ডেঙ্গুতে মরছে মানুষ জবাবদিহিতা কোথায়?
প্রতিদিনের সংবাদ শিরোনাম ক্রমশ আতঙ্কিত করে তুলছে আমাদের। মশার কামড়ে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। করোনার থাবা থেকে কোনোরকম বেঁচে ফিরলেও মশার কাছে যেন হার মানছে জীবন।
প্রতিদিন কমপক্ষে ৬-৭ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন। এই ডেঙ্গুর ভয়াবহতা নতুন করে প্রতিবছর আবির্ভূত হচ্ছে আমাদের জীবনে। এ সমস্যা কিন্তু নতুন করে শুরু হয়নি। বেশ অনেক বছর ধরেই একই আলোচনা চলছে। অন্যবার বর্ষায় হলেও এবছর বর্ষার আগেই মানুষ মারা যাচ্ছে ডেঙ্গুতে। শুনছি মশাও নাকি মিউটেশন করতে করতে এখন সর্বংসহা হয়ে গেছে। আগে তিনি কামড়াতেন কেবল একটা নির্দিষ্ট সময়ে, জন্মাতেন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের পানিতে। আর এখন?
এখন তার কামড়ানোর সময় নির্ধারিত নাই, জন্ম বা বাসেরও নির্ধারিত কোনো স্থান নেই। সব সময় সব পানিতেই জন্মাচ্ছে এডিশ মশা। কিন্তু আমাদের কর্তৃপক্ষের যেন কোনো মিউটেশন ঘটে না। তারা এখনও এক ফগার মেশিনেই বসে আছে। উত্তর সিটি করপোরেশন অবশ্য মশা মারতে কামান হিসেবে ড্রোন দিয়ে মশার লার্ভা জন্মানোর জায়গা খুঁজে বের করছে দেখলাম। কিন্তু এত সব আয়োজনের মাঝে কমছে কই? হাসপাতালে মানুষের স্রোত লম্বা হয়ে যাচ্ছে।
মঙ্গলবার দেশে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হওয়ার রেকর্ড হয়েছে। এক হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন আর একদিনে সাতজন মারা গেছেন। চট্টগ্রামের মেয়র বলেছেন ড্রোন দিয়ে ডেঙ্গু জন্মানোর স্থান নির্ধারণ করবেন। তারা সবাই সিজন এলেই এই করবেন সেই করবেন বলে আমাদের সান্ত্বনা দেন কিন্তু আগে থেকেই করেননি কেন সেই জবাবটা কার কাছে চাইবো আমরা? কেউ কি আছে এই জবাব চাওয়ার?
ঢাকা উত্তরের মেয়র হেঁটে বেড়াচ্ছেন, খুঁজে বেড়াচ্ছেন কোথায় লার্ভা আছে বা নাই। এটা কি হওয়ার কথা ছিল? আসলে সবকিছুর জন্য প্রয়োজন পূর্ব প্রস্তুতি আর একটি স্থায়ী ব্যবস্থাপনা। মনে আছে এর আগের মেয়র আনিসুল হকের সময় আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম মশা দমনের দাবিতে। অনেক সফলতার পরেও তিনি অনেক সমালোচিতও হয়েছিলেন কেবল এক মশার কারণে। মানুষের গালিগালাজ সহ্য করতে হয়েছিল তাকে। তিনি আজ নেই আমাদের মাঝে কিন্তু মশারা রয়ে গেছে। আর রয়ে গেছে সেই একই ভাষা।
এটা সত্য যে আমরা মানুষও অসচেতন। নিজেদের থাকার জায়গাটাও পরিষ্কার রাখতে পারি না আমরা। কিন্তু এটাতো অজানা নয় যে, সাধারণ মানুষ অসচেতন হবেই বা আছেও তাই। আর সব অসচেতনাকে মাথায় রেখেইতো তবে আমাদের উদ্ধারের কাজটি করার কথা। আমাদের পাশের দেশের শহর কলকাতা। সকাল বিকেল আমরা কলকাতা যাই নানা প্রয়োজনে। সেই কলকাতা ইতিমধ্যে ডেঙ্গুর মতো মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে।
কয়েক বছর আগে কলকাতার মেয়রদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের বিষয়টাও আমরা দেখেছিলাম। আমাদের সবকিছু আলোচনায়ই থেকে যায় কেন জানি না। ড্রোন ব্যবহার, জরিমানা করা সবকিছুই হয় ডেঙ্গু যখন তার ভয়াল থাবাটা ফেলতে শুরু করে। এখনও বর্ষা চলে যায়নি। আগস্ট, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকটতা আরও বাড়বে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে প্রকট হয়ে সে আর কী কী ঘটাবে? আর কত প্রাণ কেড়ে নেবে সামান্য মশার কামড়।
প্রস্তুতির ঘাটতির কথা বলা হয় ফি বছর। আলোচনার টেবিলেই পড়ে থাকে সেই প্রস্তুতির প্রতিশ্রুতিমালা। সিজন শেষ তো সব শেষ। অপেক্ষা করি আবারও কবে মানুষ মরবে আবার কবে আলোচনার ঝড় উঠবে তারপর কাজে নামবে মশা নিরোধক বাহিনী।
প্রস্তুতির ঘাটতির কথা বলা হয় ফি বছর। আলোচনার টেবিলেই পড়ে থাকে সেই প্রস্তুতির প্রতিশ্রুতিমালা। সিজন শেষ তো সব শেষ। অপেক্ষা করি আবারও কবে মানুষ মরবে আবার কবে আলোচনার ঝড় উঠবে তারপর কাজে নামবে মশা নিরোধক বাহিনী।
আতঙ্কোর সংবাদ হচ্ছে গবেষকরা বলছেন, আবদ্ধ পানিতে নয় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে পরিষ্কার পানিতেও। ভোর আর বিকেল ছাড়া কামড়ায় না এমন ধারণাও নাকি ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। অর্থাৎ, এডিস মশা এখন আলো থাকলেই কামড়াচ্ছে। রেহাই নেই। কিন্তু এই যে নতুন নতুন তথ্য সামনে আসছে সেসব নিয়ে জনসচেতনতার জন্য এখন পর্যন্ত দেশব্যাপী কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
এত বছর ডেঙ্গু কেবল ঢাকায়ই বেশি পাওয়া যেতো কিন্তু এ বছর ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো হচ্ছে অসচেতনতার ফলে। কারণ গ্রামের মানুষজন মশারি টানায় না। ডেঙ্গু সম্পর্কে কোনো বাস্তব ধারণা তাদের নেই। ঠিক যেমনটা ছিল না করোনার শুরুতে।
এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত অনতিবিলম্বে শহর থেকে শুরু করে গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করে মানুষকে সচেতন করার কাজটি করা। ডেঙ্গু কী, কেন হচ্ছে এবং কোন কোন উপসর্গ হলে কী করা উচিত বা কেন জ্বরকে অবহেলা করা উচিত নয়- এমন প্রাথমিক বিষয়গুলো নিয়ে সবাইকে জানানোর কোনো বিকল্প নেই।
যতই প্রযুক্তি আনেন না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষকে সচেতন না করা যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এমন মহামারির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরও সক্রিয় কার্যক্রম দেখতে চাই আমরা। একজন মানুষের মৃত্যুও কিন্তু তাদের জবাবদিহিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম