বর্ষবরণ উৎসবে মেতে উঠুক দেশ
পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের এমনই উৎসব- যা ধর্ম, সমাজ, বয়স ও বৃত্তির সীমা পেরিয়ে সর্বত্র একাকার। নববর্ষের আনন্দ চিত্তে নতুনের জাগরণ ঘটায়। উৎসবের মধ্যে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায় বৃহত্তরের গণ্ডিতে। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী- কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ; সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন যে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’
পহেলা বৈশাখ নতুন আঙ্গিকে জীবন গড়ার শপথের দিন। এদিন রাষ্ট্রীয় কর পরিশোধের অঙ্গীকার গ্রহণের দিন ছিল একদা। দেনা-পাওনা হালনাগাদ করার দিন। ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলার দিন। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির প্রেরণার দিন। একদা ফসলি কর পরিশোধের সঙ্গে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাবোধ জাগানোর দিন ছিল। বাঙালি জীবনে দীর্ঘকাল ধরে পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গ হচ্ছে ‘হালখাতা’। উদ্দেশ্য হচ্ছে ফসলি কর পরিশোধের আনন্দ প্রকাশ করা এবং ব্যবসায়ের হিসাব ও খাজনা ‘রাজকীয়’ খাতায় হালনাগাদ রাখা। এ উপলক্ষে রাজা-জমিদারকে প্রজারা তাদের সৃজনশীল পণ্য ও সূচিকর্ম উপহার দিত।
রাজা-জমিদাররাও প্রজাদের কর রেয়াত ও ইনাম দিতেন। মানুষের নৈপুণ্য প্রদর্শন ও সাংবাৎসরিক প্রয়োজনীয় অথবা শৌখিন পণ্যের বেচাকেনার জন্য বৈশাখীমেলা লোকবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য। মানুষ এই উৎসবের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে মুঘল আমল থেকেই। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে।’
সেই দিন হতে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাতি নতুন বর্ষ পালন করে আসছে নিজ নিজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমুন্নত রেখে। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে একটি নতুন সৌর সনের উদ্ভাবন করা হয়। ফসলি সন হিসেবে এই বাংলা সন বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে প্রাণের স্পন্দন আজও।
আর ‘জগতের যেখানে অব্যাহত শক্তির প্রচুর প্রকাশ, সেখানেই যেন মূর্তিমান উৎসব’ (রবীন্দ্রনাথ)। এই উৎসব নিয়ে আসে সবার প্রাণে-মনে চির নতুনের আবাহন। মধ্যযুগের বাংলায় দরিদ্র মানুষের জীবনে বৈশাখ আনন্দবার্তা নিয়ে আসত এমন নয়, প্রচন্ড গরম আর অভাবের মাঝে বেঁচে থাকা গ্রামবাংলার মানুষ তবু খুঁজত প্রাণে প্রাণে যোগ।
কবি মুকুন্দ রামের ‘কালকেতু ফুল্লরা উপাখ্যানে’ ফুল্লরার বর্ণনায় বৈশাখের দেখা মেলে এভাবে- ‘পাশেতে বসিয়া রামা কহে দুঃখবাণী/ভাঙা কুড়্যা ঘরখানি পরে ছাওনী/ভেরান্ডার খাম তার আছে মধ্যঘরে/প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙে ঝড়ে॥ / পুণ্য কর্ম্ম বৈশাখেতে খরতর খর/তরুতল নাহি মোর করিতে পসর॥/ পদ পোড়ে খরতর রবির কিরণ/শিরে দিতে নাহি আঁটে অঙ্গের বসন॥/ বৈশাখ হৈল আগো মোরে বড় বিষ/মাংস নাহি খায় সর্ব্বলোক নিরামিষ॥’
রাজকর পরিশোধের আওতায় এই নিরন্ন, অভাবী বাঙালি না থাকলেও বৈশাখীমেলায় তার উপস্থিতি দেখা যেত। বৈশাখের নবপ্রভাতেই বাঙালি আজও তাই কায়মনে প্রার্থনা করে, যা কিছু গ্লানিময়, ক্লেদাক্ত, জীর্ণ বিশীর্ণ, দীর্ণ, পুরনো তা বৈশাখের রুদ্রদহনে পুড়ে যেন হয় ছাই, গ্রীষ্মের তাপস নিঃশ্বাস বায়ে পুরনো বছরের সব নিস্ফল সঞ্চয় যেন দূর-দিগন্তে মিলায়। খরতাপে প্রকৃতি অগ্নিস্নানে হয় মত্ত। বাঙালি তাই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে বৈশাখকে আবাহন করে গেয়ে ওঠে, ‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা।’
সকল অপ্রাপ্তির বেদনাকে ধুয়ে মুছে; আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে নতুনভাবে রাঙিয়ে তোলে। বৈশাখের প্রথম দিনে যে উৎসবের ঘনঘটা, তা আসলে কৃষিজীবী বাঙালির যুগ-যুগান্ত ধরে বয়ে আসা জীবনচর্যার অন্যরকম অনুষঙ্গ হিসেবে স্পন্দিত হয়। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন, ‘আজ আলোক জ্বলিয়াছে, সঙ্গীত ধ্বনিতেছে, দ্বার খুলিয়াছে- আজ মনুষ্যত্বের গৌরব আমাদিগকে স্পর্শ করিয়াছে- আজ আমরা কেহ একাকী নহি- আজ আমরা সকলে মিলিয়া এক আজ অতীত সহস্র বৎসরের অমৃতবাণী আমাদের কর্ণে ধ্বনিত হইতেছে আজ অনাগত সহস্র বৎসর আমাদের কণ্ঠস্বরকে বহন করিবার জন্য সম্মুখে প্রতীক্ষা করিয়া আছে।’
পহেলা বৈশাখ সর্বস্তরের বাঙালি জনসাধারণের জন্যই শুভ নববর্ষের প্রথম দিবস। জমিতে বীজ বপণের দিবস হিসেবে বাঙালির জাতীয় উৎসবের দিন। মেলা, খেলাধুলা, নৌকা বাইচ, গান-বাজনা এবং ভাল খাওয়া-দাওয়ার দিন। সর্বজন পালিত জাতীয় দিবসটি ইরানী নববর্ষ নওরোজের সূচনা দিবসের সঙ্গে তুল্য। বৈশাখ মাসেই গ্রামবাংলায় মেলার আয়োজন চলে বহুকাল হতে।
‘আমাদের দেশ প্রধানত পল্লীবাসী। এই পল্লী মাঝে মাঝে যখন আপনার নাড়ির মধ্যে বাহিরের বৃহৎ জগতের রক্ত চলাচল অনুভব করিবার জন্য উৎসুক হইয়া ওঠে; তখন মেলাই তাহার প্রধান উপায়। এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান। এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সঙ্কীর্ণতা বিস্মৃত হয়, তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ’ (রবীন্দ্রনাথ)।
পাকিস্তান যুগে পহেলা বৈশাখকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ‘হিন্দুর বর্ষারম্ভ দিবস’ রূপে আখ্যায়িত করে তার আনন্দ-উৎসব হতে দূরে রাখার অভিযান চালিয়েছিল। বাঙালি যাতে বাঙালি না থাকে সেজন্য তার সংস্কৃতির মেলবন্ধনকে নিশ্চিহ্ন করার নানা প্রয়াস চলতে থাকে। পাকিস্তানকালে বাঙালি আর বাঙালি থাকল না বটে, কিন্তু বাংলাদেশ মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান বৌদ্ধ এবং নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি রয়েই গেল। রয়ে গেল বৈশাখ মাসও। এমনকি হালখাতাও।
‘বাঙালি বলিয়া কোথাও কিছু নাই’ বলে পাকিস্তানী জান্তারা যতবার গলা হাঁকিয়েছে, বাঙালি ততো বেশি নিজের বাঙালিত্ব রক্ষার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। যদিও নগরজীবনে বৈশাখ সেভাবে পালন করা হতো না। কিন্তু বাঙালির রাজনৈতিক আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগাতে বৈশাখ রণরঙ্গিনী মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিল। চেতনায় বাঙালিয়ানা ক্রমশ স্বরূপ ধারণ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বাঙালির উৎসব, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করে তার স্বাধীন বিকাশের সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিলেন। বুঝেছিলেন তিনি, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন।
তাই চেয়েছিলেন মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুপ্ত শক্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙক্ষা অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি। বলেছিলেনও তিনি ১৯৭০ সালের শেষদিনে- ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা না পেলে সংস্কৃতিকে গড়ে তোলা যায় না। বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না বলেই বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ হয়নি। দেশভাগের পর বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য প্রায় কিছুই করা হয়নি। শিল্পী, সাহিত্যিক এবং সংস্কৃতিসেবীদের তাদের সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে মানুষের আশা- আকাঙক্ষাকে প্রতিফলিত করতে দেয়া হয়নি। যে সংস্কৃতির সঙ্গে দেশের মাটি ও মনের সম্পর্ক নেই তা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।’ বঙ্গবন্ধু বাংলা ও বাঙালি অন্তঃপ্রাণ ছিলেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধুসহ প্রগতিশীল নেতারা বাংলা নববর্ষে সরকারি ছুটি দাবি করেন। তাদের দাবির মুখে সরকার ছুটি ঘোষণা করে। পাকিস্তানী জান্তা সরকারও তা বাতিল করার দুঃসাহস দেখায়নি। বঙ্গবন্ধু অবশ্য পরবর্তীকালে বলেছিলেন, ‘আঞ্চলিক পরিবেশ ও জনগণের ধ্যানধারণার ভিত্তিতে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে। ধর্মের নামে ভাড়াটিয়া সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া মানুষের আত্মার স্পন্দনকে পিষে মারারই শামিল।’
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে তার সংস্কৃতিরপ্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করতে বাধ্য করে। পাকিস্তানীদের নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও সংস্কৃতি কর্মীরা ঐতিহ্যকে সমুন্নত করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। ছায়ানটের হাত ধরে নগরজীবনে পহেলা বৈশাখ আসে আনন্দলোকে- মঙ্গলালোকের গান গেয়ে। ছায়ানট রমনার অশ্বত্থতলে ভোরের বেলা আয়োজন করে অনুষ্ঠানমালার। ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/তাপস নিঃশ্বাস বায়ে/মুমূর্ষেরে দাও উড়ায়ে।’
সমবেতভাবে শিল্পীদের উদাত্ত কণ্ঠে ধ্বনিত এ গান মানুষের মনে আশা জাগাত, প্রেরণা সৃষ্টি করত। সে সুরের অনুরণন ছাপিয়ে যায় গোটা ঢাকা শহর হয়ে সারাদেশে। নববর্ষের আগমনকে চিত্তে একটি নতুন উপলব্ধির শিহরণরূপে অনুভব করতে থাকে সংগ্রামী বাংলার বাঙালি পাকিস্তান যুগের শেষদিকে, একাত্তরের আগে। বাঙালি বুঝতে পারে পাকিস্তান যুগে রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ থেকে, যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারও করা হয়েছিল নিষিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষেরও আগে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আজ আমাদের কিসের উৎসব? শক্তির উৎসব। মানুষের মধ্যে কী আশ্চর্য শক্তি আশ্চর্যরূপে প্রকাশ পাইতেছে। আপনার সমস্ত ক্ষুদ্র আয়োজনকে অতিক্রম করিয়া মানুষ কোন উর্ধে গিয়ে দাঁড়াইয়াছে।
...জ্ঞানে প্রেমে কর্মে মানুষ যে অপরিমেয় শক্তিকে প্রকাশ করিয়াছে, আজ আমরা সেই শক্তির গৌরব স্মরণ করিয়া উৎসব করিব। আজ আমরা আপনাকে; ব্যক্তিবিশেষ নহে, কিন্তু মানুষ বলিয়া জানিয়া ধন্য হইব। ...আজ উৎসবের দিন শুধুমাত্র ভাবরস সম্ভোগের দিন নহে; শুদ্ধমাত্র মাধুর্যের মধ্যে নিমগ্ন হইবার দিন নহে- আজ বৃহৎ সম্মিলনের মধ্যে শান্তি উপলব্ধির দিন, শক্তি সংগ্রহের দিন।’ বৈশাখে বাঙালি সেই শক্তির ভেতর দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করে আসছে।
১৯৭১ সালে তথা ১৩৭৮ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে এসেছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তখন বাঙালি নিধনে মত্ত। শহর-গঞ্জ-গ্রামে হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার ঘৃণ্যতায় লিপ্ত। যার বিরুদ্ধে বাঙালি সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছিল। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশে নববর্ষ পালন হয় মুক্ত পরিবেশেই।
বাঙালিকে বাঙালি হয়ে বেঁচে ওঠার পথটি দেখিয়েছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির উৎসব, সংস্কৃতি সবকিছুকে রক্ষা করে তাকে বিকশিত করার জন্য যে সংগ্রাম, তা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন জীবনের সকল শ্রম, কর্মনিষ্ঠতা ও কুশলতা মিলিয়ে। বাঙালি অন্তঃপ্রাণ শেখ মুজিব সেই পঞ্চাশ, ষাটের দশকেও দলীয় কার্যালয়ে আয়োজন করতেন বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠানমালার। মুড়ি-মুড়কি খাওয়া হতো। তার সুদূর প্রেরণা আর সংগ্রামী চেতনার বাতাস দোলায়িত হয়েছিল ছায়ানটেও।
এই ছায়ানটের হাত ধরেই নগরজীবনে বৈশাখ এসেছিল কেবল উৎসবের আমেজ নিয়ে নয়, দ্রোহের-প্রতিবাদের, স্বাধিকারের ও স্বাধীনতার আবাহন নিয়েও। বাঙালির যে স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রাম, তাতে প্রাণ প্রবাহ যুগিয়েছে, আন্দোলনকে তীব্রতর করেছে সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার দীপ্ততায়। পাকিস্তানী জান্তা শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেই ষাটের দশকের শেষ দিকে এসে রমনা বটমূলে ছায়ানট যে আয়োজন করেছিল বৈশাখী উৎসবের, গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ে তা ডালপালা ছড়িয়েছে এমনভাবে যে, সারাদেশেই বৈশাখী উৎসব আর মেলায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তা সব বাঙালির মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। এদিন তাই বাঙালি গেয়ে ওঠে, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা/ এসো, এসো, এসো, হে বৈশাখ।’
সকল না পাওয়ার বেদনাকে ধুয়ে-মুছে, আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে শুচি করে তুলতেই ফিরে ফিরে আসে পহেলা বৈশাখ। নতুন স্বপ্ন, উদ্যোগ ও প্রত্যাশার আলোয় রাঙানো নতুন বাংলা বছরেরও শুরু হয় যাত্রা। বৈশাখের নব প্রভাতেই বাঙালি তাই কায়মনে প্রার্থনা করে, যা কিছু ক্লেদাক্ত, গ্লানিময়, যা কিছু জীর্ণ বিশীর্ণ, দীর্ণ, যা কিছু পুরনো-তা বৈশাখের রুদ্র দহনে পুড়ে হয় যেন ছাই। গ্রীষ্মের এই তাপস নিঃশ্বাস বায়ে পুরনো বছরের সব নিষ্ফল সঞ্চয় নিয়ে যায়, দূরে যায়, দূর-দিগন্তে মিলায়। বর্ষ বরণের উৎসবের আমেজে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। গ্রীষ্মের অগ্নিজিহ্বা হয়তো বাতাসে লকলক করে উঠবে গেয়ে।
উগড়ে দেবে বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে অগ্নিবরণ নাগ-নাগিনীপুঞ্জ ও তাদের সঞ্চিত বিষ। তারপরও বাঙালি এই খরতাপ উপেক্ষা করে মিলিত হয় তার সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক উৎসবে। দেশের প্রতিটি পথে-ঘাটে, মাঠে- মেলায় অনুষ্ঠানজুড়ে থাকে কোটি মানুষের প্রাণের চাঞ্চল্য, আর উৎসব মুখরতার বিহ্বলতা। কারণ বৈশাখ মানেই বাঙালির আনন্দের দিন।
বাংলা নববর্ষে মহামিলনের এ আনন্দ উৎসবই বাঙালিকে ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করবার আর কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার অনুপ্রেরণা দেয়। সেই সঙ্গে করে ঐক্যবদ্ধ। নতুন বছর মানেই এক নতুন সম্ভাবনা, নতুন আশায় পথ চলা। বৈশাখ কেবল আনন্দের নয়, প্রতিবাদেরও মাস। বৈশাখ অপশক্তিকে রুখে দাঁড়াবার শক্তি যোগায়।
কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সামরিক জান্তা শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে খড়গ হাতে নেমে পড়ে। পাকিস্তানী বিজাতীয় সংস্কৃতির পুনপ্রবর্তনের অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু বাঙালি প্রতিরোধের শক্তিতে তখনও বলীয়ান। নব্বই দশকে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের সহযোগী সংগঠন জাসাস রমনা অশ্বত্থতলা দখলের জন্য নোংরা আচরণ করে। ছায়ানটের অনুষ্ঠানস্থল তারা দখলের চেষ্টা চালায়। কিন্তু বাঙালি জনগণের হৃদয়ে ঠাঁই না পাওয়ায় পিছু হটতে বাধ্য হয়।
নববর্ষের প্রথম দিন বদলে যায় ঢাকা, বদলে যায় দেশ। শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলায় বর্ণবহুল হয়ে ওঠে। কাকডাকা ভোর থেকেই বাঙালি সংস্কৃতি লালনকারী আনন্দপিয়াসীরা পথে নামে। কায়মনে বাঙালি হয়ে ওঠার বাসনা জেগে ওঠে সবার মনে। বর্ণাঢ্য উৎসবের রঙে রেঙে ওঠার দিনটি প্রাণে প্রাণে প্রবাহ যোগায়। কিন্তু এই উৎসবকে মলিন করে দিয়ে ধর্মান্ধ, বাঙালি বিরোধীরা নানা ঘটনাও ঘটিয়েছে। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণে বোমা হামলাও হয়েছে। টিএসসিতে কনসার্ট চলাকালে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে।
মেয়েদের প্রতি অশোভন আচরণও করা হয়েছে। আর এমন ঘটনায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই বাঙালির প্রাণে প্রাণে যোগ ঘটে যে উৎসবে, সেই উৎসবকে সঙ্কুচিত করে তোলার প্রয়াস যখন ঘটান হয়, তখন জাতিসত্তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ‘আমি ভয় করব না, ভয় করব না/ দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না’- বলে বিশুদ্ধ সুরে ওয়াহিদুল হক গান গাইতেন, তখন প্রবীণ-নবীন সকলের মধ্যে এক দুর্দান্ত সাহস এসে ভর করত, উৎসবের রঙিন আলোয়।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নতুন বছরকে আপন সংস্কৃতির অনুশীলনে বরণ করে নেয়ার উৎসবকে স্তব্ধ করে দিতে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলাও চালানো হয়। টিএসসিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মেয়েদের প্রতি অশালীন আচরণের ঘটনা উৎসবকে ম্লান করে দেয়ার অপচেষ্টা হলেও তা সম্ভব হয়নি। মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদীরা বাঙালির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে নববর্ষ পালনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তাদের এই হীন কর্মকাণ্ডকে নিশ্চিহ্ন করার পথ খুঁজে না পেয়ে তাই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে সংক্ষিপ্ত করার ব্যবস্থাও নিতে হয়েছিল।
পাকিস্তানী জান্তা এবং বাংলাদেশী জান্তা শাসকরা শত চেষ্টা করেও বর্ষবরণ উদযাপনকে সঙ্কুচিত করতে পারেনি। রাজপথে নাগরিকদের ঢল মূলত জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে জাতীয় জাগরণই ঘটায়। নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি চালু করার যে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল, তা জাতিকে শতগুণে প্রতিরোধী করে তুলেছিল। জনমনে আতঙ্ক তৈরি করার, ভয়ভীতির সংস্কৃতিকে বিকশিত করার এ অপচেষ্টা স্বাধীন দেশে নতুন করে আঘাত হানার শামিল।
১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ তার ‘উৎসবের দিন’ প্রবন্ধে যা বলেছিলেন, আজকের বাংলাদেশে তার পুনরাবৃত্তি ঘটুক- এটা কারও কাম্য নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য দিয়ে স্পষ্ট করা যায় বিষয়টি। ‘হায়, এখন আমরা উৎসবকে প্রতিদিন সঙ্কীর্ণ করিয়া আনিতেছি। এতকালে যাহা বিনয় রসাপ্লুত মাদলের ব্যাপার ছিল, এখন তাহা ঐশ্বর্যমদোদ্ধত আড়ম্বরে পরিণত হইয়াছে। এখন আমাদের হৃদয় সঙ্কুচিত, আমাদের দ্বার রুদ্ধ। এখন কেবল বন্ধুবান্ধব এবং ধনীমানী ছাড়া মঙ্গলকর্মের দিনে আমাদের ঘরে আর কাহারো স্থান হয় না। আজ আমরা মানব সাধারণকে দূর করিয়া নিজেকে বিচ্ছিন্ন-ক্ষুদ্র করিয়া, ঈশ্বরের বাধাহীন পবিত্র প্রকাশ হইতে বঞ্চিত করিয়া বড়ো হইলাম বলিয়া কল্পনা করি।
আমাদের দীপালোক উজ্জ্বলতর খাদ্য প্রচুরতর আয়োজন বিচিত্রতর হইয়াছে- কিন্তু মঙ্গলময় অন্তর্যামী দেখিতেছেন আমাদের শুষ্কতা, আমাদের দীনতা, আমাদের নির্লজ্জ কৃপণতা। উৎসব উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উৎসব ভাতা চালু করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বৈশাখী ভাতা পেয়ে উৎসবে অংশ নেবেন এমনটা হওয়াই বাঙালি সংস্কৃতির জন্য মাইলফলক। পহেলা বৈশাখে মানুষ ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমে আসে, উৎসবে হয় মাতোয়ারা। গেয়ে ওঠে, ‘এসো হে বৈশাখ।’
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।
এইচআর/জিকেএস