মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভিডিওচিত্র প্রতিযোগিতা বিস্তৃত হোক

মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশিত: ০৯:৫৪ এএম, ২৫ জুলাই ২০২৩

মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য ভিডিও প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য সরকার নির্দেশ দিয়েছে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শিক্ষার্থীরা ‘আমার চোখে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক এক মিনিটের ভিডিওচিত্র তৈরি করবে। মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর ২০ জুলাই এ নির্দেশনা জারি করেছে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের দেশাত্মবোধ ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে এই কর্মসূচি। তবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষত সব মাদরাসাই যদি প্রযুক্তি ব্যবহার মাধ্যমে এমন সৃজনশীল কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে পারতো তাহলে আরও ভালো হতো।

বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের অর্ধেকেরও কম মাদরাসা সরকারের এ কর্মসূচির আওতায় আসবে। কারণ সরকারের এ নির্দেশনা শুধু মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন মাদরাসাগুলোর জন্য প্রযোজ্য। যে মাদরাসাগুলো মূলত আলিয়া হিসেবে পরিচিত। যদিও ইবতেদিয়া মাদরাসাও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে সরকারি সুবিধাদি পেয়ে থাকে কিন্তু এসব মাদরাসার শিক্ষার্থীরা বয়সের দিক থেকে ছোট হওয়ার কারণে তারা সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে না।

মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন প্রায় ৯ হাজার মাদরাসার বাইরে কওমি মাদরাসা আছে প্রায় কুড়ি হাজার। এই কওমি মাদরাসাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তারা সরকারের কোনো নির্দেশের তোয়াক্কা করে না। শুধু তাই নয়, তাদের কারিকুলাম এমনভাবে সাজানো যেখানে বাংলাদেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ তথা বাংলাদেশ পরিচিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। বরং সেসব মাদরাসার অধিকাংশগুলোতেই বাংলাদেশের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ নয় কিংবা বাংলাদেশের চেতনা বিরোধী ধারণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

কওমি মাদরাসাগুলোতে একসময় জাতীয় পতাকাও উড়ানো হতো না। এখনও তারা জাতীয় সংগীত গায় না। কওমি মাদরাসা শিক্ষিতদেরই কেউ কেউ ইউটিউব ওয়াজে পহেলা বৈশাখ উদযাপন, একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর উদযাপনকে নাজায়েজ- কুফুরি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সুতরাং দেশাত্মবোধ তৈরির জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচিতি করার জন্য এসব স্থানে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

আলিয়া মাদরাসা হিসেবে খ্যাত মাদরাসাগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা কারিকুলাম কিছুটা যুক্ত হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা আধুনিকতার ছোঁয়া পায়। এসব মাদরাসা থেকে পাস করে অসংখ্য শিক্ষার্থী মূলধারার শিক্ষায় যুক্ত হচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মেধা তালিকায়ও স্থান পাচ্ছে।

অন্যদিকে কওমি মাদরাসা থেকে প্রতিবছর দাওরায়ে হাদিস (কওমি মাদরাসাশিক্ষার স্নাতকোত্তর) শেষ করে ২৬ হাজার শিক্ষার্থী কর্মজীবনে প্রবেশ করে। একটি তথ্য বলে, আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি ‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ-এর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষায় ২৮ হাজার ১৮ শিক্ষার্থী অংশ নেন। তার আগেও শিক্ষাজীবন থেকে বিদায় নেয় অনেক শিক্ষার্থী।

বিশাল সংখ্যক মাদরাসা শিক্ষার্থী এমন মাদরাসা থেকে সৃজনশীল কোনো কাজ করার শিক্ষা পায় না। বরং অনেকক্ষেত্রে তাদের শেখানো হয় সৃজনশীল অনেক কিছুই হারাম হিসেবে গণ্য। যেমনি এই শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কেও ভুল শিখে থাকে। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এসব শিক্ষার্থী পাস করে গিয়ে যখন কোনো মাদরাসায় শিক্ষকতার সুযোগ পান তখন তারাও তাদের মতোই আরেকটি প্রজন্ম তৈরি করে থাকেন। যারা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে ভিন্নরূপে চিনতে থাকে।

প্রতিবছর যদি ২৮-৩০ হাজার যুবক ‘বাংলাদেশ উপেক্ষিত’ এমন শিক্ষা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে, তাহলে ভবিষ্যৎ পরিণতি কি হবে- তা সহজেই অনুমেয়। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের নির্দেশনা হয়তো সামান্য ভূমিকা পালন করবে। এ উদ্যোগকে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় বড়জোর।

 

আলিয়া মাদরাসা হিসেবে খ্যাত মাদরাসাগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা কারিকুলাম কিছুটা যুক্ত হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা আধুনিকতার ছোঁয়া পায়। এসব মাদরাসা থেকে পাস করে অসংখ্য শিক্ষার্থী মূলধারার শিক্ষায় যুক্ত হচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মেধা তালিকায়ও স্থান পাচ্ছে।

 

এ মুহূর্তে জরুরি প্রয়োজন হচ্ছে, কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোও ভূমিকা রাখতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

শুধু মাদরাসা নয়, স্কুলেও পাঠ্যবইবহির্ভূত বই পড়াকে আবশ্যক করা জরুরি। বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে শত শত কোটি টাকার বই দেওয়া হয়েছে কয়েক বছরের মধ্যে। এসব বইয়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধেরও প্রচুর বই আছে, যা পড়লে আমাদের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে এসব বই উইপোকার খাবার হচ্ছে এমন অভিযোগও আছে। সেসব বই শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। এমন অভিযোগও আছে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দু-একজন শিক্ষকও নেই যারা বই পড়েন। তরুণ শিক্ষকদের বড় একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানের অধিকারীও নন।

একটি স্বাধীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা স্বাধীনতার বিরোধিতাকে প্রশ্রয় দিতে পারে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সুফল ভোগকারী জনগোষ্ঠীকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সম্পর্কে অজ্ঞ রেখে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে না। বিষয়টি রাষ্ট্র ও সচেতন মহল গুরুত্বসহ বিবেচনা করবেন এমন প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।

মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যত সমালোচনাই করা হোক না কেন আজ এই শিক্ষাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ভুল-শুদ্ধ নিয়ে এ শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের লাখ লাখ কিশোর তরুণকে টেনে নিয়েছে। যার সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করছে বলে এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়। এই শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞাননির্ভর জীবনের সঙ্গে পরিচিতি করানো এবং দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য এমন কর্মসূচির পাশাপাশি বই পড়ার মতো কর্মসূচিও নেওয়া জরুরি। যাতে তারা ইতিহাসের বিপক্ষে নয় স্বচ্ছ ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে।

ধর্মীয় আলোচনা ও ওয়াজ ভিডিও রেকর্ড করে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ব্যবসায়ও করছে। এ বিষয়ে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক মন্তব্য না করেও বলা যায়, তাদের যদি গঠনমূলক দেশাত্মবোধক ধারায় পরিচালিত করা যায় তাহলে উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে না। দেশও অভ্যন্তরীণভাবে নিরাপদ থাকবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।