ধর্ম
একই উৎস থেকে সবার সৃষ্টি
সবার সৃষ্টি একই উৎস থেকে। যেভাবে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মানুষ! তোমাদের প্রভু-প্রতিপালকের তাকওয়া অবলম্বন কর, যিনি একই সত্তা থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন আর তাদের উভয় থেকে বহু নর ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন’ (সুরা আন নিসা, আয়াত: ১)।
মানুষ হিসেবে আমরা সবাই একই উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত এবং একই বংশধর হওয়া সত্ত্বেও আজ আমরা একে অপরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব পোষণ করছি।
আল্লাহপাক সমস্ত আদম সন্তানকে প্রভূত সম্মান ঠিকই দান করেছেন কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা সেই সম্মান ধরে রাখতে পারি নি। সব আদম সন্তানকে আল্লাহতায়ালা সমভাবে সম্মানিত করেছেন এবং কোন বিশেষ জাতি বা গোত্রের প্রতি পক্ষপাতমূলক ব্যবহার করেননি। একজন মানুষ সে যে ধর্মেরই হোক না কেন তার মূল পরিচয় হলো সে আদম সন্তান। মানুষ হিসেবে তিনি কাউকে পৃথক করেননি। তার দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং একই উম্মাহ কিন্তু পরবর্তিতে মানুষ বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়।
যেমন কোরআনে আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেছেন, ‘আর মানবজাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে তারা মতভেদ করলো’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ১৯)।
আবার বলা হয়েছে, ‘কিন্তু তারা তাদের মাঝে নিজেদের বিষয়কে বহু খণ্ডে খণ্ডিত করে ফেলেছে। প্রত্যেক দল তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে অহংকার করছে’ (সুরা মোমেনুন, আয়াত: ৫৩)।
আসলে সমসাময়িক নবীর মৃত্যুর পরে নবীর অনুসারীরা সাধারণত নিজেদের মধ্যে মতভেদ আরম্ভ করে এবং দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর প্রত্যেক দলই মনে করে তারাই নবীর সত্য অনুসারী এবং অন্যান্যরা ভ্রান্ত কিন্তু সব নবী অনুসারীরাই আদম-হাওয়ারই বংশধর।
আল্লাহপাক এই পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন মানবের সংশোধন আর দলে-উপদলে বিভক্ত না হয়ে সবাই যেন একই সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করে। এক নেতৃত্বের অধিনে থেকে জীবন পরিচালিত করাই আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা আর এ লক্ষ্যেই তিনি নবী-রাসুলদের প্রেরণ করেছেন।
আজ মুসলিম জাহানের অবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝা যায়, তাদের অবস্থা কোন পর্যায় গিয়ে পৌঁছেছে। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মাঝে নেই কোন ঐক্য। মহানবীর শিক্ষা আমরা ভুলে বসেছি। যেখানে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার সমগ্র উম্মাহ একটি দেহের ন্যায়। যদি সেই দেহের কোন একটি অঙ্গ ব্যথা পায়,তাহলে তার ব্যথায় সারা শরীর ব্যথিত হয়।’ (মুসলিম)
সমগ্র বিশ্বে আজ মাজহাবের ফেরে মরছে সাধারণ নিরিহ মানুষ। আজ পাকিস্তানে যেমন সুন্নিরা আক্রান্ত হচ্ছে শিয়াদের দ্বারা শিয়ারা আক্রান্ত হচ্ছে সুন্নিদের দ্বারা আবার আহমদিয়া সদস্যরাও সেখানে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাকিস্তানে আজ এমন কোনো দিন অতিবাহিত হয় না যেখানে মাজহাবের ফেরে ডজন খানেক লোককে প্রাণ না হারাতে হয়। এছাড়া ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়েমেনসহ বিশ্বের বহু দেশে কেবল মাত্র এই মাজহাবের কারণে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাতে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। চালানো হচ্ছে নিরীহ নিরপরাধ অবোধ শিশুদের ওপর একের পর এক বর্বরোচিত হামলা।
আসলে শিশুদের তো কোন মাজহাব বা ধর্ম নেই। সব শিশুই জন্মগ্রহণ করেন এক অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তার উম্মত হিসেবে কিন্তু পরবর্তিতে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে একেক জন ভিন্ন ভিন্ন মত-পথ অনুসরণ করে।
বেশ অনেক বছর ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বে চলছে মাজহাবি যুদ্ধ। ওয়াহাবী আর সুন্নিরা আক্রমণ চালাচ্ছে শিয়াদের ওপর। ইয়েমেনের রাজধানী সানায় যুদ্ধবিমান থেকে একের পর এক বোমাবর্ষণও তখন প্রায় করা হত আর এতে প্রাণ হারাত শতশত ইয়েমেনি মুসলমান। যেহেতু সৌদি আরবের অর্থের কোনো সমস্যা নেই তাই সৌদি আরবের সাথে মিসর, জর্ডান, মরক্কো, সুদান, পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ একাত্মতা ঘোষণা করতেও আমরা দেখেছি।
অপর দিকে ইয়েমেনে হামলায় সৌদি আরবকে অস্ত্রপাতি সরবরাহ ও গোয়েন্দা সহায়তা দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এ ধরণের বিষয়গুলো আমাদেরকে অনেক ভাবিয়ে তুলে। এক মুসলমান ভাই অপর মুসলমানের আঘাতে মড়ছে আর এর জন্য সহায়তা করছে অপর কেউ অথচ আমরা পড়ে আছি মাজহাব নামক শব্দের খাঁচায় বন্দি হয়ে।
কবি নজরুল যথার্থই বলেছেন, ‘কাহারে করিছ ঘৃণা ভাই, কাহারে মারিছ লাথি? হয়তো উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন দিবারাতি।’ আবার তিনি গেয়েছেন- ‘তুমি চাহ নাই ধর্মের নামে গ্লানিকর হানাহানি, তলওয়ার তুমি দাও নাই হাতে, দিয়াছ অমর বাণী, মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা, সার করিয়াছি ধর্মান্ধতা, বেহেশত হতে ঝরে নাকো আর তাই তব রহমত। ক্ষমা করো হজরত।’
আসুন না ধর্মের নামে রক্তের হোলি খেলা বন্ধ করি। যার যার ধর্ম সে তার মত করে স্বাধীনভাবে শান্তি ও পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে পালন করবে-এটাই আমাদের কাম্য।
লেখক: গবেষক।
এইচআর/জিকেএস