ব্রিকস সম্মেলন ও নয়া বিশ্বব্যবস্থা
সারাবিশ্বের দৃষ্টি এখন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ২২শে আগস্ট থেকে ২৪ শে আগস্ট অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ১৫তম ব্রিকস সম্মেলনের দিকে। বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচ দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত জোট ’ব্রিকস’। মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাক্সের সেসময়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও‘নিল ২০০১ সালে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির চার দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীনের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে ‘ব্রিক’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। তার এই ধারণাটিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ছিল উদীয়মান অর্থনীতির এই দেশগুলো।
ফলশ্রুতিতে, ২০০৬ সালে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সম্মেলন চলাকালীন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উদ্যোগে চার দেশের মন্ত্রীরা জোটের কার্যক্রম নির্ধারণের লক্ষ্যে আলোচনায় বসে। পরবর্তীতে, ২০০৯ সালে রাশিয়ায় ব্রিকের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা এই জোটে যোগদানের ঘোষণা দিলে এই জোটের নাম ব্রিক থেকে ব্রিকস হয়। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি পারস্পারিক সহযোগিতা ও সমৃদ্ধি অর্জনে কাজ করার জন্য গড়ে উঠে ব্রিকস।
তবে, অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আধিপত্য বজায় রাখার জন্য উন্নত দেশগুলোর জোট জি-সেভেনের প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবেই চীন ও রাশিয়া এই জোট গঠন করেছে। বর্তমানে ব্রিকস অর্থনৈতিকভাবে অন্যতম বৃহৎ শক্তিশালী একটি জোটে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের বিনিয়োগ বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ব্রিকসের সদস্য এই পাঁচ দেশের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ। বিশ্বের অর্থনৈতিক জিডিপির ৩১ শতাংশ বা এক তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা। বিশ্ব বাণিজ্যেরও ১৬ শতাংশ এই পাঁচটি দেশের দখলে। বর্তমানে ব্রিকস সম্মিলিতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৪৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের যত পণ্যসেবা উৎপাদন হয় তার ২১ শতাংশ আসে ব্রিকসভুক্ত এই পাঁচটি দেশ থেকে। পাশাপাশি, প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো অনেক সমৃদ্ধ। তারা বিশ্বের ২৬ শতাংশ তেল, স্টিল তৈরির জন্য ৫০ শতাংশ আকরিক লৌহ, কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ৪৬ শতাংশ গম, ৪০ শতাংশ ভুট্টা উৎপাদন করে।
২০১৪ সালে ব্রিকস নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। চীনের সাংহাইয়ে এই ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। প্রথমদিকে, ব্যাংকটি ৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রাথমিক মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে। তবে, এই পাঁচ দেশের বাইরেও এর সদস্য হওয়ার পথ উন্মুক্ত রাখা হয়। করোনাকালীন সময়ে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে এবং মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উরুগুয়ে ও বাংলাদেশ এই সময় সদস্যপদ লাভ করে।
ধারণা করা হচ্ছে, ব্রিকস জোটের এই নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী হবে। ধারণা কিন্তু নিছক নয় অনেক দেশেই এখন এই জোটে যোগ দিতে আগ্রহী। এশিয়া, আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত বিশ-পঁচিশটি দেশ এই তালিকায় আছে। এদের মধ্যে অনেকে আনুষ্ঠানিক আবেদন করেছে, অনেকে আবার মৌখিকভাবে আবেদন করে রেখেছে।
এবারের এই ব্রিকস সম্মেলন বৈশ্বিক অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি ও বিশ্বব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত করতে পারে। তবে, ব্রিকসকে নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় আরো বেশি কার্যকর করে তুলতে হলে সকল সদস্য দেশগুলোকে অভিন্ন মুদ্রা , নতুন সদস্য গ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করতে হবে। নতুবা, ব্রিকস তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে।
ব্রিকস আরো সম্প্রসারিত হলে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। কোভিড-১৯ মহামারির পর এই ১৫তম সম্মেলনই প্রথম সরাসরি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ কারণে এবারের সম্মেলনের আলাদা রকমের গুরুত্ব রয়েছে। ইতিমধ্যে, ব্রিকসভুক্ত পাঁচ দেশের মোট জিডিপি পশ্চিমা জোট জি-সেভেনের সাত দেশের জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে, ব্রিকসের হাত ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে পশ্চিমাদের আধিপত্য লাঘবের স্বপ্ন দেখছে বহু দেশ। তাছাড়া, এবারের ব্রিকস সম্মেলনের ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এবারের সম্মেলনে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে একটি অভিন্ন মুদ্রা চালুর উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্য হ্রাস করার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপের ফলে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সংস্কারের সম্ভাবনা রয়েছে এবং এই পদক্ষেপ মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করবে।
দশকের পর দশক ধরে মার্কিন ডলার বিশ্ব বাণিজ্য ও লেনদেনে সর্বোচ্চ রাজত্ব করছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনন্য অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা প্রদান করছে। প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে ও বল প্রয়োগ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিনিময় মুদ্রা ডলার ও অর্থনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। করোনা মহামারি পরবর্তী বাস্তবতা ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো তাদের নিজেদের জন্য অভিন্ন মুদ্রা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করতে চাইবে হয়ত এবারের এই সম্মেলনে।
এবারের সম্মেলন থেকেই বিশ্বব্যবস্থায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়া মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক মেরুকরণ দৃশ্যমান হয়। এমন বাস্তবতায় এক যুগেরও বেশি আগে যাত্রা করা ব্রিকসকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের বিকল্প হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে অনেকে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোকে এ কারণে ক্রমেই ব্রিকসের দিকে ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে।
এছাড়া, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দেখা যাচ্ছে, ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো নিজেদেরকে এ যুদ্ধের ব্যাপারে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলাদা রাখছে। ব্রিকসভুক্ত কোন দেশই ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে বরং নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক আরো জোরদারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
মোটাদাগে, বলতে গেলে এবারের এই ব্রিকস সম্মেলন বৈশ্বিক অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি ও বিশ্বব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত করতে পারে। তবে, ব্রিকসকে নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় আরো বেশি কার্যকর করে তুলতে হলে সকল সদস্য দেশগুলোকে অভিন্ন মুদ্রা , নতুন সদস্য গ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করতে হবে। নতুবা, ব্রিকস তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা।
এইচআর/জিকেএস