে প্রবেশ করে বিএনপি।
সভা-সমাবেশ করা আমাদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার হলেও তা শর্তসাপেক্ষে প্রযোজ্য। আন্দোলনের নামে আপনি মানুষ পুড়িয়ে মারবেন, যানবাহনে আগুন দেবেন, জনগণকে জিম্মি করবেন, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সূচি লণ্ডভণ্ড করে দেবেন। এটা কোনোভাবেই কারও অধিকার হতে পারে না। ২০১৪-১৫ সালে আমরা আন্দোলনের নামে অগ্নিসন্ত্রাসের ভয়াবহতা দেখেছি। আন্দোলনের নামে বিএনপির সে অগ্নিসন্ত্রাসের পরও তাদের দাবি আদায় হয়নি, তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি, সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি।
উল্টো বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আমার ধারণা ছিল, ২০১৪-১৫ সালের অভিজ্ঞতার পর বিএনপি আর কখনো অগ্নিসন্ত্রাসে ফিরবে না। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে বিএনপি আবার হরতাল-অবরোধের নামে অগ্নিসন্ত্রাসে ফিরেছে। একসময় দেশে হরতাল বা ধর্মঘটের আগের সন্ধ্যায় কর্মসূচির সমর্থনে মশাল মিছিল হতো। আর এখন সরাসরি বাসে আগুন দেওয়া হয়। হরতাল বা অবরোধের আগের সন্ধ্যায় যানবাহনে আগুন দেওয়া যেন এখন রুটিনে পরিণত হয়েছে।
সরকারের পতন চাওয়ার অধিকার বিএনপির আছে। কিন্তু এভাবে আন্দোলন করে যে দাবি আদায় হবে না, এটা তারা ২০১৪-১৫ সালেই আশা করি বুঝেছে। এখন যে স্টাইলে আন্দোলন করছে, তাতেও যে সরকার পদত্যাগ করবে না, সেটাও আশা করি বিএনপি ভালোই বোঝে। তারপরও তারা কোন আশায় এভাবে অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে, বোঝা মুশকিল।
এ ভূখণ্ডে আন্দোলন করে দাবি আদায়ের অনেক ইতিহাস আছে। ঊনসত্তর গণঅভ্যুত্থান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবকে মুক্ত করেছিল, তিনি শেখ মুজিব থেকে পরিণত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুতে। ’৯০ সালের তীব্র গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিল স্বৈরাচার এরশাদ। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করে আদায় করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি।
প্রতিটি সফল আন্দোলনেই জনগণের বিপুল অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু বিএনপির আন্দোলনে আগুন আছে, মানুষ নেই। বিএনপির নেতারা দাবি করেন, তাদের সাথে মানুষ আছে, কিন্তু পুলিশের ভয়ে তারা মাঠে নামতে পারছে না। পুলিশের ভয়ে মাঠে নামতে না পারলে আন্দোলন কখনো সফল হবে না। বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান কারাগারের ভয়ে পালিয়ে আছেন লন্ডনে।
বিএনপি নেতাদের প্রতি অনুরোধ, জনগণ যদি সত্যিই আপনাদের পাশে থাকে, আর আপনাদের যদি সাহস থাকে; তাহলে তাদের নিয়ে মাঠে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলুন। নইলে গোপন জায়গা থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করে, অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়ে জনগণকে জিম্মি করবেন না।
পালিয়ে থেকে দেওয়া নেতৃত্ব কখনো জনগণকে মাঠে নামাতে পারবে না। বিএনপির দেশে থাকা নেতারাও গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে আছেন। রুহুল কবির রিজভী আহমেদ গোপন জায়গা থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিছু দুর্বৃত্ত যানবাহনে আগুন দেয়। আর বিএনপি কর্মসূচি সফল করার জন্য জনগণকে অভিনন্দন জানায়। অথচ এ আন্দোলনের সাথে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই।
জেল-জুলুম-হুলিয়ার ভয় পেলে আন্দোলন হয় না। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় হরতাল সফল করতে আমরা ভোর থেকে রাস্তায় নামতাম। দিনভর মিছিল করতাম। স্বৈরাচারের পুলিশ মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়েছে, সরাসরি গুলি করে পাখির মতো মানুষ হত্যা করেছে। ঢালাও গ্রেফতার করেছে। রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু মানুষকে রুখতে পারেনি। জনতার জোয়ারে ভেসে গেছে স্বৈরাচারের মসনদ। বিএনপিও যদি তাদের আন্দোলনের সাফল্য চায়, সে আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে, জনগণকে মাঠে নামাতে হবে।
জনগণ পাশে নেই বলে বিএনপি এখন কর্মসূচি সংকটে পড়েছে। মহাসমাবেশ থেকে হরতাল, তারপর অবরোধ, তারপর আবার হরতাল। সেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। বিএনপির আন্দোলনে কোনো সমন্বয় নেই, সৃষ্টিশীলতা নেই, জনসম্পৃক্ততা নেই। ধরে নিচ্ছি বিএনপির দাবি সরকার মানবে না। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী দেশ এগিয়ে যাবে নির্বাচনের দিকে। তাহলে বিএনপি কী করবে? ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কি এই হরতাল-অবরোধ-হরতাল চলবে নাকি নতুন কোনো কর্মসূচি আসবে? সরকার দাবি না মানলে বিএনপি কী করবে?
মজাটা হলো, বিএনপির ক্ষোভ সরকারের ওপর। কিন্তু তারা প্রতিপক্ষ বানিয়েছে জনগণকে। বিএনপির আন্দোলনে সরকারের কিছুই যায় আসে না। ভোগান্তি যা হচ্ছে তা জনগণের। মানুষ মরছে, সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। অর্থনীতির ঝুঁকি আরও বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বিঘ্নিত হচ্ছে। জনগণ তো বিএনপির শত্রু নয়। তাহলে তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে লাভ কী।
বিএনপি নেতাদের প্রতি অনুরোধ, জনগণ যদি সত্যিই আপনাদের পাশে থাকে, আর আপনাদের যদি সাহস থাকে; তাহলে তাদের নিয়ে মাঠে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলুন। নইলে গোপন জায়গা থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করে, অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়ে জনগণকে জিম্মি করবেন না।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম