দেশকে মুক্তবুদ্ধির পক্ষে নিরাপদ রাখার দায় সবার


প্রকাশিত: ০২:০৩ এএম, ২৭ মার্চ ২০১৬

উনিশশো একাত্তর সালের ২৬ মার্চ দিনটা শুভ ছিল না। আগের রাতে নিরস্ত্র নিরীহ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ট্যাংকের গোলা, বন্দুকের আওয়াজের মাঝেই জাতির জনকের স্বাধীনতা ঘোষণা। আজ ২০১৬ সালে এসে যে আনন্দের লহরি দেখছি আমরা তার মধ্যেও কোথায় যেন একটা কিছু নেই।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক উদার বাংলাদেশ। আজ যখন এ প্রবন্ধ লিখছি, তখনও কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত খ্রীস্টান ও মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীর রক্তের দাগ শুকায়নি। শিয়া মসজিদে হামলা, হত্যা, বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আগুন, উপাসনালয়, দোকানপাট ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ নিশ্চয়ই আমাদের চেতনা নয়। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশকেরও বেশি সময় পরে আমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা আছে সেই অন্ধকারের যুগ পাকিস্তানি আমলে।  

সত্যিই, কী দুর্ভাগা এই দেশ। কত দেশ তাদের স্বাধীনতার দিনটি কত আনন্দে কাটায়, কত রকমারি উদযাপন করে। কিন্তু আজ আমাদের শংকায় থাকতে হয় স্বাধীনতা বিরোধীরা কখন কার উপর চোরাগুপ্তা হামলা করে। এমন এক অবস্থা যে স্বাধীনতা শব্দটি উচ্চারণের আনন্দ গলা দিয়ে বেরোনোর আগেই বেদনায় রুদ্ধ হয়ে যায়। রক্তাক্ত এই বাংলার এমন অবস্থা থেকে যাদের মন কাঁদেনা তাঁরা ইতিহাস-বোধরহিত সংকীর্ণমনা স্বার্থপর, নয়তো তাঁরা সম্পূর্ণ ভিন্-জগতের মানুষ, যারা স্বাধীনতার মূল্য বোঝেনি, জানেনি।

উৎসব খুব ভাল জিনিস, উৎসব মানুষকে খুশি করে, উৎসবে আনন্দ বিলিয়ে দেয় মানুষ একে অন্যকে। নতুন শপথের উৎসবে ঢাকা পড়বে অশুভের আস্ফালন। কিন্তু নতুন করে ভাবনার জায়গাও কিন্তু এমন দিন। যে দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন হোসেন আলী তাকে মরে যেতে হয়। কারণ তিনি তার নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। একজন ব্যক্তি কি তার নিজের বিশ্বাস নিয়ে বাঁচতেও পারবেন না এদেশে? তাহলে চেতনার আর আছেটা কী? নিরব কোন এক প্রান্তে, এক অজ পাড়া গায়ে কে শিয়া আর কে সুন্নি কোনদিন যা মানুষ ভাবেনি, তাই বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে মসজিদে গুলি করে, বোমা হামলা করে।

মানুষকে যে মাটি কোনদিন ধর্ম দিয়ে বিচার করেনি, সেই বাংলায় দুর্ভাগ্যবশত ধর্মের এই উদার অন্তর্ভুক্তির ঐতিহ্য সংকীর্ণবুদ্ধি সাম্প্রদায়িকতার কারবারিদের দ্বারা বিকৃত হচ্ছে। একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠি দেশটিকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অপরিসর বৃত্তে সঙ্কুচিত করে ফেলার চেষ্টায় নিয়োজিত। আর এই রাজনৈতিক গোষ্ঠির কারণেই সৃষ্টি হচ্ছে উগ্র, জঙ্গি, মারমুখী ধর্মীয় হিন্দুত্বের সংকীর্ণ অসহিষ্ণুতার।

মু ক্ত চাওয়া, মুক্তবুদ্ধির শাস্তি মৃত্যু। বাংলাদেশ কি তবে এই বিধানকেই শিরোধার্য করবে? গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে কথা বলবে, তাকেই হত্যা করা হবে? অভিজৎদের হত্যাকাণ্ড, হোসেন আলীর খুন এই প্রশ্নকেই সামনে আনছে আজ। এখন এসব ঘটনাকে আর বিচ্ছিন্ন বলে তুচ্ছ করে দেখার উপায় নেই রাষ্ট্রের। এ পর্যন্ত যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের অনেক মতের সাথে একমত না হয়েও বলা যায়, তারা কেউ কোন অন্যায় করেননি, কারো ঘরে আগুন দেননি, কোন সহিংসতায় যোগ দেননি, এমনকি তাদের বিশ্বাসের অপর প্রান্তে যারা আছেন তাদেরকেও খারাপ ভাষায় আক্রমণ করেননি। তবুও তাদের প্রাণ দিতে হয়েছে।  

অপরাধ একটাই মুক্ত বুদ্ধি পোষণ করা এবং তা সাহসের সাথে উচ্চারণ করা।  তবে কি আমাদের স্বাধীনতা এই চেতনার কথা বলেনি? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যুক্তিবাদী দর্শনকেই সামনে রেখে হয়েছে, ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে সমাজকে যৌক্তিক করার জন্যই। যে আততায়ীরা আজ হত্যার উৎসবে মেতেছে তাদের আগমন আকস্মিক হলেও সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল না। এই আক্রমণগুলি দৃশ্যত একটি সূত্রে বাঁধা। তা মারমুখী অসহিষ্ণুতার সূত্র। বিপরীত মতের মানুষকে সহ্য না করবার, তাঁদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাবার, তাঁদের শারীরিক আঘাত করবার, এমনকি হত্যা করবার জঙ্গি অসহিষ্ণুতা লালন করা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে। যে রাজনৈতিক শক্তি দেশটি চায়নি তারা করেছে। আরেক রাজনৈতিক শক্তি শুধু আওয়ামী লীগ বিরোধিতার কারণে এই গোষ্ঠিকে বগলদাবা করে নাচছে।

সভ্যতার একটি প্রাথমিক শর্ত হিসাবে এই নীতি স্বীকৃত যে, বিভিন্ন মতামত একই সঙ্গে বজায় থাকবে, তাদের তর্ক চলবে, কিন্তু সে কারণে কাকেও আক্রান্ত হতে হবে না, কারও প্রাণহানির প্রয়োজন হবে না। সভ্যতা যেখানে নেই, যেমন পাকিস্তান, সেখানে  ব্লাসফেমি আইন করে যাকে তাকে যখন তখন `ধর্মীয় অবমাননার` অভিযোগ দিয়ে খুন করার সংস্কৃতি আছে। কোন সভ্য সমাজে তা নেই।

আধুনিক উদার গণতন্ত্রে এ ধরনের অসহিষ্ণুতা অন্যায়। বাংলাদেশে ব্লাসফেমি আইন নেই। কিন্তু একটি গোষ্ঠি নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। বাংলাদেশে আমরা দেখেছি স্বাধীনতার পর মত, এমনকি বহু `চরমপন্থী` মতও খোলাখুলি প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে নানা ধরনের অসহিষ্ণুতা দ্রুত বাড়িয়ে দেয় সামরিক শাসকরা। এবং আজ রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে এই গোষ্ঠি এত প্রতাপশালী হয়ে উঠেছে যে তা প্রতিরোধের উদ্যোগ ক্রমশ ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে।

এখানেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক গোষ্ঠির দায়িত্ব। সব বিভেদ ভুলে আবার এক হতে হবে। মনে রাখতে হবে যারা ভিন্নমতের অনুগামীদের উপর চড়াও হয়, তারা রাজনৈতিকভাবে কারো মিত্র হতে পারে না। আর প্রশানকেও ভাবতে হবে এই অন্ধকারের শক্তি উদার গণতন্ত্রের বাণী শুনবে না, সহিষ্ণুতার অনুশাসন মানবে না। যারা এখন দেশ চালাচ্ছেন তারা এই গোষ্ঠিকে কঠোর ভাবে মোকাবিলা করবে এটাই চাওয়া।  তবে বড় ভয়ের কথা, প্রশাসনের ভেতরে থাকা অনেকে, এমনকি রাজনৈতিক নায়করাও এ ধরনের অসহিষ্ণুতাকে প্রচ্ছন্ন ভাবে, কখনওবা প্রত্যক্ষ ভাবে প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন।

সহিষ্ণুতা, উদারতা ও অন্তর্ভুক্তির জীবনচর্যা ক্রমে বিধর্মীদের আক্রমণের, বিতাড়নের ‘ধর্ম’ হয়ে উঠছে। অসহিষ্ণুতাই কি তবে ধর্ম? ধর্ম রাজনীতির কারবারিরা হয়তো তেমনটাই মনে করেন। কিন্তু ষোল কোটি মানুষের বড় অংশ তা মনে করে না। এখনও ভরসার কথা এখানে। ধর্মীয় আচার আচরণ এবং রাজনীতির উদ্দেশ্য সাধনে ধর্মকে ব্যবহার করবার প্রবণতা দুটিকে আলাদা করা জরুরি। বাংলাদেশ নামক দেশটিকে মুক্ত বুদ্ধির পক্ষে নিরাপদ রাখবার দায় আমাদের সবার।

syed-Ishtiaque-Reza

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।