রাজনৈতিক নেতাদের মনোভাব, ব্যবসায়ীদের চাওয়া এবং মানুষের প্রত্যাশা
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার দুটি আলাদা প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করলেও রাজনৈতিক সংকট নিরসনের পথ প্রশস্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলাদা বৈঠকে নিজ নিজ দাবিতে অনড় থাকলেন ৫টি রাজনৈতিক দলের নেতারা। এতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং আমার বাংলাদেশ পার্টি নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন।
এ পরিস্থিতিতে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন আদৌ সম্ভব কি না- ইইউ প্রতিনিধি দল এমন প্রশ্নও তুলেছে বলে জানিয়েছেন এসব বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা। তারা বলেন, রাজনৈতিক সংকট সমাধানের উপায় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে দলগুলো যদি নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে, সে ক্ষেত্রে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে কি না এমন শঙ্কাও প্রকাশ করেন ইইউ প্রতিনিধিরা।
এক নেতা জানান, সভায় প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে বলা হয় সিদ্ধান্ত হলে বাংলাদেশের নির্বাচনের সময় ইইউ ১৮০ পর্যবেক্ষক পাঠাবে। তবে এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে এবং সময়মতো ভিসা দিতে হবে।
নাগরিক সমাজের অনেকে ও বিদেশিরা আলোচনার মাধ্যমে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বলেছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি থাকলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। আর বিএনপি বলেছে, সরকার পদত্যাগে রাজি হলেই সংলাপ হতে পারে। উভয় দলের বর্তমান যে অবস্থান, তাতে দ্বিদলীয় সংলাপের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া, দুই দলের সংলাপের অতীত অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়।
অবশ্য বিপরীত অভিজ্ঞতাও আমাদের রয়েছে। এ পর্যন্ত যতবার যত রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়েছে, তার সবই হয়েছে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে। ওইসব আলোচনা ছিল বহুপক্ষীয় অথবা সর্বদলীয়। স্বাধীনতালাভের আগে এধরনের সর্বদলীয় সম্মেলনে রাজনীতিবিদরা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গেই সমাধান খুঁজতেন। আর স্বাধীন বাংলাদেশেও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠকেই তৈরি হয়েছে যৌথ ঘোষণা। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কথিত লিয়াজোঁ কমিটিতেই জেনারেল এরশাদকে অপসারণের পথ ঠিক হয়েছিল। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে সংসদের ভেতরে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের নিয়ে বিরোধীদের সম্মিলিত কর্মসূচি তৈরি হয়েছিল। সমাধানগুলোও যে আইনের মধ্যে হয়েছিল, তা-ও নয়।
তবে রাজনীতিতে আলোচনা ও সংলাপের পথ পরিহার করে রাজপথে সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে যাওয়া বিপজ্জনক।
দুই.
শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় চান ব্যবসায়ীরা। ১৫ জুলাই দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্যবসায়ীদের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ৩১ জন ব্যবসায়ী বক্তৃতা করেছেন। তাদের বেশিরভাগ আগামী মেয়াদেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে চান বলে উল্লেখ করেছেন।
এই সম্মেলনে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানে এক/এগারোর সরকার। এই সরকার এলে ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে কষ্ট করে যারা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাদের আবারও জেলে যেতে হবে। সেই স্বপ্ন যদি কেউ দেখেন, তা প্রতিহত করতে এই ব্যবসায়ীরাই যথেষ্ট।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই সম্মেলনে অনেকে আছেন যারা এক/এগারোর ষড়যন্ত্রের সরকারের সময় জেলে গেছেন, অত্যাচারিত হয়েছিলেন। আমি সৌভাগ্যবান, সেই সময় আমি দেশে ছিলাম না।’
তিনি বলেন, ‘আমি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নই; তবু ভুক্তভোগী হিসেবে অনেক সময় রাজনীতির মাঠে আসতে ইচ্ছা করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমাদের ৯ জন কর্মকর্তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। দুই মাস জেলে আটকে রাখা হয়। তাদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ানো হয়েছে। এমনকি হত্যা মামলারও সাক্ষ্য দেওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিছু মানুষকে ৮-৯ মাস জেলে রেখেছে তারা। ব্যবসায়ীরা যদি এর পুনরাবৃত্তি চান, তাহলে আবার ওই ধরনের সরকার আনতে পারেন। তবে আমি নিশ্চিত, আপনারা কেউ চান না আবার সেই সরকার আসুক।’
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, ‘আমরা আপনার সঙ্গে আছি, ব্যবসায়ীরা আছেন। আজীবন আপনার সঙ্গে থাকব। কারণ আপনার বিকল্প শুধু আপনি। আজ সারা দুনিয়ার চমক শেখ হাসিনা। ইউরোপ, আমেরিকা, ভারতসহ সারা দুনিয়াকে শেখ হাসিনা আকৃষ্ট করতে পারেন। তিনি কূটনীতির দিক থেকে দেশকে একটা মধ্যপন্থায় রেখেছেন। এতে আমাদের সব দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে।’
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী এগিয়ে গেলে এই দেশে একজন মানুষও গরিব থাকবে না। আমাদের ১৭ কোটি মানুষ আমাদের বড় শক্তি। দেশের মানুষকে নিয়ে চীন আজ বহুদূরে চলে গেছে। আমাদেরও বড় শক্তি আমাদের দেশের মানুষ। আজ ইউরোপ ও আমেরিকা বাংলাদেশকে তাদের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখছে। সম্প্রতি ইউরোপ ও আমেরিকার প্রতিনিধিরা এসে বলে গেছেন, তারা বাংলাদেশে এসেছেন সম্পর্ক জোরদার করতে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার করো বা এটা করো ওটা করো- এমন কিছু তারা চাপিয়ে দিয়ে যাননি। বলেছেন, একটি সুন্দর নির্বাচন করো। আমাদের নেত্রীও এটা চান। এ ব্যাপারে কারও কোনো আপত্তি নেই।’
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে কাজ করছেন। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা হিসেবে পাঁচ কোটি মানুষকে ভাতা দিয়েছেন। বছরে ৫৭ হাজার কোটি টাকার ভাতা দিচ্ছেন। এর সুফল ভোগ করছে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাই অনেকে বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার। আমি মনে করি, একসময় বঙ্গবন্ধুর কোনো বিকল্প ছিল না, তেমনি আজ শেখ হাসিনার বিকল্প শুধু শেখ হাসিনাই।’
এফবিসিসিআই’র সম্মেলনে সাধারণ মানুষের সমস্যা, সংকটের কথাও যদি আলোচনায় আসতো, যদি ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধির ফাঁদ থেকে ভোক্তাদের রেহাই দেওয়ার অঙ্গীকার করতেন, তাহলে তাদের বক্তব্যের সঙ্গে সাধারণ মানুষও একাত্মবোধ করতো। ব্যবসায়ীদের সাধারণ মানুষ তাদের পক্ষের বলে মনে করতে পারে না বলেই তারা সরকারের পক্ষে অবস্থান নিলে মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়। ব্যবসায়ীদের মতো দেশের অনেক মানুষই শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় দেখতে চায়। কিন্তু তারা চায় তাদের ভোটেই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরুন। মানুষ ভোট দেওয়ার অধিকার বঞ্চিত হতে চায় না। সাধারণ মানুষের এ প্রত্যাশার কথাটাও ব্যবসায়ীদের বিবেচনায় নিতে হবে।
আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সব সময় শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে চান। শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসা করে দেশকে এগিয়ে নিতে চান। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, রাজনীতির নামে আগুন সন্ত্রাস, হরতাল, অবরোধ আর পদযাত্রার মিছিল চলে।’
তিনি বলেন, ‘আমার অনুরোধ, মিটিং করুক, মিছিল করুক; কিন্তু জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে কোনো রাজনীতি হতে পারে না। সব রাজনীতির মূল লক্ষ্য অর্থনীতি। গণতন্ত্র মানে এই নয় যে আপনি যা খুশি তা করবেন। মানুষের জানমাল রক্ষা করতে হবে। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হবে।’
আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, ‘একসময় বলা হতো বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। এখন বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বাংলাদেশ বলা হয়। শেখ হাসিনা এখন বিশ্বের ব্র্যান্ড। সারা দেশ ও বিশ্ব তাকিয়ে থাকে কী এমন জাদু আছে তাঁর কাছে! কোন জাদুর কাঠি আছে, যেটা দিয়ে তিনি সারা বিশ্বকে আকর্ষণ করেন। সারা বিশ্বের তিনি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন।’
তিন.
আহমেদ আকবর সোবহানের বক্তব্য এতটা উদ্ধৃত করার কারণ, তার বক্তব্যে যেমন আবেগ আছে, তেমনি যুক্তিও আছে। তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা অস্বীকার করার মতো নয়। তবে তিনি নিজে ব্যবসায়ী হওয়ায় তার বক্তব্যে ব্যবসায়ীদের কোনো সমালোচনা নেই। সব ব্যবসায়ী যে সৎ ও দেশপ্রেমিক নন- এটা তো ঠিক। সরকারের সব ভালো কাজ যে প্রশংসিত হচ্ছে না, তার একটি বড় কারণ একশ্রেণির ব্যবসায়ীর অসততা ও মাত্রাতিরিক্ত মুনাফাখোরি। সিন্ডিকেট গড়ে তুলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম খেয়ালখুশি মতো বাড়িয়ে দেশের সরকার ও মানুষকে জিম্মি করার দায় ব্যবসায়ী নেতারা এড়াতে পারেন না।
শেখ হাসিনার আমলে দেশের উন্নয়নযাত্রা অব্যাহত থাকলেও মূল্যবৃদ্ধির চাপে অনেক মানুষের জীবনই সংকটাপন্ন। এই মূল্যবৃদ্ধি অধিকাংশ সময়ই ঘটে অসৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। সমাজে ধনবৈষম্য প্রবল হওয়ায় কিছু মানুষ যথেষ্ট ভালো থাকলেও বিপুল সংখ্যক মানুষের আয়-ব্যয়ের সঙ্গতি নেই। তাদের দিন কাটছে অতি কষ্টে। সরকারের ওপর ব্যবসায়ী বা ধনিক শ্রেণির প্রভাব যতটা প্রবল, সাধারণ মানুষের প্রভাব ততটা নয়। সরকার যতটা ব্যবসায়ীবান্ধব ততোটা জনবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি বলে অনেকেই মনে করেন। এটা মনে করা অযৌক্তিক নয়।
এফবিসিসিআই’র সম্মেলনে সাধারণ মানুষের সমস্যা, সংকটের কথাও যদি আলোচনায় আসতো, যদি ব্যবসায়ীরা মূল্যবৃদ্ধির ফাঁদ থেকে ভোক্তাদের রেহাই দেওয়ার অঙ্গীকার করতেন, তাহলে তাদের বক্তব্যের সঙ্গে সাধারণ মানুষও একাত্মবোধ করতো। ব্যবসায়ীদের সাধারণ মানুষ তাদের পক্ষের বলে মনে করতে পারে না বলেই তারা সরকারের পক্ষে অবস্থান নিলে মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়। ব্যবসায়ীদের মতো দেশের অনেক মানুষই শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় দেখতে চায়। কিন্তু তারা চায় তাদের ভোটেই শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরুন। মানুষ ভোট দেওয়ার অধিকার বঞ্চিত হতে চায় না। সাধারণ মানুষের এই প্রত্যাশার কথাটাও ব্যবসায়ীদের বিবেচনায় নিতে হবে।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম