বাজারে সিন্ডিকেট, সড়কে এক দফা, দুর্বিষহ নাগরিক জীবন
বড় দুই দলের এক দফা কর্মসূচি চলমান। পত্রিকা ও টেলিভিশনে সেই কর্মসূচির খবর- ছবি প্রচার হচ্ছে ফলাও করে। এতে জনগণের দুর্ভোগের বিষয়টি আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তাদের কর্মসূচির দিন পথে বের হয়েছেন যারা তারাই বলতে পারবেন কি দুর্দশায় পড়তে হয়। গণপরিবহন চলাচল করে কম। যেগুলো চলে তার ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। বাজারের অবস্থা আরও করুণ। বেড়েই চলছে মাছ, মুরগি ও ডিমের দাম। মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্য। এসব দেখার কেউ নেই। কারও কোনো দায় নেই।
বড় দুই দল তাদের এক দফা নিয়ে রাস্তায় পদযাত্রা আর শোভাযাত্রা বের করে। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন কাজে বের হওয়া লোকজন। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ ও খেটে খাওয়া লোকজনকে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে সড়কের একপাশ বন্ধ থাকায় দীর্ঘ সময় আটকে থাকে যানবাহন।
এছাড়া অফিস শেষে বাড়িফেরা মানুষজনও গণপরিবহন না পেয়ে পড়েন বিপাকে। প্রধান দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা সাধারণ মানুষকে শঙ্কিত করে তুলেছে। এসব দেখার কেউ নেই, কারও দায় নেই।
প্রধান দুই দল এভাবে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন অব্যাহত রাখলে পরিস্থিতি রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ধাবিত হবে। তাই আগামীতে কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে দুই দলকেই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পরিহারের উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে রাজনীতি সংঘাতের দিকে যাবে। গণমানুষের দুর্ভোগ বাড়বে।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন কর্মদিবসের পরিবর্তে সরকারি ছুটির দিনে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের কর্মসূচি পালনের জন্য দলগুলোর নেতাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। কেউ কেউ শহরের বাইরে পূর্বাচলে এবং পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে এ ধরনের কর্মসূচির জন্য জায়গা নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়েছেন।
জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দল এবং যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের মধ্যেই গত মাসের শেষ সপ্তাহে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের পাল্টাপাল্টি এক দফা ঘোষণা সাধারণ নাগরিকদের শঙ্কিত করে তুলেছে।
রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি থাকবেই, এর সঙ্গে এদেশের মানুষ পরিচিত। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে প্রধান দুই দল কর্মদিবসে একই দিনে কাছাকাছি অবস্থানে তাদের সমাবেশ করছে। এতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে থাকে। কখন জানি মারামারি লেগে যায়। আয়োজকরা সংঘর্ষে না জড়ালেও সুযোগসন্ধানী তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিতে পারে। এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সাধারণ মানুষের আরেক আতঙ্ক বাজারে সিন্ডিকেটের ভূত। সংকট নেই, তারপরও সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম আরেক দফা বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রাজধানীতে এখন ব্রয়লার মুরগির একটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। আর এক ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৬৫ টাকায়।
খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, করপোরেট ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়াচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে ক্রেতাদের কাছে বেশি দরে বিক্রি করছেন তারা। রাজধানীর বাজারগুলোতে দেখা গেছে, আকারে সবচেয়ে ছোট ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। একটু বড় সাইজের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকায়। তবে কোনো ক্রেতা কেবল একটি ডিম কিনলে তাকে দিতে হচ্ছে ১৫ টাকা।
ব্রয়লার মুরগির কেজি আবার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছ-মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিমের চাহিদা বেড়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ডিমের দাম বাড়িয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কথা হচ্ছে, এসব দেখার কি কেউ নেই।
নিত্যপণ্যের বাজার ক্রমে লাগামহীন হয়ে পড়ছে। শাকসবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে স্বল্প আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। নিত্যপণ্যের খরচ পোষাতে না পেরে বাজার থেকে খালি ব্যাগ হাতে নিয়ে ফেরার মতো অবস্থা অনেকের। প্রতি মাসেই আয়ের সাথে ব্যয়ের বড় ফারাক তৈরি হচ্ছে। সংসার চালাতে অনেকেরই ধারদেনা করতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে ঋণের বোঝা।
আমরা সবসময় বলি বাজার মনিটরিং করতে হবে। সরকারের দপ্তর থেকেও নানা রকম হুংকার দেওয়া হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। সিন্ডিকেট নামের ভূতের কাছে সবাই ধরা খেয়ে যায়। এভাবে আর চলবে কতকাল?
বৈশ্বিক ভোগ্যপণ্যের বাজারে মূল্যের অস্থিতিশীলতার কারণে আমদানি করা পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। এজন্য কোভিডের প্রাদুর্ভাব থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের ব্যাঘাতসহ নানাবিধ কারণকে দায়ী করা হয়েছে। যদিও গত কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি থেকে শুরু করে অধিকাংশ পণ্যের দাম অব্যাহত হারে কমেছে।
কোনো কোনো পণ্যের দাম এরই মধ্যে প্রাক-কোভিড পর্যায়ে নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য ক্রমেই কমতে থাকায় বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতির চিত্রে দেখা গেছে বড় পরিবর্তন। দেশের বাজারে অবশ্য পুরোপুরি বিপরীত চিত্র। ভোগ্যপণ্যসহ সব পণ্যের দাম এখনো অস্থিতিশীল। নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতির হার। কিন্তু কেন? কার কাছে মিলবে এর জবাব?
সারাদেশের দিনমজুর, শ্রমিকসহ বেসরকারি পেশাজীবীরা যে আয় করছেন, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির এ চাপ সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। উল্টো আরও বেশি খরচের বোঝা চাপছে তাদের মাথায়। সঞ্চয় ভেঙেও জীবনযাত্রার চাহিদা মেটানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। শিক্ষিত যুবসমাজও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, পরীক্ষার দামি মার্কশিট আর সার্টিফিকেটের ভারের মতোই বেকারত্বের যন্ত্রণা বহন করে যেতে হবে অনবরত।
কারণ, আমাদের দেশে দৈন্যদশা আপাতত প্রকট। আর্থিক এ সংকট থেকে মুক্তি পেতে সরকারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। ঋণ নেওয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকেও। তারপরও মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দেওয়া যাচ্ছে না কেন?
আমরা সবসময় বলি বাজার মনিটরিং করতে হবে। সরকারের দপ্তর থেকেও নানা রকম হুংকার দেওয়া হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। সিন্ডিকেট নামের ভূতের কাছে সবাই ধরা খেয়ে যায়। এভাবে আর চলবে কতকাল?
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম