হাতের মুঠোয় চাঁদ পেলো ভারত মানবসভ্যতা এগোলো বহুদূর

ফারাজী আজমল হোসেন
ফারাজী আজমল হোসেন ফারাজী আজমল হোসেন
প্রকাশিত: ১১:২১ এএম, ২৫ আগস্ট ২০২৩

১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। এই তারিখটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে আজীবন লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। কেননা এই দিনটিতে প্রথমবারের মত চাঁদের মাটিতে অবতরণ করে মানুষ। মহাকাশে দীর্ঘ এক মাস নয় দিনের যাত্রা শেষে ভারতের মহাকাশযান 'চন্দ্রায়ন-৩' চাঁদের বুকে অবতরণ বা ‘সফট ল্যান্ডিং’য়ের মাধ্যমে নতুন করে সেই ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে। মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় এটিও এক মাইলফলক হিসেবে আজীবন চিহ্নিত হবে।

চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফল অবতরণের পর বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে ভারত। দেশটির আগে চাঁদের বুকে সফল অবতরণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান রাশিয়া। ভারত চাঁদ জয়ের এই কাজটিও করেছে সবচাইতে কম খরচে যা তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। ভারতের এই চন্দ্রাভিযানে মোট খরচ হয়েছে ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অপরদিকে সম্প্রতি চাঁদে বিধ্বস্ত হওয়া রাশিয়ার চন্দ্রযান 'লুনা-২৫'-এর খরচ ছিল ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তুলনা করলে প্রমাণ হয় ভারত রাশিয়ার থেকে অর্ধেকেরও কম খরচে একটি সফল ল্যান্ডিং উপহার দিয়েছে বিশ্বকে যা নিশ্চিতভাবেই মহাকাশ বিজ্ঞানে নতুন এক মাইল ফলক।

চন্দ্রায়ন-৩ মিশনটি ১৪ জুলাই শ্রীহরিকোটা থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে থাকা ল্যান্ডার বিক্রম প্রতি সেকেন্ডে ১ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার বেগে চাঁদের পৃষ্ঠের দিকে নামতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত নিরাপদে ল্যান্ড করে চাঁদের সেই অংশে যেখানে আগে কেউ ল্যান্ড করতে পারেনি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের পূর্ববর্তী চাঁদ ও মঙ্গল মিশনগুলোও অল্প খরচে পরিচালিত হয়েছিল। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর। ‘পণ্যের অপচয়’ সংস্থাটি বিশেষ প্রচেষ্টার দিকে সবসময় নজর দিয়েছে। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা বেশ বিস্ময়ের সঙ্গেই তাই জানতে চেয়েছিলেন, কিভাবে ভারতের মঙ্গল মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও কম খরচ হয়েছে? এর ব্যাখ্যায় যুক্তরাজ্যের মহাকাশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক অ্যান্ড্রু কোটস জানান, ভারত মঙ্গলযানটি ১৫ কেজির মধ্যে রেখেছে। যার কারণে তারা ছোট করে সফল মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে। ইসরোর সিনিয়র বিজ্ঞানীরা জানায়, ভারতের উৎক্ষেপণ খরচ এখনও কম হতে পারে। কারণ দেশটি দক্ষিণ রাজ্য তামিলনাড়ুর কুলাসেকারাপট্টিনমে একটি নতুন মহাকাশ স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। নির্মাণ সম্পন্ন করতে পারলে মহাকাশযান উৎক্ষেপণের জন্য এটি হবে আদর্শ স্থান, পাশাপাশি পরিবহন খরচ অনেক কমে যাবে।

আরও একটি ক্ষেত্রে চন্দ্রায়ন-৩ অনন্য। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৩৪ মিনিটে চন্দ্রপৃষ্ঠে সফলভাবে ভারতের এই ল্যান্ডারটি অবতরণ করে। এর আগে কোনো দেশ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফট ল্যান্ডিং করতে পারেনি। চাঁদের এই অঞ্চল সবসময় অন্ধকার এবং ছাঁয়াযুক্ত থাকায় বিজ্ঞানীরা এখানে পানির উৎস থাকতে পারে বলে মনে করেন। এই অংশে মিশন পাঠানোর মূল উদ্দেশ ছিল পানির সন্ধান। সেই হিসেবে এই মিশন অনন্য এক বার্তা দিতে পারে মানবসভ্যতার জন্য। আগামী ১৩ দিনে হয়ত এ বিষয়ে আরও নতুন সব তথ্য মিলবে।

মানব সভ্যতার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক নিদর্শন হয়ে রয়েছে চন্দ্রায়ন-৩। চন্দ্রায়ন-৩ যখন ভারতের মহাকাশ ট্র্যাকিং স্টেশনের নজরদারির বাইরে ছিল তখন মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ইসএ সংস্থা দুটি ইসরোর বিজ্ঞানীদের যানটি ট্র্যাক করতে সহায়তা করেছে। সেই সঙ্গে সফলভাবে চাঁদে অবতরণের জন্য ভারতীয় মহাকাশ সংস্থা ইসরোকে অভিনন্দন জানিয়েছে তারা।

নাসার প্রধান বিল নেসলন লিখেছেন, চন্দ্রায়ন-৩ সফলভাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করায় ইসরোকে অভিনন্দন। সেই সঙ্গে চাঁদে অবতরণকারী চতুর্থ দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করায় ভারতকে অভিনন্দন। আমরা এই মিশনে আপনার অংশীদার হতে পেরে আনন্দিত! ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার (ইএসএ) মহাপরিচালক জোসেফ অ্যাশবাচারও অভিনন্দন জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে এই অভিযানের অংশ হতে পেরে তিনি ইসরোকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, অবিশ্বাস্য! নতুন প্রযুক্তি প্রদর্শন এবং মহাকাশে ভারতের প্রথম সফট ল্যান্ডিং করার গৌরব অর্জন করায় ইসরো, চন্দ্রায়ন-৩ এবং ভারতবাসীকে অভিনন্দন।

বুধবার সন্ধ্যায় অবতরণের নির্ধারিত মুহূর্তটি সফলভাবে পার হয় কি না, তার জন্য কোটি কোটি ভারতবাসী অধীর উৎকণ্ঠা নিয়ে টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষা করছিলেন- যেখানে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর দেওয়া অভিযানের প্রতিটি মুহূর্তর আপডেট লাইভ সম্প্রচার করা হচ্ছিল। ভারত সন্ধ্যা ছ’টা বাজার মিনিট-কয়েক পরেই সেই সফট ল্যান্ডিং সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার ঘোষণা হতেই সারা দেশ উল্লাসে ফেটে পড়ে। রাস্তায় রাস্তায় আতসবাজি ফাটানো ও মিষ্টি বিলি করা শুরু হয়ে যায়- অনেকেই তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা নাড়াতে শুরু করে দেন।

সফলতার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, এই মুহূর্তটি হল নতুন ভারতের নতুন উড়ান! আজ নতুন ভারতের বিজয় ঘোষিত হল। এই মুহূর্তটি আসলে ১৪০ কোটি ভারতীয়র হৃৎস্পন্দনের শক্তি! তিনি আরও বলেন, ভারতের সফল চন্দ্রাভিযান শুধু ভারতের একার নয়। মিশনটি মানবজগতে উন্নতির এবং এর সাফল্য সমগ্র মানবজাতির জন্য।

আসলেই তাই। মহাকাশে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার পাশাপাশি বেশ প্রাসঙ্গিকভাবেই আলোচনায় আসে নির্ভুল পরিকল্পনা ও খরচ হ্রাসের বিষয়টি। যা বেশ সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশের প্রতিবেশী সেই সঙ্গে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে সবচাইতে দৃঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্ক রক্ষা করা ভারতের এই অর্জনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসা জানিয়েছেন বাংলাদেশের নাগরিকেরা।

চতুর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চাঁদের পৃষ্ঠে মহাকাশযান অবতরণের সাফল্যে ভারতকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনের নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌজন্য সাক্ষাতের সময় সরাসরি এই অভিনন্দন জানান। চন্দ্রায়ন-৩-এর এই সাফল্যের জন্য দেশটির জনগণ এবং ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো) এবং এর বিজ্ঞানীদেরও অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানান, এই গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষে ও ঐতিহাসিক অর্জনে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশও আনন্দিত। এটি বিজ্ঞান ও মহাকাশ প্রযুক্তি খাতে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের এবং অনুপ্রেরণার বিষয় বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে অসংখ্য পোস্ট চোখের সামনে ভাসছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের এই অর্জনের প্রশংসা বিশ্ব জুড়ে। বিশ্বের সকল গণমাধ্যমে এই দিনটিতে ছিলো ভারতের এই অর্জনের কথা।

এই চন্দ্রযান প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ইসরোর বিজ্ঞানী তুষারকান্তি দাস নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এ এক অনন্য অনুভূতি, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম, চিন্তা, চেষ্টা আর অনেক পরিকল্পনার যোগফল যেন আমাদের এই সাফল্য। আমি এবং আমার প্রত্যেক সহকর্মী এত দিন এই আনন্দভরা সন্ধ্যাটার জন্যেই তো অপেক্ষা করে ছিলাম! চাঁদের বুকে দেখতে চেয়েছিলাম ঠিক এমনই একটা ভোর। এখনও পর্যন্ত চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৃথিবীর আর কোনো দেশ যেতে পারেনি। রাশিয়া কিছু দিন আগে চেষ্টা করেছিল বটে কিন্তু ওরা ব্যর্থ হয়েছে। আমরাই প্রথম চাঁদের ‘কুমেরু’ জয় করলাম।

চাঁদের সফট ল্যান্ডারটির নাম দেয়া হয়েছিলো 'বিক্রম'। ইসরোর বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, চন্দ্রায়ন-২ এর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার প্রতিটি পরীক্ষা করা হয়েছিলো আরও বিশ্লেষণাত্মকভাবে। এ জন্য চাঁদের পৃষ্ঠে থাকা গর্ত এবং পাথরের ম্যাপিং করে নেয়া হয়েছিলো। ফলে বিক্রম আগে থেকেই জানতো তাকে কোথায় ল্যান্ড করতে হবে। তারপরও যে কোন দুর্ঘটনার জন্য নেয়া হয়েছিলো প্রস্তুতি।

সফট ল্যান্ডিংয়ের পর এখন পরবর্তী ১৪ দিন (যেটা এক চান্দ্র দিবসের সমান) ধরে চন্দ্রায়ন-থ্রির মুন রোভার ‘প্রজ্ঞান’ চাঁদের বুক থেকে নানা ছবি ও ডেটা পাঠাতে থাকবে। ১৪ দিন পর প্রজ্ঞান রোভারের সক্রিয়তা ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর কারণ এটির শক্তির উৎস হল সৌরশক্তি চালিত সোলার সেল- আর একটা পর্যায়ের পর ওই সেলগুলো সূর্যালোকের আড়ালে চলে যাবে। এরই মধ্যে চাঁদের নতুন ছবি পাঠিয়েছে বিক্রম। ইসরোর শেয়ার করা ছবিগুলো ল্যান্ডার বিক্রমের হরাইজন্টাল ভেলোসিটি ক্যামেরা দিয়ে তোলা হয়েছে।

মানব সভ্যতার দীর্ঘ যাত্রায় এখনো অনেক কিছুই রয়ে গেছে অজানা। সেই অজানার হাতছানিতে যেমন মহাকাশে ছুটে বেড়িয়েছে মানুষ, তেমনিভাবে খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে সমুদ্রের তলদেশ ও পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের কেন্দ্র। বিজ্ঞানের এই যাত্রায় যে কোন অর্জনই মানব সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কারণেই স্বল্প খরচে সফলভাবে চাঁদের বুকে অবতরণের মাধ্যমে মানব সভ্যতার এক নতুন অধ্যায় রচনা করলো ভারত।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।