কার পেছনে কে?
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো নড়েচড়ে বসেছে বেশ আগে থেকেই। সব পক্ষই দলীয় এবং জোটগত কর্মকাণ্ডকে জোরদার করার চেষ্টা করছে।
এদিকে বৈশ্বিক প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে রীতিমতো লড়াইয়ে নেমেছে সরকার। অতিমারি করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কিছুটা বিজয়ী হলেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধর জের পোহাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।যে দুর্ভোগ গরিব-ধনি সবদেশকেই কমবেশি পোহাতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জনজীবন স্বাভাবিক আছে, বলার সুযোগ নেই।
বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য মানুষকে পেরেশানে ফেলেছে। সরকার চেষ্টা করছে পরিস্থিতি সামাল দিতে, বিরোধী দল ব্যস্ত প্রতিবাদে-জনজীবনকে স্বাভাবিক করার দাবিতে। জনগণ চিড়েচ্যাপ্টা বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়তি থাকায়। সবদিক থেকে বলা যায়- বাংলাদেশ এই মুহূর্তের আর দশটা দেশের মতোই অস্থিরতায় কাটাচ্ছে।
এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকালে প্রতিটি পদক্ষেপই সতর্কতার সাথে নিতে হয় এবং বিশ্বাস করার কারণ আছে,বাংলাদেশ সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। তারপরও কিছু বিষয় অনেকেরই কৌতূহল বাড়িয়ে দিয়েছে-পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ করে দিয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করার মতো অনেক উপাদানের ভরপুর।
প্রতিটি পদক্ষেপ এবং বক্তব্য বর্তমান সময় ও পরিস্থিতির নিরিখে মনে হতে পারে- আসলে এত সাহস পান কোথায়? আসলে পেছনে শক্তি জোগায় কে? জাপান সফর মাধ্যমে তার বিদেশযাত্রার প্রতিটি ক্ষণ ছিলো ব্যতিক্রমী। জাপান থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পর বিশ্বব্যাংকের অনুষ্ঠানে যোগদান এবং সেখানে উপহার প্রদান থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজই ছিল নতুনত্বে ভরপুর।
বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে তিনি যখন বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানের কথা প্রকাশ করেন, তখন প্রশ্ন আসে বিশ্বব্যাংক কি তার দৃঢ়কঠিন বক্তব্যকে সহজে মেনে নেবে? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- বিশ্বব্যাংক শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাংলাদেশকে একসময় তারা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করলেও সেই বাংলাদেশকে, বলা যায় স্বপ্রণোদিত হয়ে ঋণদানে এগিয়ে আসে। তারা জোরালো কণ্ঠে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে প্রশংসা করে।
আমেরিকায় বসে তিনি আমেরিকার স্যাংশন বিষয়ে সমালোচনা করলেন। তাঁর সমালোচনার পেছনে যুক্তিও আছে। মার্কিন সরকার বাংলাদেশের র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল মূলত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এনে। বলা হয়েছিল বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো অমানবিক কাজ পরিচালনার জন্য উল্লেখিত কর্মকর্তাগণ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার হারাচ্ছেন।
প্রশ্ন হলো, যে অভিযোগ অর্থাৎ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছিলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, সেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। যা বাংলাদেশে এই মুহূর্তে প্রায় শূন্যের কোঠায়।কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় নিত্য ঘটনা এটা। অন্যদিকে জঙ্গি হামলার বিষয়টিও যদি আলোচনায় আসে তাহলেও বলতে হবে, বাংলাদেশে কয়েকবছরের মধ্যে উল্লেখ করার মতো জঙ্গি হামলা ঘটেনি।
বরং যে র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর কিছু কর্মকর্তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো সেই দুই বাহিনীই বাংলাদেশে প্রশংসনীয়ভাবে জঙ্গি তৎপরতা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় প্রতিদিনেই স্কুলে কিংবা জনসমাগমে প্রকাশ্যে হামলা ও নিরীহ মানুষকে হত্যা করার ঘটনা ঘটেেই চলেছে। বাংলাদেশে তেমনটা নেই। এই প্রশ্নটি কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও বহুবার উত্থাপন করা হয়েছে।
যে দুটি কারণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, সেই দুটি কারণই এখন বাংলাদেশে প্রায় অনুপস্থিত। এমন পরিস্থিতিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হওয়ার কারণ কি? তাহলে তাদের অভিযোগ আসলে বিষয় না, এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়ে গেছে। এমন কোনো শক্তি কি তার পেছনে কাজ করছে, যাতে কার্যকারণ ছাড়াই তারা নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখছে?
কিন্তু ১৫ তারিখেও যখন সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্টভাবে বলে দেন, যারা বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে নিষেধাজ্ঞাভুক্ত করবে,বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় বন্ধ করে দেবে। ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তাঁর এই বক্তব্য। বাংলাদেশের মতো নিন্ম আয়ের একটি দেশ কোন শক্তিবলে এত বড় সাহসী উচ্চারণ করতে পারে?
বাংলাদেশের কোনো সরকার প্রধান এর আগে এমন উচ্চারণ করেছে বলে মনে পড়ছে না। স্যাংশন বিষয়ে প্রথম দিক থেকেই কড়া সমালোচনা করেছেন তিনি। সমালোচনার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন প্রত্যাহার না করলেও এটা সত্যি তাদের আচরণে পরিবর্তন এসেছে অনেক। মনে হতে পারে তারা হয়তো বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে। এবং বিষয়টি ওভাবেই চাপা পড়ে থাক-এমন ভাবনাও ভাবতে পারে তারা। যে কারণে বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের তুলনায় ইতিবাচক হিসেবেই চিহ্নিত হতে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী কূটনীতিক পদ্ধতি ও নিয়মকানুন মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন সব কূটনীতিকদের। তিনি স্পষ্টত বলেছেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারো মাথাব্যথার দরকার নেই।বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানোর পর যুক্তরাষ্ট্র নমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেছে।
এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ প্রকাশ্যে বলেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপ করার কোনো ইচ্ছা নেই। মার্কিন স্ট্যাট ডিপার্টমেন্ট থেকেও মন্তব্য এসেছে বাংলাদেশের নির্বাচন কেমন হবে কিভাবে হবে সেটা বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে, আমেরিকার এখানে কোনো ভূমিকা থাকবে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেয়, জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধিকালে যে কয়টি দূতাবাসে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো ওই দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাড়তি ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নেবে। বিষয়টির ব্যাখ্যা এসেছে এভাবে,যেহেতু বাংলাদেশ জঙ্গি দমনে দৃশ্যগ্রাহ্যভাবে সফল হয়েছে, তাই বাংলাদেশ মনে করে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই।এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য-বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে,জঙ্গি তৎপরতা উল্লেখযোগ্যভাবে দমনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এখনও স্যাংশন প্রত্যাহার করেনি।
এদিকে স্যাংশনদাতাদের পণ্যক্রয় না করার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে বিএনপি কঠোর সমালোচনা করেছে। অপরিণামদর্শী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তাদের নেতারা। কিন্তু যে মুহূর্তে কয়েকজন রাষ্ট্রদূতের বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহারের প্রসঙ্গ আসে তখন সঙ্গত কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ বুঝিয়ে দিতে চায় বাংলাদেশ আগের মতো জঙ্গি হুমকিতে নেই। যে কারণে বাড়তি নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র স্ট্যাট ডিপার্টমেন্ট থেকে বলা হয়েছে জেনেভা কনভেনশনের কথা। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী প্রতিটি দেশে নিয়োজিত কূটনীতিকদের নিরাপত্তা বিধান প্রতিটি দেশের। অর্থাৎ বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দেওয়া বাংলাদেশের দায়িত্ব। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ যখন যেটুকু নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার মনে করে তখন সেটাই করবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্যমূলক সিদ্ধান্তে ভীত হননি এটা পদ্মাসেতু নির্মাণকালে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে।এর আগে মার্কিনীদের অনুরোধে গ্যাস রফতানি না করে তাদের বিরাগভাজন হয়েছে, কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন, গভীর সমুদ্রবন্দর বিষয়ে শেখ হাসিনা দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে নিজের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন, এখন যেভাবে প্রকাশ্যে বৃহৎশক্তির চোখরাঙানোকে উপেক্ষা করছেন, এই শক্তি কোথা থেকে পান তিনি? জবাবটা সবার জানা, তাঁর প্রধান শক্তি দেশের মানুষ।
কিন্তু যেসব কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিয়েছে, সেই কারণ তাদের দেশে বিদ্যমান থাকা এবং বাংলাদেশ সেই জঙ্গি তৎপরতামুক্ত এবং বিনাবিচারে হত্যা না হওয়ার পরও তারা স্যাংশন প্রত্যাহার করছে না কেন? এর পেছনের শক্তিটা কি?
পৃথিবীর যেসব দেশে মার্কিনী হস্তক্ষেপ হয়েছে, প্রতিটি দেশের একটি গোষ্ঠি এর পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। যেদেশে তাদের সহায়ক গোষ্ঠি যতটা শক্তিশালী সেদেশে তাদের হস্তক্ষেপও ততটা শক্তিশালী হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশেও কি তেমন কোনো শক্তি তাদের উদ্বুদ্ধ করছে? এই শক্তিকে যদি বাংলাদেশ চিহ্নিত না করতে পারে, ভবিষ্যতে কী হবে এই মুহূর্তে বলা কঠিন।
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক।
এইচআর/জিকেএস