আমি টাকডুম টাকডুম বাজাই ছাত্রলীগের ঢোল

প্রতি বছর ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসটা যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আমার মত লিভারের ডাক্তারদের ছুটোছুটি। একটা সময় ছিল যখন এই ছুটোছুটিগুলো ছিল মূলত মেডিকেল কলেজ কেন্দ্রীক। তবে যতই স্মার্ট হচ্ছে বাংলাদেশ আর তার সাথে বাড়ছে আমাদের স্মার্টনেসও, ততই বাড়ছে আমাদের ছুটোছুটি আর সেই সাথে ছুটোছুটির পরিধিটাও।

এখন আর শুধু মেডিকেল কলেজগুলোর গ্যালারিতে সাইন্টেফিক প্রেজেন্টেশনের মধ্যে আমাদের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস কেন্দ্রীক কর্মযজ্ঞ সীমাবদ্ধ থাকে না। সাথে যোগ হয়েছে পত্রিকার অফিসে গোলটেবিল আলোচনা বৈঠক, টেলিভিশনে টকশো আর অনলাইনে বলাবলি আর লেখালেখি। সেই ধারাবাহিকতায়ই এবারের বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসকে সামনে রেখে আমার সর্বশেষ ময়মনসিংহ গমন।

এই ক্যাম্পাসে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে এসেছি বলে ময়মনসিংহ আর এই শহরের মেডিকেল কলেজটা আমার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। কাজেই ময়মনসিংহ থেকে ডাক পেয়েছি আর সব ব্যস্ততা শিকেয় তুলে ছুটে যাইনি এমনটা মনে পরেনা। তবে এ যাত্রায় লিখতে বসে ময়মনসিংহকে টেনে আনাটা একেবারেই ভিন্ন কারনে। এবারের ময়মনসিংহ যাওয়াটা অবশ্যই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসকে কেন্দ্র করে এবং প্রাথমিক উদ্দেশ্যটাও বরাবরের মতই মেডিকেল কলেজে সহকর্মীদের সামনে দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তব্য রাখা। তবে এবারে সেমিনার একটা ছিল না, ছিল দুটা আর এই দ্বিতীয় সেমিনারের অভিজ্ঞতাটা ভাগাভাগি করে নেয়ার তাগিদ থেকেই চটজলদি কলম ধরা।

আমার জীবনের ভিত্তিটা গড়ে দেয়ার জন্য আমি যে দুটো প্রতিষ্ঠানের কাছে কৃতজ্ঞ তার প্রথমটি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ আর দ্বিতীয়টি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আর এই যে এবারে ময়মনসিংহের এই দ্বিতীয় বৈজ্ঞানিক সেমিনারটি, সেটির আয়োজনে ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখাটি। কদিন আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা অনুপম সাহার সাথে। অনুপম ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ শাখার সভাপতি। কথা হচ্ছিল আমার এবারের ময়মনসিংহ যাওয়া নিয়ে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের লিভার বিভাগের আয়োজনে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের সাইন্টেফিক সেমিনারে বক্তব্য রাখতে ময়মনসিংহ যাচ্ছি, আলোচনা যখন এই কেন্দ্রীক হঠাৎই আলোচনার মোড়টা ঘুরে গেল।

বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় ছাত্রলীগের যে মূলনীতিগুলো ঠিক করে দিয়েছিলেন সেখানেতো শান্তি আর প্রগতির শুরুতে শিক্ষাও চলে আসে। সমাজে শান্তি আর দেশের প্রগতি নিশ্চিত করায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাতো কাজ করে যাবেনই আর যখনই অশুভ শক্তি সমাজ আর দেশের শান্তি আর প্রগতিকে বিঘ্নিত করার ষড়যন্ত্র করবে তখন রাজপথও দাপাবে-কাপাবে ছাত্রলীগ। এ সবই ঠিক আছে, থাকতেই হবে। কিন্তু পাশাপাশি সবার আগে যে শিক্ষা সেই জায়গাটাওতো সাংগঠনিক চর্চায় নিয়ে আসতে হবে ছাত্রলীগকে।

ছাত্র মানেইতো ‘ছাত্রনং অধ্যায়নং তপ’, আর ছাত্রলীগ যেহেতু ছাত্রদেরই সংগঠন, শিক্ষার বিষয়টা যে তাদের সাংগঠনিক চর্চার একটা বড় জায়গা জুড়ে থাকতে হবে তাতো বলাই বাহুল্য। আর মেডিকেল ছাত্রলীগ যেহেতু ছাত্রলীগের অন্যান্য ইউনিটগুলোর চেয়ে কিছুটা স্বতন্ত্র, তাই তাদের এই চর্চার জায়গাটাতো একটু হলেও অন্যরকম হতে হবে।

ছাত্র মানেইতো ‘ছাত্রনং অধ্যায়নং তপ’, আর ছাত্রলীগ যেহেতু ছাত্রদেরই সংগঠন, শিক্ষার বিষয়টা যে তাদের সাংগঠনিক চর্চার একটা বড় জায়গা জুড়ে থাকতে হবে তাতো বলাই বাহুল্য। আর মেডিকেল ছাত্রলীগ যেহেতু ছাত্রলীগের অন্যান্য ইউনিটগুলোর চেয়ে কিছুটা স্বতন্ত্র, তাই তাদের এই চর্চার জায়গাটাতো একটু হলেও অন্যরকম হতে হবে।

সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কর্মীদের সামনে থাকে বিস্তৃত পরিধি। তারা কেউ রাজনীতিবিদ হতে পারেন তো কেউ ব্যাংকার, কেউ ওকালতী করবেন, কেউ করবেন সাংবাদিকতা আর কেউ চাকুরীজীবী হলে কেউ বা হবেন ব্যবসায়ী। কিন্তু মেডিকেল কলেজগুলোয় যারা ছাত্রলীগ করছেন, করেছেন এবং সামনে করবেন তাদের জন্য এই পরিধিটা অনেকটাই সীমিত। তাদের ডাক্তারীটাই করে যেতে এবং খেতে হবে।

তবে তারপরও কথা থাকে। আজকের এই ছুটতে থাকা বাংলাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটতে হলে ডাক্তারদের পোস্টগ্র্যাজুয়েশন অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করাটা অত্যান্ত জরুরি, বরং বলা যায় প্রায় অত্যাবশ্যকীয়। এখানে অবশ্য একটা টুইস্ট থেকে যায়। মেডিকেলসাইন্স এখন এত বেশি ডাইভারসিফাইড যে এমবিবিএস পাস করার পরও বেশিরভাগ তরুণ ডাক্তারের পক্ষেই বুঝে শুনে পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের প্ল্যানিং করাটা সম্ভব হয়ে উঠে না।

কাজেই অনেকেই হয়তো পোস্টগ্র্যাজুয়েশন একটা সময় ঠিকঠাক করেই ফেলেন, কিন্তু হয়তো কখনো জানতেও পারেন যা ভিন্ন কোন ডিসিপ্লিনে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করলে তিনি যেমন তার কাজটাকে আরো বেশি উপভোগ করতেন, তেমনি তার রোগী এবং দেশও তার কাছ থেকে আরো অনেক বেশি উপকৃত হতে পারতো। তাই অনুপমের সাথে কথা বলতে যেয়ে হুটহাট সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, এবার ময়মনসিংহে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সাথে একটা ক্যারিয়ার প্ল্যানিং সেমিনার করবো।

বলা যেমন আয়োজনটাও তেমনিই ঝটপট এবং দুর্দান্ত। লিভার বিভাগ আয়োজিত সেমিনারটি শেষ করেই আমাদের গন্তব্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের গ্যালারি যেখানে জড়ো হয়েছে মেডিকেল ছাত্রলীগের শতাধিক তরুণ তুর্কী। সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনছেন আমি কি বলছি। আমি তাদের শোনাচ্ছি আমার জীবনের গল্প। যে গল্পের শুরুটা ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়ায় আর শেষ তিলোত্তমা এই রাজধানী শহরের শাহবাগে। সেই গল্পের মোড়ে মোড়ে আছে কার্ড-আইটেম, আইল্যান্ড আর ক্যান্টিন। আছে যেমন জয় বাংলা, আছে তেমনি এই ক্যাম্পাসেই একদিন জীবনসঙ্গীনি খুঁজে নেয়ার উপাখ্যানও।

এই গল্পে আছে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের হাতে পরীক্ষার হলে নিহত শহীদ নোমানের রক্তাক্ত এপ্রোন আর আমার পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের কঠিন সময়গুলোও। আছে সাইন্টেফিক পাবলিকেশন, জার্নাল, পত্রিকার পাতায় রাজনৈতিক কলাম, বই মেলা থেকে শুরু করে এলসেভিয়ারের প্রেস থেকে প্রিন্ট হয়ে আসা ঝকঝকে টেক্সটবুক আর পেশাগত জীবনে চেম্বারে ব্যস্ততা। ভিন্ন আঙ্গীকেও এই লেকচার যখন দিচ্ছি তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি তরুণ এসব তুর্কীদের সেকি অসীম আগ্রহ। বাবার বয়সী অধ্যাপকের মুখে এমন অদ্ভুতুরে লেকচারে তাদের বিন্দুমাত্র অনীহা তো নেই-ই, অধিকাংশের চোখেই বরং স্বপ্নালু আগ্রহের আভা।

অনুষ্ঠানটি আলো করে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহের মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র জনাব মোঃ একরামুল হক টিটু। মেয়রের বক্তব্যে প্রচলিত রাজনীতির ছোঁয়া যেমন, তেমনি আছে কিছু অসাধারনত্বও। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের কর্মীদের বিপুল প্রশংসা তার কণ্ঠে।

শুধুমাত্র সুশৃংখল আর রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক একটি ইউনিট বলেই নয়, তার প্রশংসার একটা বড় একটা কারণ এই ইউনিটের নেতা-কর্মীদের মানবিকতা। বিশেষ করে বিগত কোভিড প্যান্ডেমিকে তরুণ এই হবু চিকিৎসকরা ময়মনসিংহ শহরের বাড়ি বাড়ি গিয়ে যেভাবে কোভিড আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, পৌঁছে দিয়েছে অক্সিজেনের সিলিন্ডার, তাতে মেয়র মহোদয়ের চোখে এটি নিঃসন্দেহে ছাত্রলীগের একটি আদর্শ ইউনিট।

মেয়র টিটু রাজনীতিতে পোড় খাওয়া মানুষ। জহুরির চোখে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের তার যে মূল্যায়ন আর তার সাথে বছরের পর বছর ছাত্র পড়িয়ে আমার শিক্ষকের অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে ওদের চোখে যে দৃঢ়তা আর আগ্রহ আমি সেদিন দেখেছি, তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই শতাধিকের ভেতরই লুকিয়ে আছে আগামীর অনেকজন দৃঢ়চেতা মুজিব সৈনিক আর অনেকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কে জানে হয়তো বা অনেকজন লিভার বিশেষজ্ঞও। কাজেই অমন ছাত্রলীগের ঢোলটাতো আমায় টাকডুম টাকডুম বাজাতেই হচ্ছে।

লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।