বিয়ে, ডিভোর্স এবং সোনালি একাকীত্ব

শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:৪২ পিএম, ০৩ আগস্ট ২০২৩

না, জাস্টিন ট্রুডো এবং সোফি গ্রেগরির ডিভোর্স নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। শুধু আমার নয় কারও বলা উচিত নয়। সব মানুষেরই ব্যক্তিগত কিছু বিষয় আছে। কে কেন কার সঙ্গে বসবাস করবে বা করবে না সেটা তার ও তাদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কয়েক বছর আগে বিল ও মেলিন্ডা গেটসের ডিভোর্স নিয়েও এমন শোরগোল শুনেছি।

আজকাল অনেককেই একটা কথা খুব বলতে শুনি, ফেসবুকেও অনেকেই আহাজারি করেন, ডিভোর্সের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে। কেন ডিভোর্স হচ্ছে, ভালোবাসা কমে যাচ্ছে, সহনশীলতা কমে যাচ্ছে ইত্যাদি। কিছু পশ্চাৎপদ মানসিকতার মানুষ এজন্য নারীর স্বাধীন বৃত্তি, পেশা, ক্ষমতায়নকেও দায়ী করেন।

সত্যি কথা বলতে কি, বিয়ে এবং ডিভোর্স দুটোই খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। যদি দুজন মানুষ মোটামুটি একই সামাজিক স্তরের হয়ে থাকেন, যদি দুজনেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হন তাহলে ডিভোর্সে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত বা নির্যাতিত হয়েছেন এমনটি বলা যাবে না। সেক্ষেত্রে যদি দুজন মনে করেন তারা আর একসঙ্গে চলতে পারছেন না তাহলে ডিভোর্স হলে একেবারে মহা সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই।

আমাদের সমাজে আগে নারীরা স্বামীর ( শব্দটিতে আমার আপত্তি আছে। আমি সঙ্গী বা স্পাউস শব্দটিকে প্রেফার করি। তবে একশ বছর আগে পুরুষরা কিছুটা স্বামী বা প্রভুই ছিল) নির্যাতন সহ্য করেও অথবা অ্যাডজাস্টমেন্ট না হলেও ডিভোর্স নেয়ার কথা ভাবতো না। কারণ তারা আর্থিকভাবে, সন্তান প্রতিপালনের জন্য অথবা সামাজিক মর্যাদার জন্য একটি অসুখী বিয়ের ভিতরে আটকে থাকটাকে ডিভোর্সের চেয়ে অনেক ভালো মনে করতো।

দশ বিশ বছর আগেও এমনটা দেখেছি। প্রেমের বিয়ের প্রেমটা মরে যাওয়া সত্ত্বেও বিয়ের শবটাকে বহন করে নিয়ে চলেছে দুজন অসুখী মানুষ। তবু ডিভোর্স করছেন না। কারণ লোকে কি বলবে। সন্তানরা কষ্ট পাবে। আর্থিক ও সামাজিক স্টেটেসকু বা স্থিতি নষ্ট হবে। এমন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই পার হয়ে যায় জীবনটা।

আজকাল অসুখী বিয়েগুলো ঝরে গিয়ে যেগুলো টিকে থাকছে বুঝতে হবে সেগুলো সত্যিই এখনও জীবিত রয়েছে।

তবে হ্যা, অনেক সময় মৃতবৎ সম্পর্ককেও আবার বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করাই দরকার। সম্পর্কটা যদি আইসিইউতেও চলে যায় তবু তাকে কোরামিন বা স্টেরয়েড দিয়ে বাঁচিয়ে তোলার শেষ চেষ্টা করা দরকার। লাইফ সাপোর্ট থেকেও তো কেউ কেউ ফিরে আসে। তেমনি সম্পর্কও আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে বৈকি। কিন্তু তাই বলে যেটা মরে গেছে সেটাকে মমি বানিয়ে পিরামিডের ভিতর রেখে পুজো করার কিছু নেই।

এবার আসি ভালোবাসা প্রসঙ্গে। ভালোবাসা আর ভূত আমার কাছে একই রকম মনে হয়। প্রেমের গল্প আর ভূতের গল্পের অভাব নেই। অনেকেই দিব্যি গেলে বলে তারা ভূত দেখেছে। তেমনি প্রেমে পড়া লোকজনও প্রচুর দেখা যায়। কিন্তু সত্যিকারের অলৌকিকের অভিজ্ঞতা ক’জন মানুষের হয়? খুব কম। কলাগাছকে ঘোমটা পরা বৌয়ের ভূত ভাবার মতো অনেকেই পারষ্পরিক জৈবিক বা মানসিক আকর্ষণকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করে। সত্যিকারের ভালোবাসা অতি দুর্লভ। বেশিরভাগই মোহ।

আমার কাছে মনে হয় অধিকাংশ প্রেম হলো জ্বরের মতো। এক ধরনের সাময়িক অবস্থা। যতক্ষণ জ্বর থাকে ততোক্ষণ প্রবল ঘোর। ঘাম দিয়ে শেষমেশ যখন জ্বর ছাড়ে তারপর কিছুদিন দুর্বলতা থাকে। বিস্বাদ হয়ে থাকে জীবন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রেমও তেমনি। চলে যাওয়ার পর বা ছেড়ে যাওয়ার পর কিছুদিন মনটন খারাপ থাকলেও আলটিমেটলি সুখী মনে হয় নিজেকে।

প্রেম বানের জলের মতো চলে যাওয়ার পর দাম্পত্যে যেটা পড়ে থাকে সেটা হলো অভ্যাসের পলি। সে পলিতে জীবনের চাষবাস ভালো চলে বটে। তবে জলে ভাসার সুখটুকু চলে যায়।

এবার আসি একা থাকার প্রসঙ্গে। একা থাকা নিয়ে অনেকবার অনেক কথা বলেছি। ছায়ার মতো কাছাকাছি থেকেও পরষ্পরকে ভুলে থাকা বা পরষ্পরের অস্তিত্ব গুরুত্বহীন হয়ে যাওয়া এবং টেকেন ফর গ্র্যান্টেড হয়ে যাওয়ার চেয়ে একা থাকাটা বেশি ভালো। এটা আমার ব্যক্তিগত মত।

তবে একা থাকাকে যতটা করুণভাবে অনেক সিনেমায়, গল্পে বা ফেসবুক স্ট্যাটাসে চিত্রিত হতে দেখি ততোটা কি করুণ?

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমি চীনে বেশ কয়েক বছর একা থেকেছি। শাহিন (আমার স্পাউস) ও অর্ণ (আমাদের একমাত্র সন্তান) ছিল দেশে।

আমার কিন্তু মোটেই খারাপ লাগতো না। বাড়িতে একা বসে আরামে বই পড়তাম। বাইরে ঘুরতাম। শপিং করতাম। ইচ্ছা হলেই বাইরে খেতাম। লেখালেখি করতাম। মুভি দেখতাম। ইচ্ছা না থাকলেও অমুকের বিয়ের দাওয়াতে যাওয়া আর দাঁত কেলাইয়া হাসার দায় থেকে মুক্ত ছিলাম।

ঘরেও রান্না বান্নার কোন বালাই রাখতাম না। হয়তো এক প্লেট ফ্রাইড বা বেকড মাশরুম আর চিজ কেক দিয়ে ডিনার করে নিতাম।

কোনদিন ভাত খেতে ইচ্ছা হলে ফার্স্টক্লাস করে একটা ডিম ভেজে খেয়ে নিতাম।

সত্যি বলতে কি নিজের সঙ্গ আমি সত্যিই ভীষণ এনজয় করি। দিনের পর দিন কারও সঙ্গে এক বর্ণ বাংলা কথা না বললেও আমার খারাপ লাগেনি।

তারমানে এই নয় যে, পরিবারের সঙ্গে আছি বলে এখন আমি খুব অসুখী মানুষ। আমি বলতে চাচ্ছি যে, একা থাকাটাকেও, নিজের সঙ্গে নিজের সময় কাটানোটাকেও এনজয় করা যায়।

আর কে কার সঙ্গে কেন থাকবে অথবা থাকবে না, বিয়ে করবে, ডিভোর্স করবে, সেপারেটেড থাকবে না কি করবে সেটা একান্তই ব্যক্তির চয়েজ। কোন কিছু নিয়েই হায় আফশোসের কিছু নাই।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, লেখক।

এইচআর/এমএইচআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।