ইতিহাসে যা টিকে থাকার, তা ঠিকই টিকে থাকে

মোনায়েম সরকার
মোনায়েম সরকার মোনায়েম সরকার , রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ০১ আগস্ট ২০২৩

শোকের মাস আগস্ট সামনে রেখে মনে পড়ছে কত কথা। যে মানুষটির জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় সম্ভব হতো কি না বলা যাচ্ছে না, সেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেই থেকে আগস্ট আমাদের কাছে শোকের মাস, বেদনার মাস। তবে স্বস্তির বিষয় এটাই যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলা যাবে বলে মনে করেছিল এবং সে লক্ষ্যে নানা অপতৎপরতাও চালিয়েছিল, তারা ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে ছোট করতে চেয়ে, বিতর্কিত করতে চেয়ে ওই কুচক্রীরাই ছোট হয়েছে, বিতর্কিত হয়েছে।

একই সঙ্গে আরেকটি বিষয়ও মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর নামে এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে তার প্রতি মানুষের মনে বিরক্তির ভাব তৈরি হয়। সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়। খুলনা সিটি করপোরেশনের একটি সাধারণ সভায় শিববাড়ি মোড়ের নাম বদলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে রাখার এজেন্ডা ছিল। এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, বহু বছর ধরে চালু থাকা একটি মোড়ের নির্দোষ নাম কেন বদলে ফেলতে হবে এবং কেনই বা বঙ্গবন্ধুর নাম সেখানে যুক্ত করতে হবে?

খুলনা নগরীতে ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’ বাস্তবে রয়েছেও বটে। সেটার নাম বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ আবু নাসেরের নামে করার প্রস্তাবও ছিল সভার নথিতে। কারা এমন জটিল চিন্তার আশ্রয় নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করলেন, তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। অনেকে বলছেন, শেখ আবু নাসেরের নামে একটা কিছুর নামকরণের জন্যই ওই দুটি প্রস্তাব আনা হয়েছিল। এর আওতায় শিববাড়ির নাম বদলে ফেলার বুদ্ধি বের করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুর নাম সেখানে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে, যাতে প্রশাসন বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি না ওঠে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অবস্থানকালে অন্য সবার সঙ্গে শেখ আবু নাসেরও নির্মমভাবে নিহত হন। তার নামে কোনো সড়ক, মোড় বা স্থাপনার নামকরণ হলে তাতে কেউ আপত্তি করবে না। সেটা হওয়াও উচিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চত্বরের নাম পাল্টে সেখানে তার নাম বসাতে হবে কেন? শিববাড়ির নামই বা বদলে ফেলতে হবে কেন?

বঙ্গবন্ধু চত্বর ও শিববাড়ি মোড়ের নাম বদলানোর এজেন্ডা সংবলিত নথি ফেসবুকে ঘুরছে। তাও ভালো, দ্রুত এর নিষ্পত্তি টানা হয়েছে। তবে ফেসবুকে হৈচৈ না হলে গোপনে নাম পরিবর্তনের ব্যাপারটি ঘটে যেত কি না, তা কে বলবে। উদ্যোগটি বাতিল হলেও এ প্রশ্ন থেকে যাবে যে, কারা কী উদ্দেশ্যে এমন প্রস্তাব এনেছিলেন। আর বঙ্গবন্ধুকে সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করার প্রবণতা তো শুভ নয়। যারা এসব চেষ্টায় নিয়োজিত, তারা না শিববাড়ি মোড়ের তাৎপর্য বোঝেন; না বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন। এ দুটি কোনো মহল সচেতনভাবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চায় কি না, সে প্রশ্নও উঠবে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিল মুজিবনগর সরকার। কেননা তিনি এদেশের বঞ্চিত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের নায়ক। স্বাধিকার আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনিই ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দৈহিকভাবে অনুপস্থিত হলেও বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সবচেয়ে উপস্থিত। স্বাধীনতা অর্জন শেষে তার নেতৃত্বেই গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে তিনি নেতৃত্ব দেন এ জাতিকে।

এরই এক পর্যায়ে স্বাধীনতাবিরোধী ও কুচক্রী মহলের চক্রান্তে তাকে জীবন দিতে হয় সপরিবারে। হত্যাকারী চক্র রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টাও চালানো হয়। দীর্ঘ ২১ বছর ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে সেটা অব্যাহত থাকে। তাতেও জনগণের মন থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা সম্ভব হয় না। মুছে ফেলতে চাওয়ায় এ নাম যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যারা বঙ্গবন্ধুর নাম যেখানে-সেখানে উৎকীর্ণ করতে চায়, তাদের বোধহয় এ ইতিহাস জানা নেই।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে আসার পর অবশ্য বঙ্গবন্ধুর নামে অনেক কিছুর নামকরণ হয়েছে। সেটা কাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু এসব নামকরণের কারণেই কি বঙ্গবন্ধু বড় হয়েছেন? নাকি দীর্ঘদিন তার নামে কিছু ছিল না বলে, এমনকি বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা চলেছিল বলে তিনি ছোট হয়ে গিয়েছিলেন? ইতিহাসে তার যে অবদান, তাতে কোনো অপশক্তিই তার নাম মুছে ফেলতে পারবে না।

বঙ্গবন্ধুকে এ পরিপ্রেক্ষিতে যারা দেখতে অক্ষম, তারাই যেখানে-সেখানে তার নাম বসাতে তৎপর হয়ে ওঠে। তারা হয়তো মনে করে, এটা না করলে তিনি ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবেন। আরেক শ্রেণির লোক নিজেদের বঙ্গবন্ধু-প্রেমিক বলে জাহির করতে এসব কাজে উঠেপড়ে লাগে। তাদের হয়তো কোনো ক্ষুদ্র স্বার্থ রয়েছে। এ অবস্থায় খুলনায় নাম পরিবর্তনের ওই উদ্যোগ কেন নেওয়া হয়েছিল, তার একটি তদন্তও হতে পারে। বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করা কঠিন।

 

বঙ্গবন্ধু আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে এত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন যে, তাকে মুছে ফেলা সম্ভব নয় এবং তার নামে ছোট-বড় নানা কিছুর ঢালাও নামকরণের চেষ্টাও অর্থহীন। এতে বরং তার মর্যাদা খাটো করা হয়। অনেকে অবশ্য ভালোবেসে তার নামে কিছু করার চেষ্টা করেন। সেটা বোঝা যায়। কিন্তু হালকা চিন্তাভাবনা বা অতিউৎসাহ থেকে যারা বঙ্গবন্ধুকে সব বিষয়ে টেনে আনেন, তাদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।

 

বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনার নামকরণের পেছনে কোনো না কোনো ইতিহাস থাকে। অনেক ক্ষেত্রে থাকে জনশ্রুতি। কোনো কারণে সেটি পরিবর্তন করা হলে তাতে ওই ইতিহাস বা জনশ্রুতিটি হারিয়ে যায়। এজন্য একদল মানুষ কোনো নামই পরিবর্তন করার পক্ষপাতী নয়। কিছু নাম অবশ্য আছে বিব্রতকর বা উচ্চারণের জন্য অপ্রীতিকর। সেগুলো হয়তো উদ্যোগ নিয়ে বদলানো যেতে পারে, যেহেতু এতে মানুষের রুচি গঠনের বিষয় রয়েছে। মাঝে শোনা গিয়েছিল, এমন কিছু বিদ্যালয়ের নাম বদলানো হবে শিশুদের মানস গঠনের জন্য। এক্ষেত্রেও খেয়াল রাখা দরকার, যাতে কোনোভাবে বিশেষ কোনো সম্প্রদায় আহত না হয়।

আমাদের দেশে মূলত সামরিক শাসকরা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু নাম পরিবর্তন করেন এবং তাতে ব্যবহার করেন ধর্মকে। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে খুশি করতেই ছিল তাদের এসব উদ্যোগ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও কিছু পুরোনো বাংলা নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় পাক হানাদার বাহিনী ও তার সেবাদাসরা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে সেগুলো আর স্থায়ী হয়নি। তবে নতুন দেশ সৃষ্টির কারণে অবধারিতভাবে কিছু নাম বদলাতে হয়।

এগুলো যে প্রশাসনিক আদেশে হয়েছে, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বদলে দিয়েছে অপ্রিয় নাম। এ অঞ্চলে নাম বদলে না ফেলার উদাহরণও কম নেই। ব্রিটিশ সাহেবদের নামে করা সবকিছু বদলে ফেলা হয়নি। আবার কিছু নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। তাতে কী অর্জিত হয়েছে, বলা কঠিন। ভারতে হিন্দুত্ববাদী মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেখানকার মুসলিম শাসনামলের সব কীর্তি মুছে ফেলার চেষ্টায় যেন নেমে পড়েছে। কিন্তু দেশটির ইতিহাস সচেতন ও বিবেকবান মানুষ এটা সমর্থন করছে না। ভারতের আদালতও এর বিরোধিতা করছেন। বাংলাদেশে এত ব্যাপকভাবে না হলেও বিশেষত স্বৈরাচারী এরশাদ শাসনামলে বিভিন্ন স্থানের বাংলা নাম পরিবর্তনের একটা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এটা অবশ্য শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপরই বাংলাদেশ বেতারকে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করার মধ্য দিয়ে। এসব করে শেষ পর্যন্ত কোনো ফায়দা আসলে হয় না। ইতিহাসে যা টিকে থাকার, তা ঠিকই টিকে থাকে।

বঙ্গবন্ধুর নামে অনেক কিছুর নামকরণ হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত সেতুর নতুন নামকরণ হয় বঙ্গবন্ধু সেতু। সেটা সবাই সানন্দে গ্রহণ করে। পদ্মা সেতুর নামও বঙ্গবন্ধুর নামে করার প্রস্তাব ছিল। হয়তো এর নামকরণ করা যেত দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু সেতু। পদ্মা সেতু যেহেতু বঙ্গবন্ধু কন্যার বিশেষ উদ্যোগের ফল, তাই এর নাম তার নামে করারও প্রস্তাব গিয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে। কিন্তু বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করেননি। নদীর নামেই করা হয় পদ্মার ওপর নির্মিত সেতুর নাম। তাতে বঙ্গবন্ধু কিংবা শেখ হাসিনা কেউ ছোট হয়ে যাননি।

বঙ্গবন্ধুর নামে কোনো কিছুর নামকরণের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সে প্রশ্নও মাঝে মাঝে মনে জাগে। কেননা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তো সমার্থক। যার নামে একটি জাতি মরণপণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, তার নাম দিয়ে বুঝি মুছে ফেলতে হবে খুলনার একটি মোড় শিববাড়ির নাম! সত্যি বলতে, এ ঘটনায় আমি বিস্মিত।

বঙ্গবন্ধু আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে এত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন যে, তাকে মুছে ফেলা সম্ভব নয় এবং তার নামে ছোট-বড় নানা কিছুর ঢালাও নামকরণের চেষ্টাও অর্থহীন। এতে বরং তার মর্যাদাকে খাটো করা হয়। অনেকে অবশ্য ভালোবেসে তার নামে কিছু করার চেষ্টা করেন। সেটা বোঝা যায়। কিন্তু হালকা চিন্তাভাবনা বা অতিউৎসাহ থেকে যারা বঙ্গবন্ধুকে সব বিষয়ে টেনে আনেন, তাদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। এরা আখেরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তিরও ক্ষতি করে ফেলছেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্ষমতার শীর্ষে আছেন বলে তাকে খুশি করার চেষ্টায়ও এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। আশা করি, তিনি এ বিষয়ে সচেতন আছেন ও থাকবেন। তাতে আমাদের সবারই মঙ্গল।

৩১ জুলাই, ২০২৩[২]
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

ফারুক/এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।