শেয়ার বাজারে সাফল্যের ছয়টি সহজ কৌশল
আমরা সবাই শেয়ার মার্কেটে বেশি লাভের আশায় ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু ফলাফল দেখা যায় ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ সেখান থেকে লোকসান করে বেরিয়ে আসছে আর ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ লাভ করছে। বিশেষ করে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের শেয়ার মার্কেটগুলোর অবস্থা আরও খারাপ।
এখানে দেখা যায় স্টক মার্কেট সঠিক নিয়মে পারফর্ম করে না। দেখা যায় যে স্টকের দাম মোটেও বাড়ার কথা না সেটার দাম বেড়ে বসে আছে। আবার যে শেয়ারের দাম ভালো থাকার কথা তা হুট করে কমে যাচ্ছে। টপ ২০ শেয়ারে দেখা যাবে ফান্ডামেন্টাল ভালো না এমন শেয়ার ঢুকে গেছে। আবার দেখা যাবে এমন শেয়ার যেগুলোর ফান্ডামেন্টাল খুবই ভালো তবুও সেই শেয়ার টপ ২০ তে নেই।
শেয়ার ব্যবসা অন্য ব্যবসা থেকে আলাদা। জ্ঞান ও ধৈর্য না থাকলে এখানে ভালো করা যায় না। যারা শেয়ার বাজার সম্পর্কে ভালো বোঝেন না তাদের জন্য আজকে আমার ছয় টি পরামর্শ আছে। এই পরামর্শ গুলো মেনে চললে যে কেউ শেয়ার মার্কেটে পূর্বের চেয়ে ভালো করতে পারবেন।
এক.
না বুঝে মার্জিন লোন এর ধারে কাছে যাওয়া যাবে না-
মার্জিন লোন অনেকটা বড় সুযোগের মতো। মনে হয় যেন আজকে আমরা মার্জিন লোন নেব আর কালই প্রফিট করে বেরিয়ে আসব। মার্জিন লোনের ইন্টারেস্ট রেট অনেক হাই। শেয়ার মার্কেট এমনিতেই খুব ভলাটাইল এবং অনেকেই এই লোনের গ্যাড়াকলে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ২০১০ সালে মার্জিন লোন নিয়ে মানুষজন সর্বস্বান্ত হয়েছিল। অনেকেই এখনও তাদের সেই লোনের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি। আমরা যারা শেয়ার মার্কেট ভালোমতো বুঝিনা তাদের উচিত মার্জিন লোন থেকে আমাদের নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখা।
দুই.
বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা-
অনেকেই দেখা যায় সব টাকা দিয়ে একটা কোম্পানির শেয়ার কিনে বসে আছে। তাতে করে যদি ঐ কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায় তাহলে সে সব হারাবে। তাই আমাদের উচিত বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা। বিনিয়োগকে ভাগ করে ডাইফারসিফাইড করে ফেলতে হবে। ওয়ারেন বাফেট যেমন বেশি ডাইফারসিফিকেশন পছন্দ করেন না। ৪ থেকে ৫ টা খাতে আমরা বিনিয়োগ করতে পারি। এটা হতে পারে ফারমাসিটিক্যাল, রিয়েল এস্টেট, টেক্সটাইল, সিমেন্ট খাত। যদি আমরা আমাদের বিনিয়োগযোগ্য অর্থকে বিভিন্ন খাতে ভাগ করে বিনিয়োগ করি তবে দেখা যাবে সব খাত একসাথে যেমন ধসে পড়ে না আবার সব খাত একসাথে উপরের দিকেও ওঠে না। সুতরাং দেখা যাবে আমাদের লস কম হচ্ছে আর লাভ বেড়ে যাচ্ছে।
তিন.
ভালো ফান্ডামেন্টাল দেখে শেয়ার ক্রয়-
শুধু ভালো ফান্ডামেন্টাল নয়, দেখতে হবে ঐ কোম্পানির ভালো ইতিহাস আছে কি না। ৫/১০ বছর ধরে তারা ভালো ডিভিডেন্ট দিচ্ছে কি না। তাদের ম্যানেজমেন্ট কে চালাচ্ছে। যখন আমরা শেয়ার কিনছি তখন তার দাম কতটুকু? মার্জিন অব সেফটি আছে কি না? এসবকিছু দেখে যদি আমাদের মনে হয় যে এই শেয়ারটা ভালো, শেয়ার মার্কেট ধ্বংস হয়ে গেলেও এই শেয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, তখন আমাদের এই শেয়ার কেনা উচিত। তবে শেয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ভাল শেয়ারও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তবে আশার কথা হচ্ছে এখানে ক্ষতির আশঙ্কা কম থাকে।
শেয়ার মার্কেটের ২ বিনাশী সূত্র হচ্ছে লোভ ও ভয়। লোভ ও ভয় আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ভয়ে আমরা শেয়ার মার্কেট থেকে লসের সময় ছিটকে পড়ে, শেয়ার মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। আবার লোভ আমাদের এমন একটা শেয়ার কিনতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে যা কিনে আমরা কয়েকদিন পর ফতুর হয়ে যেতে পারি।
চার.
দৈনন্দিন লেনদেন পরিহার করা-
অনেকের ধারণা আজকে শেয়ার কেনার পর কাল দাম বাড়বে, পরশু বিক্রি করব। তারপর আবার শেয়ার কিনব। তারপর আবার একদিন দাম বাড়বে তারপর বিক্রি করব। But this should not be the style of investing in share market. এ ধরনের আচরণ দেখা যায় শেয়ার বাজারে যারা ট্রেডিং করে তাদের মধ্যে। হয়ত কোনো কোনো সময় তারা ভালো করে, তবে সারাবছরের হিসাব করে দেখা যায় যে তারা খুব একটা লাভ করে না। কারণ প্রতিটি ট্রেডিং-এ কমিশন দেয়া লাগে এবং বছর শেষে দেখা যায় একটা বড় পরিমাণের টাকা চলে যাচ্ছে। তারপর ডে-ট্রেডাররা অনেক ক্ষেত্রেই বিপদে পড়তে পারেন। হঠাৎ যদি মার্কেট তালানিতে এসে ঠেকে, বেয়ার মার্কেটে চলে আসে, রিসেশন হয় তখন দেখা যাবে যে তাদের অবস্থা খুব খারাপ হবে। সুতরাং আমরা শেয়ার মার্কেটে লাভ করতে হলে ডে-ট্রেডিং থেকে দূরে থাকলে ভালো।
পাঁচ.
বিনিয়োগের ভালো সময় এখনই-
অনেকের মনের মধ্যেই প্রশ্ন থাকে কখন বিনিয়োগ করব বা কোন শেয়ারে বিনিয়োগ করব? মনে রাখতে হবে আমরা যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিনিয়োগের সুতরাং এখনই ভালো সময় এবং আমাদের খাত ভাগ করে বিনিয়োগ করতে হবে। কারণ সব খাত একসাথে ভালো করে না আবার সব খাত একসাথে খারাপও করে না। আমরা যদি অন্তত ৫ টা খাতের ৫টা শেয়ার চিহ্নিত করি এবং বিনিয়োগের সময় যে খাত খারাপ করছে কিন্তু ফান্ডামেন্টাল ভালো এবং শেয়ারের দাম কম সেই খাতের শেয়ারটিতে বিনিয়োগ করি তাহলে ভবিষ্যতে লাভের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
মনে রাখতে হবে আমাদের বিনিয়োগ করতে হবে এখনই তবে বিনিয়োগযোগ্য টাকার পুরোটা নয়। অল্প বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদের কাছে যদি ২ লক্ষ টাকা থাকে তবে ১ লক্ষ এখন করি। দেখে শুনে পরে আবার করি বাকি টাকা। এভাবে সময় নিয়ে নিয়ে বিনিয়োগ করাটা আমাদের জন্য ভালো। দেখা যাবে আজকে আমরা যে শেয়ার ২০ টাকায় কিনেছি সেটা কিছুদিন পরে ১৫ টাকায় নেমে গিয়েছে, তখন সে শেয়ারটা আমারা কিনতে পারি। তাহলে দেখা যাবে এভারেজ প্রাইজটা কমে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই এভারেজিং পছন্দ করি না তবে এভারেজ প্রাইজিং পদ্ধতিটা আসলে খারাপ না।
ছয়.
ধৈর্য রাখা, লোভ না করা ও ভয় থেকে দূরে থাকা-
শেয়ার মার্কেটের ২ বিনাশী সূত্র হচ্ছে লোভ ও ভয়। লোভ ও ভয় আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ভয়ে আমরা শেয়ার মার্কেট থেকে লসের সময় ছিটকে পড়ে, শেয়ার মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। আবার লোভ আমাদের এমন একটা শেয়ার কিনতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে যা কিনে আমরা কয়েকদিন পর ফতুর হয়ে যেতে পারি।
আমাদের মনে রাখতে হবে শেয়ার মার্কেটে লাভ লস দুটোই আছে। Risk is very high and return is extra high. তাই রিটার্নের ছোঁয়া যদি আমরা পেতে চাই এবং রিস্ক থেকে দূরে থাকতে চাই তবে আমাদের এই ৬ টা বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমাদের ব্যবসা চালাতে হবে। দেখা যাবে একটা লম্বা সময় পরে যে অল্প কয়েকজন মানুষ শেয়ার মার্কেট থেকে প্রফিট করে বেরিয়ে আসছে তাদের মধ্যে আমরাও আছি।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস