বঙ্গবন্ধুর তারুণ্য, তারুণ্যের বঙ্গবন্ধু


প্রকাশিত: ০৫:০০ এএম, ১৭ মার্চ ২০১৬

১৯৪০ থেকে ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট দীর্ঘ ৩৫ বছরের কিছু বেশি সময়ের রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুকে তারুণ্যের ঔজ্জ্বল্যে এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তবে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক ইতিহাস, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এবং চিন্তা-চেতনার পরিধি মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর- এ দুটি পর্বে বিশ্লেষণ জরুরি। একইভাবে কী কী কারণে তরুণদের কাছে তিনি এখনো পর্যন্ত কিংবদন্তির ব্যক্তিত্ব, সেসব ব্যাখ্যার জন্য  তাঁর কর্মময় জীবন ও নীতি-আদর্শ তুলে ধরা দরকার।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়িতে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেন, তিনি পরবর্তী সময় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে পরিচিত হন বিশ্বব্যাপী। উল্লেখ্য, ২০ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৪০ সালে শেখ মুজিবুর রহমান নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটিরও সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। তাঁর প্রচেষ্টায় গোপালগঞ্জ মুসলিম সেবক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪২ সালে শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। মুসলিম লীগের রাজনীতির কেন্দ্র ছিল ইসলামিয়া কলেজ।

এ সময় তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সম্পাদক সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য থেকে তিনি বাংলার নেতাদের সঙ্গে একত্রে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করেন। মুসলিম লীগের যুবনেতা হিসেবে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের আদর্শে অনুপ্রাণিত শেখ মুজিব ১৯৪৪ সালের মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এ সময় তিনি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। শেখ মুজিব গণতন্ত্র ও রাজপথের রাজনীতির সঙ্গে উদারনৈতিক চেতনা পেয়েছেন সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য থেকে। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাস্তব শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আশ্রয় নেন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন। মুসলিম লীগে নানা দ্বন্দ্বও শুরু হয়। ফলে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়।

১৯৫৩ সালে `মুসলিম` শব্দ বাদ দিয়ে দলটির নামকরণ হয় `ছাত্রলীগ`। মূলত তৎকালীন পরিস্থিতির জন্য `মুসলিম` শব্দটি ব্যবহার করা হলেও দলের আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি। শেখ মুজিব ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে ঢাকায় গঠিত হয় `পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ`। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এ দলের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৫৩-৫৮ সম্পাদক, ১৯৬৬-৭০ সভাপতি, পুনরায় ১৯৭০-৭৩ পর্যন্ত সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পরে `আওয়ামী মুসলিম লীগ` থেকে `মুসলিম` শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।

১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত একটানা জেলে বন্দি ছিলেন জনপ্রিয় এই তরুণ নেতা। তবে জেল-জুলুমের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এবং ভাষা আন্দোলন ও বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে তিনি পরিণত হন জাতির জনক ও বিশ্ব নেতৃত্বে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানের সংবর্ধনায় `বঙ্গবন্ধু` উপাধি পান। একই সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন, "...জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি...আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম `পূর্ব পাকিস্তানে`র পরিবর্তে শুধুমাত্র `বাংলাদেশ`।" অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাস ও শেখ মুজিব দুটো অবিচ্ছিন্ন সত্তা হয়ে ওঠে। একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ। তাঁর ব্যক্তিচরিত্র একটি অখণ্ড সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত। তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণে তিনি বলেন, `আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’

বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে তরুণ বাঙালি। এ কারণে মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি পর্বে দলের বিশ্বাস ও নিজের জীবনদর্শনকে একীভূত করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর স্বপ্ন ছিল শোষণহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারির ভাষণে তিনি আরো বলেন, `বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা (পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ)।` `যার যার ধর্ম তার তার` ধর্মনিরপেক্ষতার এই ব্যাখ্যা বঙ্গবন্ধুই প্রথম উপস্থাপন করেন। সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করলেও বঙ্গবন্ধু ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করতেন।

বর্তমান তরুণদের মনে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা থেকে শুরু করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্ব দিন পর্যন্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল তাঁর রাষ্ট্রনীতি। তিনি সব সময় শোষিতের মুক্তি কামনা করেছেন। আজীবন সংগ্রামে যেমন তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি; তেমনি স্বাধীন দেশের সমাজকে সব অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিল তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৩ নম্বর দফা ছিল দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচিতেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলেন। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেন, `আওয়ামী লীগের মাথা কেনার মতো ক্ষমতা পুঁজিপতিদের নেই।` সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে ১৬ জানুয়ারি তিনি বলেন, `কিছু কিছু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছে।` এসব মুনাফাখোর-কালোবাজারি চক্রকে কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ার করে দেন তিনি। এ সময় তিনি শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য ধৈর্য ধরে কাজ করার কথাও বার বার উল্লেখ করেন।

বঙ্গবন্ধু জানতেন, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির বেশির ভাগই শিক্ষিত। অসাধু শিক্ষিত ব্যক্তিরা নানা ছলচাতুরি করে রাষ্ট্র ও সমাজের মধু পান করে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেন, `...আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন- আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান করাপশন। খাদ্য কিনতে যান করাপশন, জিনিস কিনতে যান করাপশন, বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে পাঁচ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল, আর আমরাই করি বক্তৃতা! আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি। আজ আত্মসমালোচনার দিন এসেছে। এসব চলতে পারে না।` এভাবে তিনি বাংলার মাটি থেকে অন্যায় ও দুর্নীতিবাজদের উৎখাত করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন একাধিক অনুষ্ঠানে।

মূলত বঙ্গবন্ধু সামাজিক বৈষম্য কমাতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন সবল কর্তৃক দুর্বলের ওপর অত্যাচার নির্মূল করতে; দেশে শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে চেয়েছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের মানসে ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত হওয়া পছন্দ করেননি বঙ্গবন্ধু। সাহিত্যে তিনি বাস্তব জীবনধারা প্রতিবিম্বিত করতে বলেছেন লেখকদের। ১৯৭৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, `সারা দেশ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মুখের ভাত জোটাতে হবে, মুখে হাসি ফোটাতে হবে। কত বড় দায়িত্ব বুঝতে পারছ?...` মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য জাতির পিতা রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিন থেকে তারুণ্যময় কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কারণ তরুণরাই পারে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে। বঙ্গবন্ধুর চেতনা তারুণ্যদীপ্ত বলেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে, জাতির জনক হিসেবে প্রথাবদ্ধ, ধর্মশাসিত সংস্কারাছন্ন জীবন তিনি পছন্দ করেননি। তরুণদের কাছে বঙ্গবন্ধু চিরস্মরণীয় একটি নাম।

লেখক : অধ্যাপক  এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়  
[email protected]

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।