ঘুম থেকে দেরিতে উঠলে জীবনে ভাল করতে পারবেন না

সাইফুল হোসেন
সাইফুল হোসেন সাইফুল হোসেন
প্রকাশিত: ০১:৪৭ পিএম, ১৯ অক্টোবর ২০২৩

আমরা ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি আর্লি টু বেড এন্ড আর্লি টু রাইজ, মেকস অ্যা ম্যান হেলদি ওয়েলদি এন্ড ওইয়াইজ। আমাদের বাবা মায়েরা আমাদেরকে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যেমন আদেশ করতেন, ঠিক তেমনি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতেও আদেশ করতেন। যারা সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠেন, তাঁরা হেলদি, ওয়েলদি হন এবং জ্ঞানী হন। আমাদের ধর্ম ইসলাম উৎসাহিত করে আমাদেরকে তাড়াতাড়ি ঘুমুতে এবং সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ তাঁর সাহাবাদেরকে এশার নামাজের পরে গল্পগুজব না করে ঘুমিয়ে পড়তে বলতেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন শরীফে বলেছেন ‘আমি তোমাদের বিশ্রামের জন্য নিদ্রা দিয়েছি তোমাদের জন্য রাত্রিকে করেছি আভরণ স্বরূপ আর দিনকে বানিয়েছি তোমাদের কাজের জন্য’।

পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন যারা দেখবেন রাতে খুব একটিভ। তাঁরা সারারাত জেগে কাজ করে দিনে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। আবার অল্প সংখ্যক মানুষ আছেন যারা রাতে কম ঘুমান আবার দিনেও কম ঘুমান। এই যে রাতে দেরিতে ঘুমুতে যাওয়া এবং উঠতে দেরি করা, এর বিবিধ প্রভাব আছে আমাদের শরীর ও মনের উপর। বিশেষ করে করনা’র সময়টাতে মানুষের লাইফস্টাইল অনেকটা চেঞ্জ হয়ে গেছে লকডাউন এর কারণে বাসায় থাকতে থাকতে ছেলেমেয়েরা বিশেষ করে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের ঘুমের প্যাটার্ন চেঞ্জ হয়ে গেছে।

দেখা যাচ্ছে তারা সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত স্ক্রিন টাইম কাটাতে মোবাইল অথবা ল্যাপটপ অথবা টেলিভিশনে থাকছে এবং সকালে অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠছে। তাদের ব্যাপারে রিসার্চ-এর ফাইন্ডিংস খুব ভয়ঙ্কর। ২০১৪ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের উপর একটি গবেষণায় দেখা যায় দীর্ঘসময় ঘুমালে বিষন্নতার ঝুঁকি বাড়ে। সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমানো ব্যক্তিদের ২৭ ভাগের মধ্যে বিষণ্ণতা লক্ষণ দেখা গেছে। আর যাঁরা নয়ঘণ্টা বা বেশি ঘুমিয়ে থাকেন তাদের ৪৯ ভাগ এর মধ্যে বিষণ্নতা লক্ষণ পাওয়া গেছে। ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে বয়স্ক নারীদের মধ্যে যারা বেশি ঘুমান তাদের মস্তিস্কের কার্যকারিতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

২০১৩ সালে প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের উপর কোরিয়ায় একটা গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে সাড়ে ৬০০ নারী অংশগ্রহণ করেন। ফলাফলে দেখা যায় যে যারা সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমান তাদের ক্ষেত্রে সন্তান ধারণের সক্ষমতা বেশি অন্যদিকে যারা ৯ থেকে ১১ ঘণ্টা ঘুমান তাদের ক্ষেত্রে সন্তান ধারণের সক্ষমতা কম। খুব বেশি ঘুমানোর সঙ্গে ডায়াবেটিসের ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যারা ৮ ঘন্টার বেশি ঘুমান, ৬ বছরের মধ্যে তাদের টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। ৬ বছরের মধ্যেই ওজন বেড়ে যেতে পারে। ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমান যারা তাদের ২৫ ভাগ এর ওজন বেড়ে গেছে, এমনকি খাবার গ্রহণের সর্তকতা ও শারীরিক কসরত সত্ত্বেও স্থূলতা রোধ করা যায়নি।

২০১২ সালে আমেরিকান কলেজ অফ কার্ডিওলজির মিটিংয়ে জানানো হয় ঘুমের সঙ্গে হৃদপিন্ডের স্বাস্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে। সেখানে তিন হাজার ব্যক্তির তথ্য-উপাত্ত নিয়ে পরিচালিত গবেষণার ফলাফল জানানো হয়। এতে বলা হয় যারা রাতে আট ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ঘুমান তাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। যুক্তরাজ্যের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পিরেঞ্জ রেভি বলেন, যারা রাত জাগার অভ্যাস গড়ে তুলেছেন তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই মানসিক রোগের শিকার এবং ৩০% থাকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। এছাড়া স্নায়ুবিক সমস্যা থেকে শুরু করে অন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। যুক্তরাজ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রোনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জন রিচার্ডসন বলেন, ‘আমরা দেখেছি যারা দেরি করে ঘুম থেকে উঠেন, তাঁরা নানা ধরনের মানসিক ও শারীরিক জটিলতায় ভোগেন, তাঁদের গড় আয়ু নিয়মিত সকালে ওঠা মানুষের চেয়ে সাড়ে ছয় বছর কম। রিচার্ড আরেকটি কথা বলছেন, যারা সকালে অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠেন, তাঁদের নানা ধরনের ফিজিক্যাল এবং মেন্টাল ডিসঅর্ডার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

যাহোক, এগুলো মূলত মেন্টাল এবং ফিজিক্যাল প্রভাব. যারা সকালে দিন শুরু করতে পারছেন না তারা সকাল সকাল কাজে যেতে পারছেন না, কাজ শুরু করতে পারছেন না, তাঁদের সারাদিনের ওয়ার্কিং আওয়ার কমে যাচ্ছে, তাঁদের এফিশিয়েন্সি কমে যাচ্ছে, কাজ করার সক্ষমতা কমছে। তাঁরা আন্ডার পারফর্ম করছেন এবং যদি তাঁরা অফিসে চাকরি করেন তাহলে তাদের সেখানে শারীরিক দুর্বলতা থাকে, কাজে অমনোযোগিতা আসে।

ফলে একসময় যেয়ে তারা মেন্টাল এবং ফিজিক্যাল বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগতে থাকেন। আপনি যদি চাকরিজীবী হন, এটা কিন্তু আপনার কলিগদের নজর এড়াবে না। ফলে আপনার এই যে কম প্রডাক্টিভিটি, কাজে কম মনোযোগ এবং কাজে কম ডেডিকেশন এটা তাঁরা দেখবেন, তাঁদের নজরে আসবে। ফলে আপনি প্রমোশন পাবেন না। হয়তো বেশি দিন চাকরি করতে পারবেন না। চাকরি থেকে আপনাকে বের হয়ে যেতে হবে, এর ফল আপনার সমস্ত জীবনের উপরে পড়বে।

 

আমরা যদি চাই আমাদের বাচ্চাদের কে সুস্থ রাখতে, আমরা যদি চাই তারা জীবনে ভালো কিছু করুক, তাহলে আমরা নিজেরা যেমন তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাব, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবো তেমনি বাচ্চাদের সেরকম তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাওয়ার নিয়ম করতে হবে এবং সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ার নিয়মে জীবন গড়তে হবে।

 

রিসার্চ এ দেখা গেছে যে যারা দেরিতে ঘুম থেকে উঠছে বা সারারাত জাগছে তারা একসময় যেয়ে অসুস্থতায় ভুগে। সেটা মেন্টাল হতে পারে বা ফিজিক্যাল হতে পারে। যারা বেশিদিন চাকরি করতে পারছেন না, তাঁরা আর্লী রিটারমেন্টে যাচ্ছেন।

আমরা যারা বাবা মা আছি তাঁদের তাড়াতাড়ি ঘুমুতে যাওয়া উচিত। বাচ্চাদেরও যত্ন নেওয়া বা খেয়াল রাখা উচিত যে তারা সঠিকভাবে ঘুমাতে যাচ্ছে কিনা। যদি না যায় তাঁদেরকে বোঝানো দরকার এবং তাঁদেরকে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর জন্য উপদেশ দেয়া উচিত।

কারণ যখন তারা তাড়াতাড়ি ঘুমাচ্ছে না, তখন তারা কোন কাজ করছে না, ব্যাপারটা আসলে এমন না। আবার এমনও না যে তারা রাত জেগে পড়াশোনা করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা মোবাইলে সময় কাটাচ্ছে এবং যখন রাতে একা একা কেউ সময় কাটায় তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে মাথায় শয়তান ভর করছে। তখন সে শিক্ষণীয় কিছু করার পরিবর্তে যেগুলো তার জীবনে কোন ভ্যালু এ্যাড করছে না, শুধু ক্ষতি করছে সেদিকে তার মনোযোগ বেশি থাকে।

আমরা যদি চাই আমাদের বাচ্চাদের কে সুস্থ রাখতে, আমরা যদি চাই তারা জীবনে ভালো কিছু করুক, তাহলে আমরা নিজেরা যেমন তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাব, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবো তেমনি বাচ্চাদের সেরকম তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাওয়ার নিয়ম করতে হবে এবং সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ার নিয়মে জীবন গড়তে হবে।
জীবনে সফল হওয়ার জন্য, ধনী হবার জন্য আপনার এই রুটিনটা মেইনটেন করা খুব জরুরি- যে সকাল সকাল ঘুমাতে যাওয়া এবং সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কাজ শুরু করা এবং অন্তত ছয় থেকে সাত ঘন্টা ঘুমানো।

যদিও অনেক বিখ্যাত মানুষেরা জীবনে অনেক কম ঘুমিয়েছেন তারপরও তারা একটিভ ছিলেন। শুনেছি কাল মার্কস মাত্র ২ থেকে ৩ ঘন্টা ঘুমাতেন এবং দারুন সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারতেন। তবে তিনি কিন্তু জীবনের শেষের দিকে তিনি খুব ডিপ্রেশনে ভুগেছেন। আপনি একটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন যে সকালের সময়টা খুব প্রডাক্টিভ হয়। সকাল সকাল কোনো কাজ শুরু করলে অনেক কাজ করা যায়।

আপনি কর্মক্ষেত্রে ভালো করবেন। আপনি ব্যবসা করলে ব্যবসায় ভালো করবেন। আপনি একটা চনমনে লাইফ পাবেন। আপনি একটা সুস্থ সুন্দর সাবলীল জীবনযাপন করতে পারবেন।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।
[email protected]

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।