জনমত পেতে ভোটারের উপর নির্ভরশীলতা ফিরুক
গণতন্ত্রে ভোট হচ্ছে বড় শক্তি। একসময় ভোটারদেরকে শ্রদ্ধা করতো ভোটপ্রার্থীরা। প্রার্থী নিজে ভোটারদের নিকট গিয়ে অনুনয়-বিনয় করে সমর্থন চাইতো। এখনকার দিনে প্রার্থীরা বিরাট সাজবহর নিয়ে রাজপথে নেমে শক্তির মহড়া দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা জানান দেয়। তারা লবিং গ্রুপিং করে দলের মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এজন্য তারা সবকিছু বিসর্জন দিতে রাজি। এমনকি মনোনয়ন পেলেই নিজেকে বিজয়ী মনে করে মিছিল শুরু করে দেয়, পশু জবাই করে ধুমধাম খাওয়া-দাওয়া শুরু করে। কিছু সরকারি কর্মচারী লোকলজ্জা ভুলে তাদেরকে আগেই তোয়াজ-তোষণ শুরু করে।
অবশ্য এই হীন কৃষ্টি শুরুর আগের কয়েক যুগ ছিল স্থানীয় মাস্তান ও পেশিতন্ত্রের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের সময়কাল। এসময় স্থানীয় মাস্তানদের মাধ্যমে ভোটকেন্দ্র দখল, ভোটের বাক্স নিয়ে পলায়ন, মারামারি, হামলা, রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে বিপক্ষ প্রার্থীদেরকে কেন্দ্র আসতে বাধা প্রদান, প্রতিপ্রক্ষর সমর্থকদের বাড়ি-দোকানে হামলা, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ঘৃণ্য কৃষ্টি বিরাজ করতো। পুলিশ এলে পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে যেত। কারণ এগুলো ছিল সাময়িক ও অপেশাদারী কাজ। বিগত দুই-তিন যুগ আগে থেকে এই ন্যক্কারজনক চরিত্রের বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এসবের জায়গা দখল করে নিয়েছে পেশাদারী মাস্তান ও উচ্চপদে সরকারি বেতনভূক কিছু অনৈতিক লোকজন।
সরকারি কর্মচারীরা আগে নির্বাচনের সময় বিশেষ সেবা প্রদান করতো। তাদের উপর মানুষের অনেক আস্থা ও ভরসা ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে দলীয় রাজনীতি দেশের প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা-সেবা অঙ্গনে ঢুকে পড়ায় নির্বাচন নিয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় শুরু হয়েছে। পেশাদার ও প্রশাসনিক সন্ত্রাসীরা আইনের ভয় পাবার তোয়াক্কা করে না। কারণ, তারা আইনের ছায়ার নিচে থেকে উপরের মদদপুষ্ট হয়ে এসব কাজ করে। ফলে সামনের কোন বাধাকেই বাধা মনে করে না। বরং একাজে তাদের একজন এগিয়ে গিয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে গেলে অন্যরাও নিজেদেরকে বোকা ভেবে বসে না থেকে উৎসাহের সংগে তাদের সাথে হাত মেলায়। নয়তো নানাভাবে বঞ্চিত হবার ভয় থাকে। তাই এটাকে তারা সুযোগ ভেবে দিব্যজ্ঞান মনে করে। এর ফলে অতিদ্রুত নির্বাচনী সংস্কৃতিতে অনৈতিকতা ঢুকে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
এই হীন পরিস্থতি তোয়াজ-তোষণ, ঘুস-দুর্নীতি, নিয়োগ-পদন্নোতি, ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়া ইত্যাদি আরো বহু ক্ষতিকর বিষয়ের জন্ম দিয়েছে। তাদের সহযোগিতায় নির্বাচিত নেতারা তাদেরকেই সার্বক্ষণিক পৃষ্ঠপোষকতা দান করতে থাকায় সবক্ষেত্রে একদল মানুষ নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের তালিকাভুক্ত হয়ে মানবেতর জীবনকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।
অধুনা এই পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়েছে যে, মানুষের মধ্যে যে কোনো প্রকারে মনোনয়ন পেয়ে সহজে নির্বাচিত হবার লোভ চাড়া দিয়ে উঠেছে। আর এই যাত্রায় টাকাওয়ালা সবচেয়ে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত। মানুষের টাকা বেশি হলে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা পেতে বেশি আগ্রহ জন্মে। সেজন্য আমাদের দেশে সংসদে টাকাওয়ালা নেতাদের সংখ্যা বেশি। এজন্য আন্তঃ ও অন্তর্দলীয় কোন্দলও কম নয়। সংসদের বাইরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এরূপ কোন্দল আরো বেশি। সম্প্রতি গাজীপুর সিটি নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানে জনগণের উপর নির্ভরশীলতা প্রমাণ করতে গিয়ে পেশিশক্তি দূরে থাকায় সকাল ৮টা- বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট নেবার পর বিশৃংখলা হয়নি। তবে অজানা কারণে অনেক দেরিতে ভোটের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। ইভিএম ভোট নিয়ে যদি একটি সিটির ফলাফল ঘোষণা করতে এত দেরি হয় তাহলে জনমনে সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়। এই নির্বাচনকে এসিড টেস্ট হিসেবে নিয়ে যদি আবারো কোনো কারণে অন্যান্য নির্বাচনে পেশাদারী পেশিশক্তিকে ব্যবহার করে জয়লাভের চেষ্টা করা হয় সেটা হবে গণতন্ত্রকে বার বার হত্যা করার শামিল।
আমাদের দেশে নির্বাচন ব্যবস্থায় মাঠ পর্যায়ে যে ব্যাপক পরিবর্তন প্রচলিত হয়েছে সেটা গণতান্ত্রিক আদর্শের বাইরে গিয়ে এক ধরনের তোষণকারী শাখায় রূপ নিয়েছে। এই ধরনের শাখার চর্চা উপমহাদেশ ও বিশ্বের কিছু দেশে বড় বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। স্বীকৃত পেশাদারিত্বের ছদ্মাবরণে এরা মানুষের ভোটাধিকার হরণে সহায়তা করে চলেছে। যাতে সরকারি দায়িত্বের আড়ালে তাদের বেআইনি কৃতকর্মের উপর কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ না থাকে। দ্রুত ভয়ংকর হয়ে ওঠা এদের সাথে অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানের সদস্যরাও যুক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে দুর্বল হচ্ছে অথবা কোথাও কোথাও একবারে ভেঙ্গে পড়ছে জরুরী সেবাদান ব্যবস্থা। সরকারি সেবাদানকারী কর্মীদেরকে নিয়ে চালু করা হচ্ছে বিভিন্ন মঞ্চ। এভাবে পেশাদারী পেশিতন্ত্রকে আস্কারা দিয়ে দ্বিবিধ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে।
তাই এদের আচরণে এসেছে চরম সামন্তবাদী ও জমিদারী চরিত্র। দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে প্রশাসনিক কাজের উপর যথাযথ কর্তৃত্ব ও জবাবদিহিতা না থাকায় অলসতা, ভোগবাদিতা, বিলাসিতা ইত্যাদিতে নিবিষ্ট হয়ে সৃষ্টি হয়েছে চরম কর্মবিমুখতা। এদের অনেকে কাজ না করে নিজের দায়িত্বে ফাঁকি দিয়ে নেতাদের সাথে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। অফিসের জন্য এসি কিনতে বা শহরের বাসার ছাদে শিং মাছ চাষের পদ্ধতি শিখতে অনেককে বিদেশে ভ্রমণ করেন। অনেকের কোনো গবেষণা কাজের জ্ঞান নেই কিন্তু ভাড়াটিয়া গবেষক সাথে নিয়ে দলবলসহ ঘনঘন সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করতে দেখা যায়। অনেকে প্রমোদ ভ্রমণের সেসব ছবি সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচার করে বাহবা পেতে নিজেকে লজ্জিত মনে করে না। এভাবে একটি অকর্মণ্য শ্রেণি নিজেদের মধ্যে সরকারি সেবাদানকে নিজেদের খেয়ালখুশির সীমানায় কুক্ষিগত করে ফেলেছ। ফলে সাধারণ জনগণ মৌলিক অধিকার পূরণের জন্য সরকারি সেবা পেতে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে।
এরাই বর্তমানে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কারচুপিতে সহায়তাদানকারী এবং বিভিন্ন ভাবে অগাধ অর্থের মালিক। ফলে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, নিত্যপণ্য সংকট বা মূল্যস্ফীতির ফলে সৃষ্ট মূল্যসন্ত্রাস তাদের গায়ে আঁচড় কাটে না। আমাদের দেশে গণতন্ত্র এদের শেকলে বন্দি হয়ে পড়ায় এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতারা জনগণের কথা ভুলে গিয়ে তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার জন্য উন্মুখ হয়ে মনোনয়ন লাভের জন্য লড়াই করছে।
এটাই বর্তমানে আমাদের দেশের সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে চরম সংকট সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাধারণ জনগণ এটা বুঝতে পেরে প্রতিবাদ কিছুটা করলেও এতে তারা মোটেও বিব্রত বা অনুতপ্ত নয়। কেউ একটু কৌতূহলী হয়ে এসব কথা জিজ্ঞাসা করালেই তারা অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। কারণ প্রাচীন সামন্তবাদী বৈশিষ্ট্য তাদের মজ্জার মধ্যে ঢুকে দিনের ক্ষণে বেলা গড়িয়ে বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে।
তাদের নেতারা একদিকে এই পেশাদারী পেশিতন্ত্রের কাছে অভয়ের বাণী শুনছে অপরদিকে তাদের পরামর্শে বিদেশী প্রভূদের নিকট সহানভূতি আদায়ের জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করছে। কারণ, আমরা আমাদের চোখে দেশের অভ্যন্তরে যেভাবে গণতন্ত্রকে দেখছি, শুনছি ও চর্চা করতে বাধ্য হচ্ছি গণতন্ত্রের বৈশ্বিক মূল্যবোধ দিয়ে বাইরের বিশ্ব সেভাবে আমাদেরকে দেখে না। এমনকি সেভাবে আমাদেরকে খুঁজেও পায় না।
গণতান্ত্রিক চর্চ্চায় কেতাদুরস্ত কোট-টাই পরা পরিবেশের প্রয়োজন খুব ক্ষীণ। গণতন্ত্রের জন্য দরকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিক্ষা ও জনগণের আঙ্গুলের ছাপ বা জনসমর্থন। এজন্য জনগণের উপর নির্ভরশীলতা দরকার। এই নির্ভরশীলতা তৈরি হয় নেতা ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব বা ফাঁরাক দূর করার মাধ্যমে। এটা করতে পারলে মানুষে মানুষে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা তৈরি হয়।
সামনের জাতীয় নির্বাচনে জনমতের সঠিক প্রতিফলন পেতে সারাদেশে নির্ভেজাল ব্যবস্থা নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটতে শুরু হলে দেশ থেকে ঘুস, দুর্নীতি, দুর্বল নেতৃত্ব ও তোয়াজ-তোষণকারী, চাটুকারী প্রশাসন নিস্তেজ হয়ে যাবে। জনমত পেতে বা যাচাই করতে জনতার উপর নির্ভরশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারলে সামজিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়ে সমাজে সবার মনে শান্তি ফিরে আসবে। বিভিন্ন সামাজিক বঞ্চনা ও নোংরামী বা ক্লেশ (স্কোয়ালর) থেকে মুক্তি পাবে সকল মানুষ, বৈশ্বিক প্রক্ষাপটে উজ্জ্বল হবে দেশের ভাবমূর্তি।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস