দুই মন্ত্রীর সাজা ও উচ্চ আদালতের বার্তা
আদালত অবমাননার দায়ে দুই মন্ত্রীর লাখ টাকা জরিমানা হওয়ার পর আবারো একটি বিষয় পরিষ্কার হলো যে, কেউ আইনের উর্ধ্বে নন। ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ প্রভাব-প্রতিপত্তি জাহির করার জন্য যে লাগামহীন বক্তব্য প্রদান করেন তারাও এখন থেকে সতর্ক হয়ে যাবেন। বিশেষ করে বিচার বিভাগ নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আরো সাবধান ও সতর্ক হবেন। এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে দুই মন্ত্রীর সাজা একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে- এটি বলা যায় নিশ্চিত করেই।
গতকাল রোববার সকালে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে আট সদস্যের বেঞ্চ খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে সাত দিনের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা বলছেন, দেশবাসীকে বার্তা দেয়ার জন্যই আদালত অবমাননার মামলায় সরকারের দুই মন্ত্রীকে তলব করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ আবারো না ঘটে। জাতি জানুক, সর্বোচ্চ আদালত কতো কঠোর হতে পারে। আদালত অবমাননার কারণে সরকারের দুই মন্ত্রীকে অর্থদণ্ড দিয়ে আদালতের মর্যাদা রক্ষার বিষয়ে দেশের সবাইকে সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মীর কাসেম আলীর আপিলের রায় সামনে রেখে গত ৫ মার্চ এক আলোচনা সভায় রায় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মামলা পুনরায় শুনানির কথা বলেছিলেন মন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তিনি বলেছিলেন, আপিলের শুনানিতে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন দলের কাজ নিয়ে প্রধান বিচারপতির অসন্তোষ প্রকাশের মধ্য দিয়ে রায়েরই ইঙ্গিত মিলছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীও প্রধান বিচারপতিকে ওই আপিল শুনানিকালে দেয়া বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন। এরই মাঝে সুপ্রিমকোর্টের রায়ে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল থাকে। ওই রায় ঘোষণার আগে পুরো আপিল বিভাগকে নিয়ে বসে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৯ সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ দুই মন্ত্রীকে তলব করে আদেশ দেন। পরে বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে আদালতে আবেদন করেন কামরুল ইসলাম ও মোজাম্মেল হক। তবে তাদের অপরাধের মাত্রা ‘এতোই বেশি’ যে ওই আবেদন আদালত গ্রহণ করেননি।
দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে মানুষ দায়িত্বশীল আচরণই প্রত্যাশা করে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়শই এর ব্যত্যয় ঘটে। দায়িত্বশীল অনেকেই এমন বক্তব্য দেন যা তাদের পদ-পদবি ও ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কেউ বা কথার ফুলঝুড়ি ফোটাতে, কেউ বা সস্তা হাততালির জন্য কথার ফানুস ওড়ান। কিন্তু এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পূর্বাপর কিছু ভাবেন না। বিশেষ করে সংবিধান রক্ষার শপথ নেওয়া ব্যক্তিরা যখন রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের অন্যতম বিচার বিভাগ নিয়ে অবান্তর-অপ্রাসঙ্গিক ও ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য করেন সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
মনে রাখা জরুরি, আদালতের রায়ের সমালোচনা করা যায় আইনের দৃষ্টিতে; কিন্তু রায় অমান্য করা যায় না। আর আদালতের মর্যাদাহানি রাষ্ট্রের একটি মৌলিক স্তম্ভ বিচার বিভাগকে দুর্বল করে। এতে আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দেশে ন্যায়বিচার ও সুশাসনের স্বার্থে আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক স্বাধীনতা ও ভারসাম্যমূলক অবস্থা থাকা অপরিহার্য। সবাইকে এলক্ষ্যে দায়িত্বশীল হতে হবে। দুই মন্ত্রীকে সাজা দিয়ে উচ্চ আদালত যে বার্তা দিলেন শিক্ষা নিতে হবে এটি থেকেও।
এইচআর/এমএস