ইন্টারনেটের দাম এত বেশি কেন?
মহিউদ্দিন আহমেদ
বর্তমান সময়ে অনেকের মনে প্রশ্ন যে, ইন্টারনেটের দাম কমছে না কেন। কারণ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী বিশেষ করে প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী সব বক্তব্যে প্রায় বলেন ব্যান্ডউইথের দাম সরকার এখন আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে এনেছে। এক লাখ ২০ হাজার টাকার ব্যান্ডউইথ এখন মাত্র ৬২৫ টাকা। আবার প্রতিবেশী দেশেও ইন্টারনেটের ডাটার দাম কম। তাহলে প্রশ্ন তো জাগতেই পারে। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে অপারেটরদের উচ্চবিলাসী জীবনযাপন অতিমাত্রায় মুনাফা এসব কারণেই ইন্টারনেটের ডাটার দাম না কমে দিন দিন বাড়ছে।
আমরা এনিয়েই ছোট্ট একটি অনুসন্ধান করবো। বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটে একটি মৌলিক অধিকার জাতিসংঘ ঘোষিত। একসময় মনে করা হতো ইন্টারনেট হলো একটি বিলাসী মাধ্যম। মূলত ১৯৮৩ সালে ইন্টারনেটের উদ্ভব হয়। আজ জাতিসংঘ ঘোষিত ইন্টারনেট এখন মৌলিক অধিকার। শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যাংক অফিস আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনোদন, আন্তর্জাতিক লেনদেন অভ্যন্তরীণ লেনদেন এমনকি সংসারে কেনাকাটায় ইন্টারনেটের ব্যবহার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
যদিও ইন্টারনেটের ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এখনো অনেকটা পিছিয়ে। মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫৪ শতাংশ নাগরিক ইন্টারনেট ব্যবহার করে। সাধারণত দুই ধরনের ইন্টারনেট আমরা ব্যবহার করি। মোবাইল ইন্টারনেট এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অর্থাৎ ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করে ভিশন ২০২১ ঘোষণা করে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ঘরে ঘরে থাকবে ইন্টারনেট সবার হাতে থাকবে স্মার্ট ডিভাইস সেবামূলক সব কর্মকাণ্ড এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রা হবে অনলাইন ভিত্তিতে। ১৯৯৬ সালের পর থেকেই মূলত টেলিকম শিল্পে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে আসে মুঠোফোন। এরপর ২০১৮ সালে মুঠোফোনে যাত্রা হয় থ্রিজি ইন্টারনেটের। এবং ২০২১ সালে শুরু হয় চতুর্থ প্রজন্মের দ্রুতগতির ফোরজি ইন্টারনেট।
এক সময় আমাদের দেশে বিটিসিএল’র ল্যান্ডফোন এবং তাদের যে ইন্টারনেটে ছিল একমাত্র ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। মূলত বড় পরিসরে ইন্টারনেট সেবা প্রদানের মাধ্যম হচ্ছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। সেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গ্রাহক সংখ্যা এখন প্রায় এক কোটি ১৯ লাখ। মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। করোনা মহামারির পর ঘরে থেকে চিকিৎসাসেবা, অফিস করা, শিক্ষা পরিচালনা করা, এমনকি কেনাকাটাসহ দৈনন্দিন কার্যক্রম ইন্টারনেটভিত্তিতে হওয়ার ফলে ইন্টারনেটের ওপর মানুষ এখন অনেকটা বেশি নির্ভরশীল।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেন এখন দৈনিক প্রায় এক লাখ কোটি টাকার ওপরে। মানুষের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। ২০০৮ সালে যেখানে মাত্র ৮শ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ আমরা ব্যবহার করতাম, সেখানে এখন ৪ হাজার ৪শ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করছি। কিন্তু ইন্টারনেটের দাম ইন্টারনেটের গতি এসব নিয়ে জনমনে আছে নানা অভিযোগ। সরকার ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ব্যান্ডউইথের দাম কমিয়ে ৬২৫ টাকা নির্ধারণ করেছে।
সে হিসাবে সরকার যখন বিশেষ করে সরকারের টেলি যোগাযোগ এবং প্রযুক্তির প্রতিমন্ত্রী প্রতিদিন বিভিন্ন সভা সেমিনারে বলেন ব্যান্ড উইথের দাম এখন পানির সমান। স্বাভাবিকভাবে যেন মনে প্রশ্নের উদয় হতেই পারে যে তাহলে তো এক জিবি মোবাইল ইন্টারনেটের দাম হওয়ার কথা আমার ২৪ পয়সা সেটা কেন আমি ৪০ টাকার ওপরে কিনছি। তাহলে কি অপারেটর আমাদের সব টাকা লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে? সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমিশনই বা কেন দাম ঠিক করে দিচ্ছে না? তার ওপর রয়েছে গ্রাহকদের ডাটা কেটে নেওয়া নির্দিষ্ট মেয়াদের পরে ডাটা থাকা সত্ত্বেও সেটি ব্যবহার করতে না পারাসহ নানা অভিযোগ।
ব্যান্ডউইথের দাম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৭ সালে প্রতি মেগা ব্যান্ডউইথ বিক্রি হতো ৭২ হাজার টাকায়, ২০০৯ সালে ১২ হাজার, ২০১১ সালে ১০ হাজার, ২০১২ সালে ৮ হাজার এবং বর্তমানে ৬২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত ১০ বছরে প্রতি মেগা ব্যান্ডইউথে দাম কমেছে ৭১ হাজার ৩৭৫ টাকা। সেই তুলনায় ইন্টারনেটের দাম কি কমেছে?
আগেই বলেছি দাম কমেনি বরং দাম দিন দিন বাড়ছে। আমরা এবার দেখে নেই ব্রডব্যান্ড যদি পানির দামেও দেওয়া হয় তাহলে কি তার সুফল জনগণ পাবে? কেন পাবে না আমরা দেখে নেই মধ্যস্বত্বভোগী প্লেয়ার কতজন। ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ আমদানি করতে অন্তত ১৬টি পক্ষ জড়িত থাকে। এদের মধ্যে রয়েছে- ইন্টারনেট ট্রানজিট (আইপি ক্লাউড), বিদেশি ডাটা সেন্টারের ভাড়া, দেশি-বিদেশি ব্যাকহল চার্জ, ল্যান্ডিং স্টেশন ভাড়া, কেন্দ্রীয় সার্ভারের পরিবহন খরচ, গেটওয়ে ভাড়া, আইএসপি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা, এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক ভাড়া, ইন্টারনেট যন্ত্রাংশের ওপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ধার্য করা ভ্যাট ও শুল্ক, বিটিআরসির রাজস্ব ভাগাভাগি ইত্যাদি।
এবার আপনারা নিশ্চয়ই বুঝে থাকবেন যেমনি ভাবে গ্রামে একজন কৃষক যখন তার ফসল ফলায় তার যে দাম হয় শহরের বাজারে তার সাথে আকাশ আর পাতাল পার্থক্য হয়। অনেকে প্রশ্ন করেন গ্রামে দেখে আসলাম কাঁচামরিচ ২০ টাকা কেজি আর ঢাকায় সেটা ১৮০ টাকা কেজি হয় কীভাবে? কারণ মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগীরা খেয়ে ফেলেছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। কাঁচাবাজারের যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে কি ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে হতে পারে না? অবশ্যই পারে এখানেও ১৬-১৭টি প্লেয়ার রয়েছে।
আমরা এবার দেখে নেই ইন্টারনেটে ভ্যাটের পরিমাণ কত? বর্তমানে ভ্যাটের হার ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে ৩৩.২৫ শতাংশ। আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথ ক্রয় করার ক্ষেত্রে আইএসপি অপারেটর ভ্যাট দেয় ১৫ শতাংশ আর গ্রাহক পর্যায়ে আদায় করা হয় ৫ শতাংশ। এসব ছাড়াও অপারেটরদের করপোরেট ট্যাক্স সিম ট্যাক্স সংযোগ ট্যাক্স সবাই কিন্তু গ্রাহকই প্রদান করে কারণ এখানে বুঝতে হবে বিনিয়োগকারীরা নিশ্চয়ই আঞ্জুমান মফিদুল এর মতো প্রতিষ্ঠান নয়। তারা ব্যবসা করতে এসে মুনাফা করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা সবসময় অপারেটরদের বলি আপনারা ন্যায়সঙ্গত মুনাফা করেন গ্রাহকের ন্যায্য অধিকার গ্রাহককে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু এই মূল্য ন্যায্যতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিশ্চয়ই নিয়ন্ত্রক কমিশন বিটিআরসির।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে গ্রাহকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এই সংগঠনটির কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রাহকের অনেক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইতিমধ্যে। আমরা এবার আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের ইন্টারনেটের দাম কত দেখে আসি। ভারতে ১ জিবি ইন্টারনেটের দাম ০.০৯ ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক জিবি ইন্টারনেট এর দাম ৩.৩৩ ডলার। চায়না এক জিবি ইন্টারনেটের দাম ০.৫২ ডলার, পাকিস্তানে এক জিবি ইন্টারনেটের দাম ০.৫৯, রাশিয়া ০.২৯ ও অস্ট্রেলিয়া ০.০৭ ডলার।
তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে যে আমাদের দাম অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, যতক্ষণ না মধ্যস্বত্বভোগী এই সিন্ডিকেট চক্র ভেঙে দেওয়া নেওয়া যাবে এবং ভ্যাট ট্যাক্সের পরিমাণ কমিয়ে আনা যাবে, ততদিন পর্যন্ত ইন্টারনেটের দাম কমানো খুবই কঠিন একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া নিয়ন্ত্রক কমিশনে যথাযথ বিশেষজ্ঞ না থাকায় এবং দুর্বল মনিটরিং থাকবে ততদিন পর্যন্ত ইন্টারনেটের দাম জনগণের সাহায্যের মধ্যে আনা সম্ভব হবে না। ব্যান্ডউইথের দাম কমিয়ে কেবল রাষ্ট্রীয় ক্ষতি করা হয়েছে আর সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে কিছু মধ্যস্বত্বভোগীদের।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস