আয়েশার চলে যাওয়া: অবক্ষয়ের প্রতিচিত্র
প্রতিটি সকালই নতুন করে স্বপ্ন দেখায়। হোক সে নারী কিংবা পুরুষ- স্বপ্ন দেখে না এরকমটি হয় না সাধারণত। প্রখর রৌদ্র কিংবা রৌদ্রোজ্জ্বল শিরশির বাতাসে কিশোরীর এলোমেলো চুল সাথে মন জুড়িয়ে যাওয়া দিগন্ত উদ্ভাসিত হাসি- এসব কিছুই স্বপ্ন দেখায় নতুন করে বেঁচে থাকার, শক্তি জোগায় অফুরন্ত নিঃশ্বাসের।
লেখাটি যখন লিখতে বসেছি তখনই একটা ঘটনার খবর শুনতে পাই, মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। একজন নারী হিসেবে এরকম ঘটনার খবরটি আমাকে মানসিকভাবে আহত করে। একটা সম্ভাবনায় স্বপ্নের অকাল মৃত্যু। কলেজপড়ুয়া একজন মেয়ের আত্মহত্যার খবরটি আমাকে বেদনাহত করে।
টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলার কচুয়া গ্রামের কলেজপড়ুয়া মেয়ে আয়েশা আত্মহত্যা করেছে খবরটি জেনেছি গণমাধ্যমে। নিজের কাছে প্রশ্ন করেছি একবিংশ শতাব্দীর এইকালে যেখানে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আধুনিকতার হাওয়া লেগেছে গ্রাম কিংবা শহরের অলি গলিতে। কোনটা গ্রাম আর কোনটা শহর মাঝে মাঝে আলাদা করে ভাবারই কোনো উপায় থাকে না- সেখানে আয়েশা নামের মেয়েটির কেন এই আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া?
খোঁজ নিয়ে জেনেছি ঘটনার নেপথ্যে পারিবারিক চাপ, প্রেম এবং অসময়ে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কিশোরী আয়েশা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ঘটনাগুলো কিংবা এই প্রচেষ্টাগুলো নিঃসন্দেহে দুঃখের। ওই যে লেখার শুরুতে বলেছি স্বপ্ন এবং একটি নতুন সকাল নারী কিংবা পুরুষকে কল্পনার অতল গভীরে নিয়ে যায় শুধু বাঁচার তাগিদে। কিন্তু আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা, পারিবারিক কাঠামো এবং গ্রামীণ প্রেমের নিয়ন্ত্রণহীন পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে না পারার ব্যর্থতা কেবলই আত্মহত্যার মতো ঘটনাকে উৎসাহিত করে। আমরা নারীরা তাই ব্যথিত, শোকাহত।
আয়েশা আজ বেঁচে নেই কিংবা যদি বলি আমরা তাকে বেঁচে থাকার মতো কোনো স্বপ্ন দেখাতে পারিনি, তাহলে আমরা কি করতে পারতাম বা পারি? এটাই যৌক্তিক হতো যদি আয়েশার মনোজগৎটা বুঝতে পারতাম, তার কিশোরী মনটাকে যদি আলোকিত করতে পারতাম, হৃদয়ের গহীনে ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠা স্বপ্নটা যদি বাঁচানোর পথ দেখাতে পারতাম তাহলে হয়তো আয়েশাকে জীবন দিতে হতো না। আয়েশার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এবার নজর দেই এসব আত্মহত্যার নেপথ্যে কিছু বিষয়ের দিকে।
সময়টা আধুনিকতার, খোলাসা করে যদি বলি প্রযুক্তির। গ্রামের শিশু কিংবা যুবক, তরুণ কিংবা তরুণী, কিশোর বা কিশোরী, বৃদ্ধ বা বয়স্ক পুরুষ বা নারী, গৃহিণী বা কর্মজীবী, শ্রমিক বা পেশাজীবী সবার হাতে হাতে ইন্টারনেট সংযুক্ত স্মার্ট ফোন। ইউটিউব আর টিকটক, অনলাইন গেম, লাইভ ফ্যাশন জগৎ, বিদেশি সিরিয়াল, পরকীয়া, প্রেম ভালোবাসা আর উন্মাতাল হিন্দি ও বাংলা মিউজিক ভিডিওতে মগ্ন সমাজ।
নেই কোনো সীমানা। নেই কোনো পারিবারিক অনুশাসন, সামাজিক শৃঙ্খলা, ভদ্রতা, ধর্মীয় রীতিনীতির বিধি নিষেধ, সুশিক্ষার সুবাতাস, পড়ালেখার প্রতি উদাসীনতা, স্কুল পালানো বা ঝরে পড়া, বিদেশে গিয়ে বেশি বেশি অর্থ আয়ের লোভাতুর মানসিকতার ফসল আজকের অবক্ষয়ের সমাজ কাঠামো ও পারিবারিক বন্ধন।
এত সব ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া ও প্রক্রিয়া আমাদের সমাজে নিত্য চলমান। বিকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি রাস্তায় চোখ পড়লেই দেখি বিকট শব্দের মোটরবাইক, পেছনে যাত্রী হিসেবে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী বয়স যাদের ৯-১২। এই বয়সে কি রাস্তায় হাটবাজারে কিংবা স্কুলে মোটরবাইকে চড়ে চলাচল করার কথা? কিন্তু বলার যেন কেউ নেই, দেখার যেন কেউ নেই।
চোখ আছে যেন মুখ বন্ধ, আইন আছে প্রয়োগ নেই, শিক্ষা আছে সুশিক্ষা নেই, বই আছে পাঠক নেই, প্রতিষ্ঠান আছে শিক্ষক নেই, শিক্ষক আছে গবেষণা নেই। তাহলে আছে কি? আছে প্রযুক্তি আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া অন্ধ সমাজ ব্যবস্থা, পড়ালেখাবিহীন স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখানে আজ নীতি আর নৈতিকতা বিবর্জিত ক্ষমতার দাপট সেখানে তো আয়েশার মতো সম্ভাবনায় তরুণীদের অকালেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবেই।
আমরা জেনেছি যে আয়েশার এ আত্মহত্যার নেপথ্যে রয়েছে কিশোর প্রেমের ঘটনা। আয়েশা নামের মেয়েটি অন্য একজনকে পছন্দ করতো। পছন্দের ছেলেটির সঙ্গে আয়েশাকে বিয়ে না দিয়ে পরিবার থেকে অন্য একজন ছেলের সাথে তার বিয়ের কথা বললে কিশোরী মেয়েটি তা মেনে নিতে পারেনি। বলতে পারি অবুঝ প্রেম।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার যে আয়েশা এবং তার প্রেমিক দুজনেই কলেজে পড়তো, সহপাঠী তারা। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়মে তাদের কারোরই বয়স হয়নি প্রেম কিংবা বিয়ের। অথচ তারা পারস্পরিক পরিচয়ে নানাভাবে ঘনিষ্ঠ হয় এবং গভীর প্রেমে জড়িয়ে যায়। কিন্তু আত্মহত্যার মতো ঘৃণ্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলাটা আমাদের কী শিক্ষা দেয়?
আমরা বুঝতে পারি এসবই আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। আমরা আমাদের কিশোর-কিশোরীদের হাতে বয়স না হতেই মোবাইল সেট সিমকার্ড তুলে দিচ্ছি, ঈদে কিংবা উৎসবে উপহার হিসেবে মোবাইল গিফট করছি। ফলে তারা খুব সহজেই মোবাইলে ইন্টারনেটের সংযোগ নিয়ে দিনের পর দিন রাতের পর রাত জেগে কথা বলছে, নানা ধরনের ভিডিও দেখছে, বর্তমানকালের নতুন জনপ্রিয় অ্যাপস টিকটকে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
বিদেশি সিরিয়ালে সস্তা পরকীয়া ও প্রেমের ঘটনার কাহিনি দেখছে। পারিবারিক বিধিনিষেধ মানার মতো মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠছে না। ফলে শিক্ষা বা পড়ালেখার প্রতি কোনো আগ্রহ জন্মাচ্ছে না, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠছে না, নিয়মিত পাঠাগারে গিয়ে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা করতে শিখছে না। ভেঙে পড়ছে পারিবারিক, সামাজিক শৃঙ্খলা। এসব প্রতিরোধের বিপরীতে আমরা যেন প্রকারান্তরে কিশোর-কিশোরীদের নানাভাবে উৎসাহ দিচ্ছি।
স্কুল বা কলেজে নিয়মিত কাউন্সিলিং করা হয় না। শিক্ষকদের কাছ থেকে জীবনকে নতুন ভাবে দেখার এবং জানার উপদেশ ও দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না। জীবন মানেই প্রেম নয় শুধু, জীবনের মূল্য অসীম। বেঁচে থাকার আনন্দ অফুরন্ত। জীবন মানেই নিজের কল্পনার জগৎটাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার প্লাটফর্ম। আমরা যদি সামজ থেকে এ ধরনের আত্মহত্যা রুখতে চাই তাহলে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের দায়িত্ববান প্রত্যেকেই হতে হবে আরও সচেতন। শিক্ষকদের হতে হবে আদর্শ গাইড। আদর্শ শিক্ষকই পারে সমাজ বদলের কাঠামো এবং প্রকৃত শিক্ষার পথ তৈরি করে দিতে।
একটা সময় আমাদের দেশের নারীরা সবক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। ছিল সুবিধাবঞ্চিত। আর অবহেলিত এসব নারীর স্বপ্ন দেখিয়েছেন অনেক মহীয়সী নারী। তার মধ্যে বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, নূরজাহান বেগম, ইলা মিত্র, নীলিমা ইব্রাহীম, আইরিন খান, তারামন বিবি, নভেরা আহমদ বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রমুখ আমাদের কাছে শ্রেষ্ঠ নারীর প্রতিরূপ হয়ে আছেন। তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রযাত্রার প্রতীক হয়ে আছেন। বর্তমান প্রজন্মের নারীদের জন্য হয়ে আছেন তারা আদর্শ।
সুতরাং আমরা আয়েশার মতো আর কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিক- তা দেখতে চাই না, গণমাধ্যমে শুনতে চাই না তথাকথিত প্রেমের কারণে আত্মহত্যার খবর। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখে দিতে সমাজ থেকেই সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে সম্মিলিতভাবে। তবেই আমরা বলতে পারবো- ‘Each time a woman stands up for herslef, she stands up for all woman’।
লেখক: শিক্ষক।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস