মশার কামড়ে প্রাণ যায় কর্তৃপক্ষ কোথায়?
করোনা মহামারির ক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছিলাম। অন্যতম কারণ ছিল টিকা। বিশ্বের উন্নত অনেক দেশকে টেক্কা দিয়ে বাংলাদেশ টিকা সংগ্রহ করতে পেরেছিল। বিপুলসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছিল। ফলে মহামারি থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু ফি বছর ডেঙ্গুর আক্রমণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। বরং ডেঙ্গু আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। একমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাড়া সারাদেশে ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। হাসপাতালে আর্তচিৎকার। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অন্তঃস্বত্ত্বা কেউ বাদ যাচ্ছে না। মৃত্যুর বিভীষিকায় মানুষগুলো সংখ্যা হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুমিছিল বাড়ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষীয় বাণী-বিবৃতি যতটা গর্জাচ্ছে, কার্যক্ষেত্রে ততটা বর্ষে না। দুই সিটি করপোরেশন চূড়ান্তরূপে ব্যর্থ মশা নিধনে। ডেঙ্গুর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় বেড়ে গেছে স্যালাইনসহ জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম। রক্ত, প্লাটিলেট সংগ্রহ, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে লোকজন। ফলে দুর্ভোগ যেন নিয়তি।
উদ্বেজনক হচ্ছে, মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী আক্রান্তের সংখ্যা আগস্টে এসে দাঁড়িয়েছে ৭৯৩ জনে। মৃত্যু দুই শতাধিক। এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ৪০ হাজার ৩৪১ জন। তাদের মধ্যে শুধু ঢাকার বাসিন্দা ২৩ হাজার ৬৭৬ জন। ঢাকার বাইরে হাসপাতালে আরও ভর্তি ১৬ হাজার ৬৬৫ জন। একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১৫ জনে। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, এমন শঙ্কার কথা জানান বিশেষজ্ঞরা।
দুই বছর ধরে দেশে ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। প্রাণঘাতী রোগটি যারপরনাই দুর্ভাবনার কারণ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা নাক ও দাঁত দিয়ে এবং কাশির সময় রক্তক্ষরণে ভুগে থাকে। এছাড়া আক্রান্তরা পিঠ, দাঁত, মাথা ও চোখের পেছনে ব্যথা অনুভব করে। ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে আক্রান্তদের অবস্থার উন্নতি না হলে তাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার আগে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাওয়ারও দরকার নেই। চিকিৎসকরা এক্ষেত্রে সচেতনতার কথাও বলেন। বিশেষ করে রোগীকে বেশি মাত্রায় পানি কিংবা শরবত খাওয়ানো যেতে পারে। এডিস মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য দিনের বেলায়ও ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা উচিত।
বাসায় খোলা পাত্রে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এছাড়া ফুলের টবে জমে থাকা পানি, টায়ারের খোল, ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা অথবা পানির চৌবাচ্চায় এই মশা নির্বিচারে বংশ বিস্তার করে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ১০২ ডিগ্রি ও এর চেয়ে বেশি জ্বর, সঙ্গেই তীব্র মাথা ও শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ে, তীব্র পেট ব্যথা, স্কিন র্যাশ ইত্যাদির সঙ্গে বমিভাব ও ক্ষুদামন্দা থাকলে তার ডেঙ্গু হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। এ অবস্থায় অনেকে আতঙ্কিত হয়ে অ্যান্টিবায়োটিকসহ নানান ধরনের ওষুধ খেয়ে থাকেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর প্রশমনে কেবল প্যারাসিটামল এবং প্রচুর পানি খেলেই চলে। তবে অবস্থার অবনতি হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ ও শিশুদের ক্ষেত্রে।
ডেঙ্গু এখন কোনো সময় ধরে এগোচ্ছে না। সারাবছরই ডেঙ্গুর আক্রমণ চলছে। তাছাড়া ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা রাতে দিনে সব সময়ই কামড়াচ্ছে। স্বচ্ছ, নোংরা যে কোনো পানিতে লার্ভা ছড়ায় মশা। ঢাকা শহরে ‘লাইট পলিউশনের’ কারণে এডিস মশা এখন দিনে হোক বা রাতে সব সময় কামড়ায়। লাইট পলিউশন একটা বিশাল বড় পলিউশন। এ কারণে এডিস মশা তার আচরণে পরিবর্তন করেছে। আর এতো দিন আমরা জানতাম এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে জন্মায়, নোংরা পানিতে নয়। অথচ এখন আমরা দেখলাম এডিস স্বচ্ছ পানিতে জন্মাচ্ছে।
অর্থাৎ এডিস মশা আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এ পরিবর্তনকে টার্গেট করে আমাদের এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে। মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। মশা জন্মানোর তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যারা মশার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন তারা টার্গেট করে মশা নিধন করতে হবে। এডিস মশা যেখানে হয় সেখানে টার্গেট করে আমাদের তা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে হয়তো আমরা পারছি না, কেন পারছি না, সেটা বের করতে হবে।
দুঃজনক বিষয় হচ্ছে, পুলিশের ডাম্পিং করা গাড়িগুলো ডেঙ্গু প্রজননের সবচেয়ে বেশি প্রজননস্থল। ঢাকার প্রায় সব থানার সামনাসামনি গাড়ি ডাম্পিং করা রয়েছে। একটু করে কেরোসিন ঢাললে মশার লার্ভা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সেটি করবে কে? এছাড়া বাসা-বাড়ির বেজমেন্টে যেখানে গাড়ি ধোয়া হয় সেখানেও পাওয়া যাচ্ছে এডিসের লার্ভা।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতার কথা বলা হলেও তা মানা হচ্ছে না। অনেকেই মশারি ব্যবহার করতে চান না। আমাদের দেশে মশারির ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই সবাইকে বাধ্য করতে হবে। রাজধানীতে বিদ্যুৎ যায় না বললেই চলে, সেখানেও মশারি ব্যবহার করা হচ্ছে না গরম লাগছে অথচ ডেঙ্গু হলে আমরা মারা যেতে পারি, খারাপ অবস্থায় যেতে পারি। কিন্তু সামান্য কষ্ট করতে আমরা রাজি না।
অথচ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষীয় দায়িত্বের পাশাপাশি নাগরিক দায়িত্বও অনেক বেশি। প্রতিটা নাগরিকের কিছু দায়-দায়িত্ব আছে। নাগরিকরা যদি নিজের জায়গা থেকে সচেতন থাকে তাহলে আমরা ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবো। শুধু সরকারের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর দোষ না দিয়ে আমরা যদি দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করি তাহলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হবে। বাড়ির ভেতর, আশপাশে এডিশ মশার প্রজনন ক্ষেত্র আছে কি না-সেটি ধ্বংস করতে নিজেদেরই ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।
বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের প্রধান হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত এক দশকে প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে বলা হয়েছে। বিশ্ব জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের দুই ভাগই অর্থাৎ ২৫০ কোটি লোক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ৭০ শতাংশই এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে বাস করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হু সতর্ক করে দিয়েছে, এখনই সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে সচেতনতাই মূল নিয়ামক। আমাদের জেগে ঘুমালে চলবে না। দায়িত্বশীল হতে হবে নিজেদের জীবনরক্ষার স্বার্থেই। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচতে হলে এডিশ মশা যাতে বংশ বিস্তার করতে না পারে সে দিকে সচেতন থাকতে হবে।
দুঃখজনক হচ্ছে, জেলজরিমানা করেও বাসাবাড়ি অফিস-প্রতিষ্ঠানের আশপাশ পরিষ্কার রাখা যাচ্ছে না। অথচ জীবন যাচ্ছে আমাদের। এজন্য মশক নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধি না পায়। এ লক্ষ্যে সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মানুষজনকে সচেতন করে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে- ‘প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।’
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
ফারুক/এইচআর/জিকেএস