ড. ইউনূস
নোবেলজয়ী বলেই কি আইনের ঊর্ধ্বে?
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।‘কিন্তু ড.ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলা হওয়ার পরই দেশি-বিদেশি একটি চক্র তাকে বাঁচাতে উঠে পড়ে লেগেছে। গত ১৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওমাবা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে হয়রানি করা হচ্ছে বলে উদ্বেগ জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন।
যদিও ১০ দিন গোপন রাখার পর ২৭ আগস্ট ‘ইউনূস সেন্টার’ থেকে চিঠিটি প্রকাশ করা হয়েছে। সেদিনই আবার দেশের ৩৪ জন সুশীল নামধারি ব্যক্তি এক বিবৃতিতে ড.ইউনূসের প্রতি সরকারের আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করে। এর পরেই বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিনটন ও শতাধিক নোবেলজয়ী ব্যক্তিদের নিয়ে ১৬০ জন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নামে একটি খোলা চিঠি পাঠান। চিঠিতে ড.ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আহ্বান জানান।
বিবৃতিদাতারা অবিলম্বে ড.ইউনূসের বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের দাবি জানিয়েছেন। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। একটা বিচারাধীন বিষয় কিভাবে প্রধানমন্ত্রী স্থগিত করতে পারেন?দেশের প্রচলিত আইনে চলমান মামলা স্থগিতের আহ্বান আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থি।দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের শামিল। শ্রম আদালতে তো সরকার মামলা করে নাই, অধিকার বঞ্চিত শ্রমিককেরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে ১৮ টি মামলা করেছে। যারা ২০০৬ সালের আগেই গ্রামীণ ফোন কোম্পানিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
ড. ইউনূস কোনো ধোঁয়া তুলসীপাতা নন। গত ২৩ জুলাই তাকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত দানকর ফাঁকির মামলা ১২ কোটিরও টাকা জরিমানা করে। দুই দিনের মধ্যে তিনি বকেয়া দানকরের ১২ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার ৬০৮ টাকা পরিশোধ করতেও বাধ্য হন। এছাড়া আরো তিন হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগের দুদকে তদন্ত চলছে।
শ্রম আইন লঙ্ঘন ও দুর্নীতির মামলা থেকে বাঁচতে আবারও তিনি পুরনো কৌশল নিয়েছেন। গত ৩১ আগস্ট কোটি টাকা খরচ করে নিউইয়র্ক টাইমসে বিজ্ঞাপন আকারে খোলা চিঠি ছাপিয়েছেন। এর আগেও একই কায়দায় ৪০ বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরিত খোলা চিঠি কোটি টাকা খরচ করে ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বিদেশি বিবৃতিদাতাদের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। বিবৃতি না দিয়ে এক্সপার্ট পাঠান। মামলার দলিল দস্তাবেজ দেখুন। তাহলেই বুঝতে পারবে এখানে অপরাধ হয়েছে কিনা?’এবিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আরো স্পষ্ট করে হিলারি ক্লিনটনকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন,‘শ্রম আদালতে এলেই বুঝতে পারবেন তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে কি করেছেন। না দেখে সমালোচনা করাটা আমাদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। আপনি দুজন এক্সপার্ট নিয়ে আসেন। আপনাকে সব কাগজপত্র দেয়া হবে। তারপর আপনার সিন্ধান্ত দেন।’
১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ড.ইউনূসকে গ্রামীণ ফোনের লাইসেন্স দেন। তখন বিএনপি নেতা মোরশেদ খানের সিটিসেল মোবাইল কোম্পানি দেশে একচেটিয়া ব্যবসা করেছিল। গ্রামীণ ফোনকে লাইসেন্স দেয়া অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রসংশা করে ড.ইউনূস তখন বলেছিলেন, ‘এই লাইসেন্স পাওয়ার জন্য কোথাও আমাকে এক কাপ চা পর্যন্ত খাওয়াতে হয়নি।’এবং একই বছর সরকার বাজেট থেকে গ্রামীণ দারিদ্র্য মোচনের জন্য গ্রামীণ ব্যাংককে ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দিয়েছিল।
ড. ইউনূস মুখোশের আড়ালে ছদ্মবেশী বকধার্মিক। তিনি নিজের সুবিধার জন্য সব দলের সরকারকে ম্যানেজ করে স্বার্থ উদ্ধার করেছেন। দেশের কোনো সংকটে কখনো তাকে দেখা যায় না। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে তার কোনো বক্তব্য নেই। বরং দেশের স্বার্থে বিরুদ্ধে গিয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ বন্ধে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি নিজেকে গরীবের বন্ধু দাবি করলেও,আসলে তিনি গরীবের রক্তচোষা একজন সুদখোর প্রতারক।
কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরই তিনি ভোল পাল্টে ফেলেন। বিএনপির যাবতীয় কুকর্মের বিষয়ে নিরব সমর্থন দিতে থাকেন। তখন সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ভয়াবহ নির্যাতন হয়েছিল। সেসময়ও তিনি নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দেশরত্ন শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলার পরও তার নিরবতা পুরো জাতিকে বিস্মিত করেছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক বিপর্যয় কোনো ইস্যুতে ড.ইউনূসকে পাওয়া যায় না। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরই তার বাংলাদেশের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন জাগে। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে টানটান উত্তেজনা তখন যে ১/১১ সরকার ক্ষমতায় আসে তার পিছনে ড. ইউনূসের হাত ছিল। ড.ফখরুদ্দিন আহমেদকে তার সুপারিশেই প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। এবং সরকারের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তখন দেশে জরুরি অবস্থায় রাজনীতি নিষিদ্ধ, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি নিজে একটা দল গঠন করেন,যদিও জনগণের সাড়া না পেয়ে অল্প দিনের মধ্যে নিজেকে রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নেন।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সুবিধাবাদী ড.ইউনূসের অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়। দেখা যায়, ড.ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সরকারের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদায় চাকুরি করেন। অন্যান্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের যেভাবে অবসর নিতে হয়, তার ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। কিন্তু তিনি ছিলেন সকল নিয়মকানুনের ঊর্ধ্বে। তখনই তিনি প্রায় দশ বছর অবৈধভাবে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ দখল করে ছিলেন। সরকার আইনগত ব্যবস্থা নিলে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক তিনি পরাজিত হয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ ছাড়তে বাধ্য হন। তখনও হিলারি ক্লিনটন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ড. ইউনূসের জন্য অন্যায় আবদার করে ফোন করেছিলেন। কিন্তু সেদিনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যায় আবদারের কাছে মাথা নত করেননি।
নোবেলজয়ী মানেই তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নন। এর আগেও বিভিন্ন দেশের নোবেলজয়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা ও সাজা হয়েছে। অতি সম্প্রতি বেলারুশের শান্তিতে নোবেল জয়ী অ্যালেস বিলিয়াতস্কিকে ফৌজদারি মামলায় ১০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছে সেদেশের আদালত। মিয়ানমারের শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চি কে ৩৩ বছর, চীনের শান্তিতে নোবেল জয়ী লিউ শিয়াবোকে কারাদণ্ড দিয়েছিল আদালত। উভয়কেই দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়েছে। এমনকি লিউ শিয়াবো তো বন্দি থাকা অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছেন। এছাড়া জার্মানের শান্তিতে নোবেল জয়ী ভন অজিয়েস্কিকেও কারাবরণ করতে হয়েছে। ভারতের বাঙালি নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ করেছে বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এবিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা চলমান রয়েছে।
১৯৮৩ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের সামরিক শাসনামলে গ্রামীণ ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। সেসময় গ্রামীণ ব্যাংকের মূলধন ছিল মাত্র তিন কোটি। যার মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখ সরকারের এবং ১ কোটি ২০ লাখ ছিল ঋণ গ্রহীতাদের। অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংকে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত কোনো টাকা ছিল না। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক সরকার এবং ঋণ গ্রহীতা জনগণ। কাগজে কলমে ড.ইউনূস ব্যাংকের একজন বেতনভুক্ত কর্মকর্তা। অথচ তিনি এই গ্রামীণ ব্যাংককে ব্যবহার করেই সবকিছু পেয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় গড়ে তুলেছেন তার নিয়ন্ত্রাধীন ২৮ টি প্রতিষ্ঠান। হয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক।
অন্যদিকে ড.ইউনূসকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ফোনের লাইসেন্স দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর লভ্যাংশ দেশের দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্যবহার করা হবে বলে তখন অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু তিনি শুধু নিজের ভাগ্যই পরিবর্তন করেছেন। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নরওয়ের টেলিনর কোম্পানির কাছে গ্রামীণ ফোনের অধিকাংশ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। যার কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ড.ইউনূস হিলারি ক্লিনটনের সাথে সুসম্পর্ককে পুঁজি করে তিনি সবসময় আইনকে অগ্রাহ্য করে চলেছেন।
ড. ইউনূস মুখোশের আড়ালে ছদ্মবেশী বকধার্মিক। তিনি নিজের সুবিধার জন্য সব দলের সরকারকে ম্যানেজ করে স্বার্থ উদ্ধার করেছেন। দেশের কোনো সংকটে কখনো তাকে দেখা যায় না। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে তার কোনো বক্তব্য নেই। বরং দেশের স্বার্থে বিরুদ্ধে গিয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ বন্ধে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি নিজেকে গরীবের বন্ধু দাবি করলেও,আসলে তিনি গরীবের রক্তচোষা একজন সুদখোর প্রতারক।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
haldertapas80@gmail
এইচআর/জিকেএস