আমরা দেখেছি কেমন নির্বাচন হয়েছে!


প্রকাশিত: ০৪:৩০ এএম, ২৩ মার্চ ২০১৬

১৬ কোটি মানুষের এই দেশে কখনোই সাধারণ মানুষের মূল্য ছিল না। সংবিধানে বলা আছে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। এগুলো সবই কেতাবি কথা। বাস্তবতা হলো ক্ষমতাসীনরা দেশের মালিক। তারাই রাজা। আর সবাই প্রজা। সবাই কর দিবে, ক্ষমতাসীনরা তা ভোগ করবে। এভাবেই চলছে শত সহস্র বছর ধরে, এই দেশে। এই নিয়মের মধ্যেও এদেশের মানুষ মাঝে মাঝে ক্ষমতাবান হয়ে যেতো। তাদের মূল্য বেড়ে যেতো। তারা ভোট দিতো। এখনো কেউ কেউ দেয়!

গত দেড়-দুই বছরে এদেশে বেশ ক’রকমের নির্বাচন হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, আর এখন চলছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এতসব নির্বাচনে ভোটও হয়েছে কয়েক রকমের। কেউ নির্বাচন বর্জন করেছে, কেউ ভোট প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে, কেউ ভোট দিতে যায়নি, কেউ ভোট দিতে গিয়ে ফিরে এসেছে। কেউ আগের রাতেই ভোট দিয়ে বাক্স ভরেছে। যেভাবেই হোক ভোট হয়েছে। জনগণ কি তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে? সে এক বিশাল গবেষণার বিষয়!

সবশেষ ইউপি নির্বাচনের প্রসঙ্গেই আসি। স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে তৃণমূলের এই নির্বাচনও রাজনৈতিক পরিচয়ে হলো এবার। প্রথম ধাপে ৭১২টি ইউপির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত অন্তত ২১জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ভোটের দিনই মারা গেছেন ১১জন। পিরোজপুরের এক জায়গায়ই ৫জন মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে। কী এমন লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছিল যে পুলিশ গুলি করে ৫ জনকে মেরে ফেললো? গণমাধ্যমের খবর হলো: “প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণা করতে চাইলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বাধা দেন। এরপরও তিনি ফলাফল ঘোষণা করলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে অবরুদ্ধ করে ফেলেন। খবর পেয়ে র্যা ব ও বিজিবির সদস্যরা কেন্দ্রে যান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুঁড়লে হতাহতের ঘটনা ঘটে।"

ওই যে বললাম মানুষের মূল্য এদেশে কখনোই ছিল না। এমনিতে রেলে লাইনে কাটা পড়ে, পানিতে ডুবে, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে, লঞ্চ ডুবে, সাপের কামড়ে, দুই বাসের রেসে চাপা পড়ে, বিদ্যুৎ স্পৃষ্ঠ হয়ে, ঠাটা পড়ে, আগুনে পুড়ে, ছিনতাইকারীর গুলিতে-ছুরিতে, ক্রসফায়ারে, গুমে নিখোঁজে, লগি বৈঠা কাস্তে কুড়ালের আঘাতে, দেয়াল চাপা পড়ে, পাহাড় ধসে, এমন আরো কতো তুচ্ছ কারণে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। সামাজিক অপরাধের কারণে মৃত্যুর কথা না-ই বা বললাম। এরপরেও সেই দেশে রাজনৈতিক কারণেই মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। রাজনৈতিক কারণ মানেই তো ক্ষমতা, আর ক্ষমতায় যাওয়ার বৈধ পথই হলো ভোট। সেই ভোটের দিনই পুলিশের গুলিতে ভোটারদের মৃত্যু। এসবই স্বাভাবিক কাণ্ড এখন। তবে বলছিলাম বিরোধী দলতো নেই বললেই চলে। এই কাণ্ডগুলো হচ্ছে কেন? হচ্ছে নিজেদের মধ্যে। পুলিশের গুলিতে যারা মারা গেলেন তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের লোক। পুলিশ তাদের গুলি করলো কেন? টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে বা ছররা গুলি ছুঁড়ে তাদের তাড়ানো যেতো না? যেতো। এরপরেও পুলিশ গুলি করলো বোধকরি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথায়।

এবার দেখে আসি ওই ভদ্রলোক কী বলেছিলেন। ২১মার্চ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট কারচুপি হলে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা দায়ী হবেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ওই বক্ত্যবের পর পুলিশ নিশ্চয় ভোটচোরদের জামাই আদর করবে না। তাই পুলিশ গুলি করে দিয়েছে। প্রাণ গেছে সাধারণ মানুষের। যাদের কোনো মূল্য নেই। কারণ ভোটের দিনও তিনি বললেন, ‘গোলযোগ-সংঘর্ষের সঙ্গে জালিয়াতির অভিযোগ উঠলেও সার্বিকভাবে ইউপি ভোট সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে।’ তিনি আরো বললেন, “কেমন ভোট হয়েছে সবাই দেখেছে। প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে কোনো কিছু লুকাবার নেই।”

হ্যা আমরা দেখেছি কেমন নির্বাচন হয়েছে। দেখেছি ভোটকেন্দ্র থেকে প্রতিপক্ষের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে, কোনো কোনো কেন্দ্রে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি, কোথাও কোথাও বুথ দখল করে বা ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মারা হয়েছে, ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, কোথাও কোথাও প্রকাশ্যে ভোট দিতেও দেখা গেছে। আর এসবই ঘটেছে ক্ষমতাসীনদের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ক্ষেত্রে।  আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাবি, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ‘বেশ ভালো’, ‘শান্তিপূর্ণ, ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ এবং ‘স্বচ্ছ’ হয়েছে। তারা বলছে শতকরা ৯৯ দশমিক ৭২ ভাগ ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। এই হিসেব পেলো কোথায়? আওয়ামী লীগের জবাব, ‘৭১৭ ইউনিয়ন পরিষদের সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৮টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত হয়েছে।’ প্রধান নির্বাচন কমিশনারও বললেন, এবার সাড়ে ৬ হাজারের বেশি কেন্দ্র ছিল, এর মধ্যে মাত্র অর্ধশতাধিক কেন্দ্র বন্ধ করতে হয়েছে। এটা অনুপাতে সামান্যই, কোথাও কোনো কমপ্লেইন নেই।”

ক্ষমতাসীন আর নির্বাচন কমিশনের কথার মাঝে একটা মিল পাওয়া গেছে। তাদের উভয়েরই হিসেব হলো সংখ্যা দিয়ে। যেমন অতো কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র অতোটি সহিংসতা হয়েছে। এই আনুপাতিক হার দিয়ে নির্বাচনের স্বচ্ছতা পরিমাপ করা হচ্ছে। এই যদি হয় হিসেবের পরিমাপ তাহলে বলতে হবে খুব কম মানুষই এবার মারা গেছে। কারণ  ইউপি নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটার ১ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ৭৪১ জন। সেই অনুপাতে ১১জন মানুষের মৃত্যুতো কোনো হিসেবেই আসে না। মানুষের মৃত্যুতো এখন সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবেই ঘোরপাক খাচ্ছে। তাদের মূল্য কোথায়? সংখ্যার হিসেবে প্রথম ধাপের নির্বাচন শেষ হলো আরো ৫ ধাপে হবে নির্বাচন। সেই হিসেবে ভোটের দিনই আরো ৫৫ জনের মৃত্যু হবে ধরেই নিতে পারি। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এদেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে আর ৫৫ জন মারা গেলেই কী? প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলবেন সেইটা নগণ্য সংখ্যক আর ক্ষমতাসীনরা বলবে, এটা ধর্তব্যেই পড়ে না। আসলেই আমরা সাধারণ মানুষেরা কখনোই ধর্তব্যের মধ্যে পড়ি না। কেন যে একদিনের জন্য ক্ষমতাবান হতে চাই!

pintu

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।