হজ বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের প্রতীক

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৫০ এএম, ২৭ জুন ২০২৩

‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাক’ (আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার)। এই বাণীতে উচ্চকিত হয়ে শ্বেতশুভ্র ইহরাম পরিহিত লাখ লাখ হাজি সম্মিলিত হয়েছেন ‘বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের প্রতীক’ হজের আনুষ্ঠানিকতায়। মিনা, আরাফাত, মুজদালিফার প্রান্তরে অবস্থান শেষে পবিত্র মক্কায় কাবা গৃহে তাওয়াব করে তারা সম্পন্ন করবেন হজের কার্যক্রম। আল্লাহপাক তাদের হজ কবুল করে নিন, আমিন।

হজ একটি মহান আধ্যাত্মিক বিধান এবং ইসলামী ইবাদতগুলোর মধ্যে হজের গুরুত্ব অপরিসীম, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয় মানব জাতির জন্য (কল্যাণের) প্রথম যে ঘরটি বানানো হয়েছিল সেটি বাক্কায় অবস্থিত। এ ঘরটি বরকতপূর্ণ এবং বিশ্বজগতের জন্য হেদায়াতের কারণ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬)।

আল্লাহতাআলার পবিত্র ঘর বায়তুল্লাহ বা খানা কাবা এবং বিশ্ব নবি ও শ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর পবিত্র রওজা মোবারক জিয়ারতের সাধ প্রতিটি মুসলমানেরই হৃদয়ে জাগে। হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ইচ্ছা করা বা কোনো কিছুর সংকল্প করা। ইসলামি পরিভাষায় এর অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসার উদ্দেশ্যে শরিয়তের বিধান অনুযায়ী জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে পবিত্র কাবা এবং কয়েকটি বিশেষ স্থানে আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) নির্দেশ অনুযায়ী জিয়ারত, তাওয়াফ, অবস্থান করা এবং নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন করা।

পবিত্র কোরআনে এই ইবাদত সম্পর্কে এভাবে উল্লেখ রয়েছে- ‘আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ ঘরের হজ করা সেসব লোকের জন্য ফরজ যারা সে পর্যন্ত যাওয়ার সামর্থ্য রাখে। কিন্তু যে এটা অস্বীকার করে সে জেনে রাখুক আল্লাহ জগৎসমূহের মোটেও মুখাপেক্ষি নন’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)। এ ইবাদত গরিব মুসলমানের জন্য ফরজ নয় এবং যার জানের নিরাপত্তা নেই তার ক্ষেত্রেও হজ ফরজ নয়। শুধু দৈহিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্যই এই ইবাদতকে ফরজ করা হয়েছে।

আল্লাহপাক যেহেতু বান্দার অন্তর দেখেন তাই তিনি অন্তকরণের হজকেই গ্রহণ করেন। যাদের অন্তর অপবিত্র তাদের সাথে আল্লাহপাকের যেমন কোনো সম্পর্ক নেই তেমনি তারা কোরআনের শিক্ষার ওপর আমলের ক্ষেত্রেও থাকে উদাসীন। যেভাব কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আসলে তাদের হৃদয় এ কোরআন থেকে উদাসীন।’

এছাড়া তাদের আরও অনেক মন্দ কর্ম রয়েছে, যা তারা করে চলেছে (সুরা আল মোমেনুন, আয়াত: ৬৩)। অন্যদিকে যারা মুমিন তাদের অন্তর থাকে পবিত্র আর এদের সম্পর্কেই আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, ‘হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভুপ্রতিপালকের দিকে সন্তুষ্ট হয়ে এবং তাঁর সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আস। অতএব তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (সুরা আল ফজর, আয়াত: ২৭-৩০)।

মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির উচ্চতম পর্যায় হচ্ছে, সে তার প্রভুর ওপর পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট এবং তার প্রভুও তার ওপর পুরোপুরি সন্তুষ্ট। এমন অবস্থাকে বেহেশতি অবস্থা বলে, যে আত্মার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট সেই আত্মাও তার রবের প্রেমে এমনভাবে বিলীন ও একীভূত হয়ে যায় যে, এমন অন্তর তখন আর আল্লাহ ছাড়া কিছুই বোঝে না। আসলে যারা আল্লাহপাকের মুমিন বান্দা তারা ইহকালেই তাঁর কাছ থেকে ‘হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা’ এই আহ্বানের ডাক শুনতে পায়।

হজের গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেছেন ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজব্রত পালন করে আর কোনো ধরনের অশালীন কথাবার্তা ও পাপ কাজে লিপ্ত না থাকে সে যেন নবজাত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ অবস্থায় হজ থেকে ফিরে এলো’ (বোখারি ও মুসলিম)।

এ হাদিসের ওপর ভিত্তি করে অনেকেই পয়সার জোরে প্রতিবছর হজ সম্পাদন করেন আর প্রতি বছরের গুনাহ-খাতা মাফ করিয়ে আনেন। হজ পালন করলেই নিষ্পাপ হয়ে যাব, এমন এক অদ্ভুত মনমানসিকতাও আমাদের সমাজের অনেকের মাঝে বিরাজ করে। মহান আল্লাহপাক যাদের হজ করার সামর্থ্য দান করেছেন তাদের উচিত কেবল আল্লাহকে লাভ করাই যেন উদ্দেশ্য হয় আর পূর্বের সব দোষ-ত্রুটির ক্ষমা চেয়ে মুমিন-মুত্তাকি হয়ে বাকি জীবন যেন অতিবাহিত করে। আর যদি এমনটি হয় যে, হজ থেকে ফিরে এসে পূর্বের মতোই জীবন পরিচালিত করতে থাকে তাহলে তার হজ করা আল্লাহর দরবারে কোনো মূল্য রাখে না।

অনেকে এমনও রয়েছেন যারা একাধিকবার হজ করেন আর কয়েকবার হজ করা সত্ত্বেও তার মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। নিজের মাঝে পবিত্র পরিবর্তনই যদি না আসে তাহলে এ হজ বৃথা। আমার পাশের ঘরের মানুষ না খেয়ে রাতযাপন করবে আর আমি হজ করতে যাব এ ধরনের হজকারীর কোনো মূল্য নেই আল্লাহর দরবারে। এছাড়া যারা একবার হজ করেছেন তারা ইচ্ছে করলে অন্য কাউকে হজ পালন করার সুযোগ করে দিতে পারেন, ফলে দুজনই পুণ্য লাভ করতে পারেন।

আমাদের প্রিয় নবি (সা.) মানবতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি বিদায় হজের ভাষণেও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। হিজরি নবম বর্ষে মহানবি (সা.) হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় এলেন। মুজদালেফা থেকে ফেরার পরে হজের রীতি অনুযায়ী তিনি মিনায় থামেন এবং ১১ই জিলহজ তারিখে তিনি (সা.) সমবেত সমস্ত মুসলমানের সামনে দাঁড়িয়ে এক ভাষণ দান করেন। এই ভাষণে তিনি (সা.) বলেন: ‘হে লোক সকল! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন। কেননা, আমি জানি না যে, এই বছরের পর আর কখনও আমি এই ময়দানে তোমাদের সাথে দাঁড়িয়ে আর কোনো বক্তৃতা দিতে পারবো কি না।

‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের জীবন ও তোমাদের সম্পদ একে অপরের হামলা থেকে কেয়ামত পর্যন্ত পবিত্র ও নিরাপদ করে দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক ব্যক্তির উত্তরাধিকারের অংশ নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এ ধরনের কোনো ওছিয়ত বৈধ হবে না, যা কোনো বৈধ উত্তরাধিকারীর ক্ষতির কারণ হয়। যার ঘরে যে সন্তান জন্ম নেবে, সে তারই সন্তান হবে। এবং কেউ যদি এই সন্তানের পিতৃত্বের ওপরে দাবি উত্থাপন করে, তাহলে সে শরিয়ত মোতাবেক প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করবে।

হে লোক সকল! তোমাদের হাতে এখনও কিছু যুদ্ধবন্দি রয়ে গেছে। আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি যে, তোমরা তাদের তাই খাওয়াবে যা তোমরা নিজেরা খাও। এবং তাদের তাই পরতে দিবে, যা তোমরা নিজেরা পর। যদি তারা এমন কোনো অপরাধ করে ফেলে, যা তোমরা ক্ষমা করতে পার না, তাহলে তাদের অন্যের কাছে দিয়ে দেবে। কেননা, তারা খোদারই বান্দা। তাই, কোনো অবস্থায়ই তাদের কোনোরূপ কষ্ট দেওয়া বৈধ হবে না।

হে লোক সকল! আমি তোমাদের যা বলছি, তা শোন এবং ভালোভাবে মনে রেখো। প্রত্যেক মুসলমান প্রত্যেক মুসলমানের ভাই। তোমরা সবাই সমান। সব মানুষ, তা তারা যে কোনো জাতিরই হোক আর যে ধর্মেরই হোক, মানুষ হওয়ার কারণে, পরস্পর সমান। (এই কথা বলার সময় তিনি (সা.) তার উভয় হাত ওপরে তুললেন এবং এক হাতের আঙুলগুলোকে অপর হাতের আঙুলগুলোর সঙ্গে মিলালেন এবং বললেন) যেভাবে দুই হাতের আঙুলগুলো পরস্পর সমান, সে ভাবেই সব মানুষ পরস্পর সমান।

তোমাদের কোনো অধিকার নেই যে, তোমরা একে অন্যের ওপরে কোনো শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কর। তোমরা পরস্পর ভাই। তোমরা কি জান, এখন কোন মাস? এই এলাকা কোন এলাকা? তোমাদের কি জানা আছে, আজকের দিন কোন দিন?

লোকেরা উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, এই মাস পবিত্র মাস। এই এলাকা পবিত্র এলাকা। আজকের দিন হজের দিন।’ তাদের সবারই উত্তর শুনে রাসুলুল্লাহ্ (সা.) বলতে থাকলেন, যেভাবে এই মাস পবিত্র মাস, যেভাবে এই এলাকা পবিত্র এলাকা, যেভাবে এই দিন পবিত্র দিন, তেমনিভাবে আল্লাহতাআলা প্রতিটি মানুষের জান, মাল ও সম্মান পবিত্র করে দিয়েছেন। এবং কারও জানের ওপরে কিংবা মাল ও সম্মানের ওপরে হামলা করা ঠিক তেমনি অবৈধ যেমন অবৈধ এই মাসের এই এলাকায় এই দিনের অমর্যাদা করা। এই হুকুম শুধু আজকের জন্যই নয়, শুধু কালকের জন্যই নয়, বরং সেই দিন পর্যন্ত প্রত্যেক দিনের জন্য যেদিন তোমরা খোদার সঙ্গে গিয়ে মিলিত হবে।

তিনি (সা.) আরও বললেন, ‘এই সব কথা যা আমি আজ তোমাদের বলছি তা তোমরা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে দিও। কেননা, এমনও হতে পারে যে, যারা আজ আমার কথা আমার কাছ থেকে শুনছে, তাদের চাইতে যারা আমার কাছ থেকে আমার এই কথা শুনছে না, তারা এই সব কথার ওপরে বেশি আমল করবে, বেশি বেশি পালন করবে।’ এই সংক্ষিপ্ত ভাষণ বলে দিচ্ছে যে, মানুষের মঙ্গল এবং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য রাসুল করিম (সা.) কত বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন।

আল্লাহতাআলা বিশ্বমুসলিম উম্মাকে শ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুপম আদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।