অধ্যাপক আরাফাত কি সত্যিই কম ভোট পেয়েছেন?
মানুষের মনস্তত্ব বড় বিচিত্র ও অদ্ভুত। কখনো কখনো যে ভালোর বিপরীতে মন্দকে বেছে নিতে পছন্দ করে । বহু লোককে দেখেছি সহ্য হয় না ভালো কিছু খেলে। খাঁটি ঘি খেলেও কারও কারও সমস্যা হয়। অনেকে ডাবের পানিও সহ্য করতে পারেন না। অথচ ডাবের পানি খনিজ উপাদানে ভরপুর। স্বাস্থ্যের জন্য চমৎকার।
এসব বলার কারণ, ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচন। সব বিবেচনায় ঢাকা-১৭ একটি মডেল নির্বাচন হতে পারতো। রাজনীতির মাঠে এক দারুণ উদাহরণ হতে পারতো। প্রার্থীর যোগ্যতা থেকে শুরু করে প্রচারণা, সব কিছুতেই ছিল মেধা আর রাজনৈতিক পরিশীলনের ছাপ। একজন অধ্যাপকের জন্য তার বিভিন্ন সময়ের শিক্ষার্থীরা প্রচারণা করেছেন ঢাকা-১৭ আসন জুড়ে। তিনি নিজেও প্রতিটি মানুষের দোড়গোড়ায় গিয়েছেন। দলীয় নেতাকর্মীরাও সঙ্গে থেকেছেন, ভোট চেয়েছেন নৌকার পক্ষে। নির্বাচনের পরিবেশও ছিল চমৎকার।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ার মাত্র ২০ মিনিট আগে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটলো তা সবার জন্যই দুঃখজনক। এই অনভিপ্রেত ঘটনায় সবচেয়ে বেশি যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন তিনি অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত, যিনি বরাবরই শুদ্ধ রাজনীতি চর্চার লড়াই সংগ্রাম করে আসছেন। রাজনীতি যেন সুন্দর হয়, গঠনমূলক হয়, প্রতিহিংসামূলক না হয় এই চর্চাটি তিনি করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন। সাহস এবং সততার সঙ্গে যে কোনো রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বরাবরই যিনি প্রস্তুত। কিন্তু এমন একটি ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত তিনি ছিলেন না।
সমালোচনা করার জন্য সমালোচনা অর্থহীন। যারা বলছেন প্রতিদ্বন্দ্বী হিরো আলমকে প্রহার করেছেন অধ্যাপক আরাফাতের কর্মীরা বা আওয়ামী লীগের লোকেরা তাদের সেই অভিযোগ নিতান্ত অমূলক। কেননা এতে অধ্যাপক আরাফাত বা আওয়ামী লীগের কোনো অর্জন নেই বরং রয়েছে তার ক্লিন ইমেজের বিসর্জন। তাহলে অধ্যাপক আরাফাত বা আওয়ামী লীগের লোকেরা কেন এ ঘটনার নেপথ্যে ইন্ধন দিতে যাবেন? কেউ কি ১, ২, ৩ করে তিনটি পয়েন্ট দেখাতে পারবেন যে এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ ন্যূনতম তিনটি লাভ বা রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করতে পেরেছে। নিশ্চয়ই নয়। তাহলে এই অভিযোগটি কেন?
অধ্যাপক আরাফাত এ ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র নিন্দা এবং বিচার দাবি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথাও হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং অসন্তোষ প্রকাশ করে দোষীদের গ্রেপ্তার, বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার কথাও বলেছেন। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারও হয়েছেন ৭ জন। আরও ১৫ জনকে খুঁজছে পুলিশ।
যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ ১২ দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাহলে অধ্যাপক আরাফাত কেন হিরো আলমকে প্রহার করে অযথা ১২ দেশের উদ্বেগের কারণ হতে যাবেন? তিনি ‘ক্ষমতাবান’, ‘সরকার দলীয়’ আলোচনার জন্য যদি ধরেও নেই তাহলে কেন হিরো আলমকে প্রহারের ঝামেলায় যাবেন। আর কিছু যদি করতেই হয় তবে ভালো, সুন্দর একটি নির্বাচন শেষ হবার মাত্র ২০ মিনিট আগে কেন? কেন কিছু করলে ১০ দিন আগে নয়? তিনি যদি ক্ষমতাবানই হবেন বা ক্ষমতা দেখাবেন তাহলে তো হিরো আলমের মাঠে নামারই কথা নয়। কিন্তু তিনি কী তা করেছেন? না করেননি নিশ্চয়।
আমার ব্যক্তিগতভাবে একটি জিজ্ঞাসা, আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের প্রতি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, মানুষ উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে, মানুষ নৌকায়ই ভোট দেবে এই ভেবে নিজে ভোট না দিয়ে বসে থাকবার কী যুক্তি থাকতে পারে? নাকি এখানে অন্য কোনো হিসাব কাজ করেছে। হিসাব যাই হোক, যার যতো ব্যক্তিগত হিসেবই থাকুক, আরাফাত হেরে গেলে রাজনীতি জিতে না, কেননা সে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ দর্শনের উপর, যে দর্শন আর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই ভিত গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের।
আমাদের একটি দার্শনিক দুর্বলতা হলো আমরা কোন ঘটনাকে গভীরভাবে বোঝার বা বিশ্লেষণের চেষ্টা করি না। উপর থেকে দেখি, তল খুঁজি না। অধ্যাপক আরাফাত যদি ইতিবাচক মানুষ ও নীতিবান না হবেন তবে তার ভোটের সংখ্যা এতটা অপ্রতুল হতো না। তার ব্যক্তি ইমেজ, গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে নৌকার অর্জন যোগ করলে যে যোগফলটি দাঁড়ায় তা মোটেও ২৮,৮১৬ হতে পারে না। অংক বা সংখ্যাটি আরও বেশি হবার কথা। কিন্তু তিনি এই অংক বা সংখ্যাটিকেই মেনে নিয়েছেন। তার দিক থেকে কোন আপত্তি বা অভিযোগ আমরা শুনিনি। এমনকি সবাই মিলে রাত দিন কাজ করেও আরও বেশি ভোট না আনতে পারাকে নিজেদের ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন এবং আগামীতে কাজের মধ্যে দিয়ে সফলতা অর্জন করবেন বলেও জানিয়েছেন।
এবার ভোটের হিসাবে আসা যাক। ঢাকা-১৭ আসনে মোট ভোটার ৩,২৫,২০৫। এর মধ্যে অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত এলিট ভোটার সংখ্যা ৪৬,০০০। এলিটরা ভোট দেয় না, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অউন বা বিলং করে না এসব যুক্তি ধরে নিলেও থাকে ২,৭৯,২০৫ ভোট। হিরো আলম পেয়েছেন ৫৬০৯ ভোট। অন্যদের মধ্যে ১৩২৮ লাঙ্গল প্রতীক, ৪৩ ডাব প্রতীক, ৬৪ ছড়ি প্রতীক, ২০২ সোনালী আশ প্রতীক, ৫২ ট্রাক প্রতীক এবং ৯২৩ গোলাপ ফুল প্রতীক। এদের সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত। যাদের মোট প্রাপ্ত ভোট ২৬১২। তাহলে হিরো আলম এবং অন্যদের ভোট যোগ করলে দাঁড়ায় ৮২২১। এখন ২,৭৯,২০৫ থেকে যদি ৮২২১ বাদ দেই তাহলেও থাকে ২,৭০৯৮৪ ভোট। কিন্তু অধ্যাপক আরাফাত পেয়েছেন ২৮,৮১৬ ভোট। অর্থাৎ প্রায় ২৯০০০। এক বিশাল ব্যবধান।
এই ২৯০০০ ভোট একেবারেই ইউনিক এবং অর্গানিক। বিশুদ্ধ এবং নিখাদ। তবে এই ২৯ সংখ্যাটি কেবল ২৯ বিবেচনা করলে হবে না। মনে রাখতে হবে গুলশান বনানী এলাকায় ভোট দেবার প্রবণতা এমনিতেই কম। অন্য এলাকার সঙ্গে যার তুলনা করতে হবে কয়েকগুন দিয়ে, প্রবণতার মাত্রায়। আর সবচেয়ে বড় কথা , আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে, উন্নয়নেও এগিয়ে রয়েছে। ফলে খুব সাধারণ যে চিন্তাটি কাজ করেছে তা হলো, নৌকাতো এমনিতেই জিতবে, আমার ভোট দেবার আর কি দরকার?
এখনো পর্যন্ত আমরা এই সচেতনার জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি যে প্রতিটি ব্যক্তি ও ভোট গুরুত্বপূর্ণ। এবং আমার ভোট আমি দেব। তা ছাড়া বাই ইলেকশনকে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। বাইরের দেশের অভিজ্ঞতায় কখনো কখনো প্রার্থীও খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এই সেই সকল বিবেচনায় ২৯ হাজার ভোটকে কেবল ২৯,০০০ ভাবলে হবে না। এই অংক ও সংখ্যার ভিন্ন অর্থবোধকতাও রয়েছে, মনে রাখতে হবে।
তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে একটি জিজ্ঞাসা, আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের প্রতি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, মানুষ উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে, মানুষ নৌকায়ই ভোট দেবে এই ভেবে নিজে ভোট না দিয়ে বসে থাকবার কী যুক্তি থাকতে পারে? নাকি এখানে অন্য কোনো হিসাব কাজ করেছে।
হিসাব যাই হোক, যার যতো ব্যক্তিগত হিসেবই থাকুক, আরাফাত হেরে গেলে রাজনীতি জিতে না, কেননা সে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ দর্শনের উপর, যে দর্শন আর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই ভিত গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের।
অতএব সাধু সাবধান!
লেখক: সম্পাদক, আজ সারাবেলা। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/জেআইএম