সেলফি ডিপ্লোম্যাসি!
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ ও কৌতূহল দীর্ঘদিনের। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে সবার নজর এখন বাংলাদেশের দিকে। বিশেষ করে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশকে ঘিরে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর নানা হিসাব-নিকাশ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন, ভারত- সবাই যার যার মতো করে বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে বা নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে নানামুখী চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে। তবে বাংলাদেশ দারুণ দক্ষতায় ভারসাম্য বজায় রেখে কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
গত মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। নতুন ভিসা নীতিতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
ঘোষিত নীতি অনুযায়ী গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে: ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদান। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
মার্কিন ভিসা নীতির পর বদলে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট। বিরোধী দলগুলো অনেকটা নির্বিঘ্নে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারছে। মতপ্রকাশের অধিকার আরও সুনিশ্চিত হয়েছে। সরকার স্বীকার না করলেও মার্কিন চাপেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে। এর আগে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর দারুণ উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিরও।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন দারুণ রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করছে। এটা ঠিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা চাপে সরকার কিছুটা বিপাকে পড়েছিল। আর উল্লাসের ঢেউ ছিল বিরোধী শিবিরে। তাদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল, ক্ষমতায় আসা তাদের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন এসে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব তৎপরতা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য, কাউকে ক্ষমতা থেকে সরানো বা কাউকে বসানোর জন্য নয়। আর বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাও একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের। বর্তমান সরকারও একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর।
সবার চাওয়া একবিন্দুতে মিলে গেলে কারোই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দেশে যত, দেশের বাইরে তৎপরতা তারচেয়ে বেশি। এই সুযোগটাই নিতে চেয়েছিল বিএনপি। জনগণকে বাদ দিয়ে তারা বিদেশিদের কাছে ধরনা দিতে বেশি সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতির কাছে আপাতত হেরে গেছে বিরোধী শক্তি। নির্বাচনের মাঠে কী হবে জানি না, আপাতত কূটনীতির মাঠে এগিয়ে গেছে সরকার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানামুখী তৎপরতার মধ্যেই ভারত তাদের মনোভাব জানিয়ে দিয়েছে। ভারতের স্বার্থেই বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা দরকার সেটা জানাতেও ভোলেনি। বেশি চাপ দিলে বাংলাদেশ চীনের বলয়ে ঢুকে যেতে পারে, শঙ্কা আছে তা নিয়েও। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশকে তাই নানা চাপ সামলাতে এবং সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে দারুণ কৌশলী ভূমিকা নিতে হতো। শেখ হাসিনা তা কাজে লাগিয়েছেন নিপুণভাবে।
নির্বাচন সামনে রেখে জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং শেখ হাসিনার সেলফি কূটনীতি বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবেশ অনেকটাই বদলে দেবে। তবে বিদেশিদের চাপে বা স্বার্থে নয়; একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা বাংলাদেশ কারোই এই চাওয়ার সাথে দ্বিমত নেই। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করে আসা শেখ হাসিনাও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের স্মৃতি মুছে ফেলে একটি ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। গোটা জাতি এখন তাকিয়ে আছে সেদিকেই।
ভারতের নয়াদিল্লিতে দুদিনের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে দারুণভাবে বদলে গেছে পরিস্থিতি। শেখ হাসিনা জি-২০ সম্মেলনে যাওয়ার আগে এ কারণেই ঢাকা সফর করে গেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। আর সম্মেলন শেষে বাংলাদেশে আসছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। মাঝের দুদিন নয়াদিল্লিতে পাশার দান উল্টে দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
জি-২০ সম্মেলনে নানা আয়োজনে শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশ ছিল মনোযোগের কেন্দ্রে। নরেন্দ্র মোদীর সাথে শেখ হাসিনার ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে। সম্মেলনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে শেখ হাসিনার আন্তরিক আলাপ হয়েছে। শেখ হাসিনা এ সময় বাইডেনকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বাইডেন সে আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছেন। এ সময়ের একটি ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
জো বাইডেনের হাতে মোবাইল। তিনি সেলফি তুলছেন। সে ফ্রেমে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার কন্যা ও ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) থিম্যাটিক অ্যাম্বাসেডর সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এই সেলফি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তোলপাড়। এটা ঠিক একটা সেলফিতেই বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব বদলে যাবে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে বিরোধী দল যেমনটি ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে নেই, সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র; এই সেলফি সেই ধারণার পাল্টা ন্যারেটিভ তৈরি করবে। কারণ সেলফি শুধু একটি ক্লিক নয়। দুই নেতার হাস্যোজ্জ্বল অভিব্যক্তি, আন্তরিক আলাপচারিতায় মনে হয় না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার বদলের জন্য তৈরি।
রাতের ডিনারে আরেকটি ছবি এই ন্যারেটিভে আরও যুক্তি দিয়েছে। ডিনারের একটি ছবিতে শেখ হাসিনা, জো বাইডেন এবং নরেন্দ্র মোদী দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। সেখানে আছেন শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানাও। দাঁড়ানোর আন্তরিক ভঙ্গিটাই অনেক কথা বলে। শীর্ষ সম্মেলনের আরও কিছু ছবি প্রমাণ করে, শেখ হাসিনা ছিলেন বিশ্বনেতাদের আগ্রহের কেন্দ্রে।
আরেকটি ছবিতে বসে থাকা শেখ হাসিনার সাথে হাঁটু গেড়ে বসে কথা বলছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। এই ছবিটি মনে করিয়ে দিয়েছে শেখ হাসিনার সাথে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর আরেকটি ছবি। এসব ছবি প্রমাণ করে বাংলাদেশ এখন সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আর ব্যক্তি শেখ হাসিনা নিজেকে তুলে এনেছেন মর্যাদার অন্য উচ্চতায়।
জি-২০ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে শেখ হাসিনার বৈঠক নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুখে যাই বলি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকাকে অস্বীকার করার জো নেই। আর বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক এখন উষ্ণতর। এই সম্পর্ক আর আগের মতো একতরফা নয়। দুই দেশেরই স্বার্থ জড়িয়ে আছে।
ভারতের স্বার্থেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা দরকার। কারণ বাংলাদেশ চাইলে ভারতের সাত রাজ্য অস্থির করে তুলতে পারে। অতীতে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকতে সেটার প্রমাণও তারা পেয়েছে। তাই ভারত চাইবে না বাংলাদেশে আবার ভারতবিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায় আসুক। নিজেদের স্বার্থেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের মনোভাব জানিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আর যাই হোক, উপমহাদেশে ভারতের স্বার্থের বাইরে যেতে চাইবে না। যুক্তরাষ্ট্রের চাপাচাপির সুযোগে চীন বা রাশিয়া এখানে আধিপত্য বিস্তার করুক, এটা ভারত বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই চাইবে না।
নির্বাচন সামনে রেখে জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং শেখ হাসিনার সেলফি কূটনীতি বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবেশ অনেকটাই বদলে দেবে। তবে বিদেশিদের চাপে বা স্বার্থে নয়; একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা বাংলাদেশ কারোই এই চাওয়ার সাথে দ্বিমত নেই। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করে আসা শেখ হাসিনাও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের স্মৃতি মুছে ফেলে একটি ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। গোটা জাতি এখন তাকিয়ে আছে সেদিকেই।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস