ডেটলাইন ২৮ অক্টোবর
আল্লাহর কসম আলটিমেটাম!
বাংলাদেশেরে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। এর মধ্যে ১৫ বছর ধরেই তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। তবে আন্দোলন টানা চালাতে পারেনি, চালানো সম্ভবও নয়। বিএনপির আন্দোলন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, কখনো উঠছে, কখনো নামছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে এবং পরের বছর সরকারের বর্ষপূর্তিতে আন্দোলনের নামে পেট্রোল সন্ত্রাস চালিয়ে মানুষের নিন্দা কুড়িয়েছে প্রচুর। সে তিক্ত অভিজ্ঞতার পর বিএনপি সহিংস আন্দোলনের পথ থেকে সরে এসেছে।
টানা ১৫ বছরের আন্দোলনেও সাফল্য না পাওয়ায় বিএনপির আন্দোলন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাস্যরস হয় প্রচুর। এক সময় বিএনপি নেতৃত্ব ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিতেন। কিন্তু সেই কঠোর আন্দোলন আর আসতো না। তাই ‘ঈদের পর কঠোর আন্দোলন’র ঘোষণা এলেই দুষ্টু লোকেরা বলতো, কোন ঈদের পর আন্দোলন। বিএনপির আন্দোলন করার সক্ষমতা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছিল। প্রশ্নগুলো অযৌক্তিক নয়। কারণ বিএনপির সব হুমকি আসতো নয়াপল্টনের ব্রিফিং থেকে বা প্রেস ক্লাবের দেড়শো লোকের সমাবেশ থেকে।
তবে সব ঠাট্টা-মশকরা আর সমালোচনার জবাব তারা দিয়েছে মাঠের আন্দোলন দিয়েই। গত বছর সারাদেশে বিভাগীয় সমাবেশ এবং সরকারের নানা বাধা-বিঘ্ন সত্ত্বেও সে সমাবেশে বিপুল লোক সমাগমে বিএনপি প্রমাণ করেছে তারা ফুরিয়ে যায়নি। গত বছরের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় গত জুলাই থেকে বিএনপি এক দফার আন্দোলন শুরু করে। এতদিন তাদের দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। কিন্তু এখন তাদের একটাই দাবি সরকারের পদত্যাগ। গত জুলাই থেকে এক দফা দাবিতে বিএনপি নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছে। বিএনপির এসব কর্মসূচিতে লোক সমাগত ক্রমশ বাড়ছে। কর্মসূচি যত সফলই হোক, লোক সমাগম যতই বাড়ুক; সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি তারা সৃষ্টি করতে পারেনি।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিক থেকে রাজনীতিতে শঙ্কা ভর করে, অক্টোবরেই এসপার-ওসপার হয়ে যাবে। অক্টোবরে বিএনপি নানান কর্মসূচি পালন করেছে এবং করছে। কিন্তু এসপার-ওসপার এখনও করতে পারেনি। সর্বশেষ বিএনপি আগামী ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বিএনপি মহাসচিব বলছেন, মহাসমাবেশ থেকে শুরু হবে আন্দোলনের মহাযাত্রা। অবশ্য এটা ছাড়া বিএনপির সামনে আর কোনো অপশনও নেই। নভেম্বরের প্রথম না হলেও দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে ঘোষিত হবে আগামী নির্বাচনের তফসিল। তার আগেই বিএনপিকে তাদের আন্দোলনকে একটা যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে হবে।
তবে বিএনপি যত সহজ মনে করছে বিষয়টা তত সহজ নয়। কারণ আওয়ামী লীগও বিএনপিকে মাঠ ছেড়ে দেবে না। এক বছর ধরেই বিএনপির কর্মসূচি অনুসরণ করে আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি পালন করে আসছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে একটি বিষয় ইতিবাচক, তাহলো দুই দল একইদিনে মাঠে থাকলেও অতীতের মতো সংঘাতে জড়ায়নি। এজন্য দুই দলই ধন্যবাদ পাবে। আশা করি সামনের দিনগুলোতেও আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকবে।
বিএনপির সমস্যা হলো, গত ১৫ বছরের আন্দোলনে একবারও তারা সরকারকে বিচলিত করতে পারেনি। এমনকি ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকানোর নামে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসে নড়েনি সরকারের টনক। তাই এবারকার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকার দাবি মেনে নেবে, তেমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। আবার আন্দোলন করে সরকার হটানো যায় না, এমনও নয়। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল গণআন্দোলনের মুখে।
১৯৯৬ সালেও আওয়ামী লীগ রাজপথে আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেছিল। কিন্তু বিএনপি কোনোভাবেই রাজপথে সরকার হটানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি। অথচ এই বিএনপিই স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। তবে সাধারণভাবে বলা হয়, মাঠের দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভালো আর কেউ নেই। ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া বিএনপি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গণতান্ত্রিক চরিত্র অর্জন করলেও আওয়ামী লীগের মতো মাঠের দল হয়ে উঠতে পারেনি এখনও। বিএনপির এক দফা আন্দোলনেও আওয়ামী লীগ রাজপথে তাদের চেয়ে বেশি ব্যস্ত। রাজপথে জনসমাগম বিবেচনা করলে আওয়ামী লীগ খুব বেশি পিছিয়ে নেই।
ঢাকায় কিছু বাস চলে, যাতে লেখা থাকে ‘সিটিং সার্ভিস’ ‘গেটলক’। সকালে অফিস টাইমে গেটলক সার্ভিস হলেও পরে আর সেটি থাকে না। লোকাল বাসের মতোই জায়গায় জায়গায় থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়। তাই মানুষ আর গেটলক সার্ভিসে বিশ্বাস করে না। তাই কোনো গেটলক সার্ভিস বাসে লেখা থাকে ‘আল্লাহর কসম গেটলক’। বিএনপির সরকার পতনের আলটিমেটাম শুনলে আমার সেই গেটলক বাসের কথা মনে হয়। বারবার আলটিমেটাম দিয়েও সরকার পতন না হওয়ায় মানুষও এখন আর তাদের আলটিমেটামে বিশ্বাস করে না।
তবে ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকে এবার মরণ কামড় দিতে হবে। তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। নানান কানাঘুষা, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের পর বিএনপি ঢাকায় অবস্থান করতে পারে। যদিও মির্জা ফখরুল বসে পড়ার কর্মসূচি অস্বীকার করেছেন। তবুও সরকার এবং সরকারি দলের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে। আওয়ামী লীগ মাঠে তো থাকবেই, বিএনপি সহিংস কিছু করা বা অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হাতে তাদের মোকাবিলা করবে। ওবায়দুল কাদের এরই মধ্যে হুমকি দিয়েছেন, বিএনপির পরিণতি হবে হেফাজতের মতো। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু রাতের মধ্যেই শাপলা চত্বর খালি করে দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাই আন্দোলনের কোনো কৌশলেই আওয়ামী লীগকে কাবু করা মুশকিল।
পাশাপাশি রাজপথে থেকেও মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখায় দুই দলকেই ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। কিছুটা ধন্যবাদ পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। তাদের ঘোষিত নতুন ভিসা নীতির কারণে দুই দলই সংযত। বিএনপিও পারছে না পেট্রোল সন্ত্রাসে ফিরে যেতে। আওয়ামী লীগও পারছে না, আগের মতো দমন-পীড়ন চালাতে। এখন বিএনপি কিছুটা বিপাকে পড়েছে। তারাও জানে, এমন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দিয়ে আওয়ামী লীগকে টলানো যাবে না। আবার মার্কিন সহানুভূতি হারানোর ভয়ে সহিংস আন্দোলনের দিকেও যেতে পারছে না। তাহলে বিএনপির আন্দোলনের গন্তব্য কোথায়?
অনেকদিন ধরেই এ প্রশ্নটি আমার মাথায় ঘুরছে। ধরুন বিএনপির দাবি সরকার মানলো না, মানে পদত্যাগ করলো না। বিএনপি ছাড়াই সময়মতো নির্বাচন হয়ে গেলো। তাহলে বিএনপি কী করবে? কিন্তু আন্দোলন যদি সফল না হয়। এভাবেই কি চলতে থাকবে? বিএনপি নেতাদের অনেকবার আমি এ প্রশ্নটি করেছি। তাদের কাছ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর পাইনি। তারা বলেন, জনগণকে সাথে নিয়েই তারা আন্দোলনে বিজয়ী হবেন। তাদের আশা, হঠাৎ একটি স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানলের মতো আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। পড়লে তো ভালো, না ছড়িয়ে পড়লে কী করবেন, সেটা কেউ জানেন না। তাদের আন্দোলনের ধরন এবং কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, তারা কোনো দৈব বাণীর অপেক্ষায় আছেন। বিএনপির এক নেতা তো চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ভগবানের সাথে তুলনা করেছেন। তারা যদি মনে করেন, পিটার হাস তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন, তবে সেটা দিবাস্বপ্নই হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানো তাদের এজেন্ডা নয়।
ঢাকায় কিছু বাস চলে, যাতে লেখা থাকে ‘সিটিং সার্ভিস’ ‘গেটলক’। সকালে অফিস টাইমে গেটলক সার্ভিস হলেও পরে আর সেটি থাকে না। লোকাল বাসের মতোই জায়গায় জায়গায় থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়। তাই মানুষ আর গেটলক সার্ভিসে বিশ্বাস করে না। তাই কোনো গেটলক সার্ভিস বাসে লেখা থাকে ‘আল্লাহর কসম গেটলক’। বিএনপির সরকার পতনের আলটিমেটাম শুনলে আমার সেই গেটলক বাসের কথা মনে হয়। বারবার আলটিমেটাম দিয়েও সরকার পতন না হওয়ায় মানুষও এখন আর তাদের আলটিমেটামে বিশ্বাস করে না।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশের আগে বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে তারেক রহমানের নির্দেশে। এরপর কত অমাবস্যা চলে গেলো, তারেক রহমানের আর দেশে ফেরা হলো না। বিএনপির কোনো আলটিমেটামেই সরকার পতন হলো না। ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে সামনে রেখে বিএনপি পূজার মধ্যেই সরকারকে পদত্যাগ করতে বলেছে। কিন্তু এবারও জনগণ তাদের আলটিমেটামে আস্থা রাখতে পারছে না। বিএনপিকে বোধহয় এবার ‘আল্লাহর কসম আলটিমেটাম’ দিতে হবে।
২২ অক্টোবর, ২০২৩
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস