নতুন পাঠ্যক্রম এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

জাতীয় পাঠ্যক্রমে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে শুনে আসছিলাম বেশ কিছু দিন ধরেই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় রেখে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা আর পাঠ্যক্রমকে বিদ্যালয়ের চার দেয়ালের মুখস্ত বিদ্যার পরিধির বাইরে নিয়ে আসা যে এই নতুন পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য কমবেশি জানা ছিল তাও। তবে পরিবর্তনটা যে এত ব্যাপক আর দূরদর্শী এবং সেই সাথে অভিনব, তার লেশমাত্রও যে আমার জানা ছিল না, এ কথা স্বীকার করতে আমার অন্তত কোনো দ্বিধা নেই।

এ বিষয়ে মতবিনিময় সভায় আমন্ত্রিত হওয়াটা আমার কাছে ছিল খানিকটা অপ্রত্যাশিতও, কারণ অতীতে এ ধরনের কোনো কাজে আমি সংশ্লিষ্ট হবার সুযোগ পাইনি। যা হোক বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের আর দশজন মানুষের মতই আমার আগ্রহের জায়গাটা যেহেতু প্রবল, তাই দাওয়াতের কার্ডটা হাতে পেয়ে অনুষ্ঠানে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিতে আমার একের বেশি দুই সেকেন্ড সময় লাগেনি। ঢাকার পাঁচতারকা অভিজাত হোটেলের চমৎকার পরিবেশে বসে নতুন পাঠ্যক্রমের উপর প্রেজেন্টেশনগুলো দেখতে যেয়ে চারপাশের পারিপার্শ্বিকতায় যতটা না চমৎকৃত হয়েছি তারচেয়ে ঢের বেশি চমৎকৃত হয়েছি নতুন এই পাঠ্যক্রমের নানা দিকগুলো জেনে-বুঝে।

বাংলাদেশের আজকের এই ভূখন্ডে আনুষ্ঠানিক পাঠদান পদ্ধতি প্রচলন বহু শত বছর আগ থেকে, এক সময়কার মক্তব আর পাঠশালায় গুরুর হাতে। সে সময় একজন ছাত্র কতদিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিবেন, কবে শিক্ষাগ্রহণ শেষে বেরিয়ে যাবেন কিংবা আবার কখন প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসবেন এসব কিছুই গুরু নির্ধারণ করতেন ছাত্র আর ছাত্রের পরিবারের সাথে আলোচনাক্রমে পারস্পরিক কনভিনিয়েন্সের মাধ্যমে। সে সময়ের গ্রামের যে সমাজ তারা সম্মিলিতভাবে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন।

আজকের প্রেক্ষাপটে আপাতদৃষ্টিতে এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর আর অকেজো মনে হতেই পারে, তবে এটাও মনে রাখতে হবে ঐ পাঠদান পদ্ধতির সবচেয়ে বড় শক্তিটি ছিল তা ছিল জীবনমুখি। গুরুই সে সময় হয়তো এককভাবে পাঠ্যক্রমটি নির্ধারণ করতেন, কিন্তু তা ছিল তার জীবন থেকে নেয়া। জীবনঘনিষ্ট সেই পাঠ্যক্রম সেসময় বাঙালি সমাজের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। যে কারণে এ অঞ্চলে ব্রিটিশ রাজ কায়েম হওয়ার পর আমরা তাদের কাছে এর ব্যাপক সমালোচনা দেখেছি। সেই সময়টায় মহাপরাক্রমশালী ব্রিটিশ উপনিবেশে সূর্য কখনো অস্ত যেতোনা।

ব্রিটিশদের কোনো জীবনঘনিষ্ট পাঠ্যক্রম বা দক্ষ মানবসম্পদের কোন চাহিদাই ছিল না। তাদের ঔপনিবেশগুলোতে এমন এক ধরনের শিক্ষিত জনগোষ্ঠির প্রয়োজন ছিল যারা সারাক্ষণ তাদের শেখানো বুলি আওড়াবে যারা তথাকথিতভাবে শিক্ষিত হবে ঠিকই, কিন্তু তাদের থাকবে না কোন স্বাধীন, সৃজনশীল চিন্তাশক্তি। খোলা আকাশের নিচে বসে গুরুদের হাতে জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালী ব্রিটিশ রাজের তত্ত্বাবধানে রুপান্তরিত হয়েছিল বিদ্যালয় কেন্দ্রীক পাঠ্যপুস্তকের পাতার পর পাতা মুখস্ত করা এক অদ্ভুতুরে শিক্ষিত সম্প্রদায়ে যারা কখনো পাবলিক পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করে তো কখনো জিপিএ-৫ পেয়ে পত্রিকায় ছবি ছাপিয়ে আর টিভি ক্যামেরার সামনে নেচে-গেয়ে নিজেদেরকে সফল বলে চিনতে আর ভাবতে শিখেছে।

সেই জায়গা থেকে নতুন এই পাঠ্যক্রম যেন আবারও বাঙালির শিক্ষাব্যবস্থার বাল্মিকি যুগে প্রত্যাবর্তন। নতুন এই পাঠ্যক্রমে পাঠদানকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে নেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানে শিক্ষক শুধু সূত্রটা ধরিয়ে দিবেন আর গাইড করবেন। শিক্ষার্থী এখানে শিক্ষিত হবে তার মেধার চর্চা করে, সৃজনশীলতার প্রয়োগ ঘটিয়ে তার বাস্তব আর ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র-অসংখ্য শিক্ষা উপকরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে।

বঙ্গবন্ধুও এমন শিক্ষা ব্যবস্থাই চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সময় গঠিত কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টেও এমন গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কথাই বলা হয়েছে। সেভাবে যদি দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনও ছিল ঠিক এমনটাই। ৭ মার্চে তার যে ঐতিহাসিক ভাষণ, সেখানে তিনি আমাদেরকে আমাদের শত্রুকে ঠিকঠাক চিনিয়ে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে, অর্থাৎ জীবন থেকে আর চারপাশ থেকে শিক্ষা নিয়ে সেই শত্রুকে মোকাবেলা করতে।

 

সৃজনশীলতার এই উৎসবে তাদের আমরা কবে এবং আদৌ কি সম্পৃক্ত করতে পারবো? পাশাপাশি নৈতিকতার বিষয়টাতেও একটু জোর দেয়া প্রয়োজন। আমাদের আজকের বাংলাদেশে এই বিষয়টির ঘাটতিটা চোখে পড়ার মত এবং তা এতটাই যে মাঝেমধ্যেই শংকা জাগে, আমাদের যে স্বপ্নটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেখাচ্ছেন আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশ বছর পরে শুধু এই একটি জিনিসের ঘাটতির কারণে তার ভীতটা না নড়ে যায়!

 

বাংলাদেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ ছাত্র-ছাত্রী প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়, কলেজের গন্ডি পেরুতে যেয়ে তাদের ৭০ শতাংশই কোনো না কোনো পর্যায়ে ঝরে পড়ে। আর এই যে ঝরে পড়ে ৭০ শতাংশ, এরাই কিন্তু এক অর্থে আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। কারণ এরাই হচ্ছে সেই সব অদক্ষ রেমিটেন্স যোদ্ধা যাদের ঘাম ঝড়ানো আয়ের রেমিটেন্সের কল্যাণে এখনো সচল আমাদের অর্থনীতি আর বিশ্বে রেমিটেন্স আয়ের টেবিলে আমাদের অবস্থান সন্মাজনক অষ্টম স্থানে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের কল্যাণে আমাদের অর্থনীতির এই শক্ত জায়গাটার ভীতটা ক্রমশঃই নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। কৃষিতে ক্রমেই আমরা এমনকি আমাদের দেশেও যন্ত্রের ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ দেখছি। কমছে মানুষের প্রয়োজন। সম্পূর্ণরূপে মনুষ্যবীহিন পোশাক কারখানা আজকের পৃথিবীতে বাস্তবতা। কাজেই রেমিটেন্সের এই অবারিত প্রবাহটা অব্যাহত রাখতে হলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের প্রয়োজন দক্ষ রেমিটেন্স যোদ্ধার। আমাদের যে ৭০ শতাংশ এখন ঝরে যাচ্ছে তাদের সংখ্যাটা যেমন আমাদের কমিয়ে আনতে হবে, তেমনি সামনে যারা ঝরে পড়বেন কিংবা পড়বেন না, তাদের আমাদের অবশ্যই অন্ততঃ একটা বিষয়ে দক্ষ করে তারপরই মাঠে নামাতে হবে, যাতে তারা করে খেতে এবং খাওয়াতে পারেন। নতুন এই যে পাঠ্যক্রম তাতে এই বিষয়টা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে।

আমাদের আগামীর ছাত্ররা তেলের সাথে পানি মেশানোর কিংবা বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠতে পারা আর না পারার গণিতশাস্ত্রের বিশারদ না হয়ে বরং দক্ষ মেকানিক হবে আর দেশে ডিগ্রিপাস সোকল্ড শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা না বাড়িয়ে, বরং দক্ষ এন্ডোস্কোপি এসিসটেন্ট হবে, নতুন শিক্ষাক্রম সংক্রান্ত দিনভর উপস্থাপনা আর আলোচনা এবং অতঃপর ভূরিভোজন শেষে এই সুখ চিন্তায় বিভোর হয়ে পাঁচতারকা হোটেলের লবি ধরে গাড়ির দিকে হাঁটতে যেয়ে হঠাৎই মনে হলো, এই যে এত ভালো পাঠ্যক্রম তা কি পারবে আমাদের আগামীর স্বপ্নের বাংলাদেশটা নিশ্চিত করতে!

আমাদের এই যে কওমি মাদ্রাসা আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া এত লক্ষ শিশু তারাতো সেই গতানুগতিকতাতেই গা ভাসাতে থাকবে। সৃজনশীলতার এই উৎসবে তাদের আমরা কবে এবং আদৌ কি সম্পৃক্ত করতে পারবো? পাশাপাশি নৈতিকতার বিষয়টাতেও একটু জোর দেয়া প্রয়োজন। আমাদের আজকের বাংলাদেশে এই বিষয়টির ঘাটতিটা চোখে পড়ার মত এবং তা এতটাই যে মাঝেমধ্যেই শংকা জাগে, আমাদের যে স্বপ্নটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেখাচ্ছেন আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশ বছর পরে শুধু এই একটি জিনিসের ঘাটতির কারণে তার ভীতটা না নড়ে যায়!

লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।