ঘটনাবহুল মার্চ ও আমাদের দায়িত্ববোধ

ড. মো.শফিকুল ইসলাম
ড. মো.শফিকুল ইসলাম ড. মো.শফিকুল ইসলাম , সাবেক সভাপতি-শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ০৯:৪৪ এএম, ৩১ মার্চ ২০২৩

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী পালন করেছি ২০২১ সালের ১৭ মার্চ। ১৯২০ সালে মার্চ মাসে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার বর্তমান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালি। করোনার কারণে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী সেভাবে উদযাপন করা যায়নি। এজন্য বাঙালি জাতির মনে একটু কষ্ট রয়েই গেলো।

ইচ্ছায় কারও ঘাটতি ছিল না। বাংলাদেশ মানে বঙ্গবন্ধু। মার্চজুড়েই রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজরিত অনেক ঘটনা। এই মাসে বাঙালি জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা এবং ত্যাগের কথা বারবার ফিরে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬০ সালের ১ মার্চে তৎকালীন পাকিস্তানের আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। বেতন ছিল ৩০০ টাকা।

দিনটি স্মরণ করার জন্য ১ মার্চকে জাতীয় বিমা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১ মার্চ স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে এক সভায় বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ পল্টনে জনসভা ও মিছিল শেষে ভাষণ দেন শেখ মুজিবুর রহমান, সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি নির্দেশ দেন।

৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির মূল সনদ ও বাংলার মানুষের অনন্য প্রামাণ্য দলিল। ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। ওইদিন বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের বীজ বপন হয়েছিল। ৭ মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ মিনিটের যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগাম ইঙ্গিত ছিল। ১৮ মিনিটের ভাষণে দেশ ও মানুষের জন্য সব ধরনের নির্দেশনা ছিল। যেমন স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার, শৃঙ্খলা, শান্তি ও অসাম্প্রদায়িকতা।

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জাতির জনকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী সব সরকারি অফিস বন্ধ থাকে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের জরুরি সভায় স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণার প্রস্তাব পাস হয় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে জাতীয় সরকার গঠনের জন্য অনুরোধ করা হয়।

১৯৬৪ সালের ১১ মার্চ জাতির জনকের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের সময় জাতির জনক গ্রেফতার হন। ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ জাতির পিতার অনুরোধে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ১৯৭১ সালে ১৩ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৫ নং মার্শাল ল’ আদেশ জারি করে।

প্রতিরক্ষা খাতে চাকরিরত সব কর্মচারীকে ১৫ মার্চ সকালে কাজে যোগদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় এবং কাজে যোগ না দিলে তাদের চাকরি চলে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এই নির্দেশকে বঙ্গবন্ধু উসকানিমূলক বলে অভিহিত করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ৩৫ দফাভিত্তিক দাবিনামা পেশ করেন। ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকা সফরে আসেন এবং তিনি জাতির জনকের সহিত রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন।

বঙ্গবন্ধুর কল্যাণে একটি স্বাধীন দেশ, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি জাতীয়তার পরিচয় এবং একটি ভূখণ্ড আমরা পাই। অন্যথায় আমাদের হয়তোবা আজীবন পরাধীন থাকতে হতো। ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঐতিহাসিক ৬ দফার সিদ্বান্ত গৃহীত হয়। ’৭১ সালের ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার মধ্যে সোয়া দুই ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা হয় এবং মনে হয়েছিল কিছুটা পজিটিভ সমাধান হতে যাচ্ছে।

এটা ছিল ওদের কৌশল। জাতির পিতা ভুল করেননি। বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণভাবে চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জাতির পিতা কতটুকু সতর্কতার মাধ্যমে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। ১৯৭১ সালের ২১ মার্চ বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার মধ্যে ৭০ মিনিটের অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং জাতির জনকের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ হঠাৎ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন এবং জুলফিকার আলীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যকার আলোচনা হয়।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু ছুটি ঘোষণা করেন এবং সব সরকারি-বেসরকারি অফিস বা ভবনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ জাতির জনকের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে তিনি কোনো প্রকার নতি স্বীকার না করে কঠোরভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দিয়ে যান। যে কালো রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট এর নামে ছাত্র-শিক্ষক, পুলিশসহ হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এটাই ছিল ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। দুঃখের বিষয় হলো স্বাধীনতার ৫১ বছরে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এখনও গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। কারণ, অতীতের অনেক সরকার এই দিন নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি এবং উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেনি।

তবে বর্তমান সরকার এই দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। তাই এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য সরকারকে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ওই পরিস্থিতিতে রাত ১২টা ২০ মিনিটে ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দেন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে রাত ১টা ২০ মিনিটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল তখনকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে হানা দেয় এবং স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যায়। এ খবরটি ২৫টি দেশের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ দুপুরে এবং সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন।

১৯৮০ সালে ২৬ মার্চকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হয়। মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু কারাভোগসহ নানা ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে সব সাম্প্রদায়িকতা রুখে একটি সুন্দর ও স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন। মার্চ মাস ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য এক ত্যাগের মাস, অন্যদিকে বাংলার মানুষের জন্য ছিল এক লক্ষ্য বাস্তবায়নের মাস। তাঁর সব প্রচেষ্টা ছিল দেশকে কীভাবে স্বাধীন করবেন। এই মহান নেতাকে আমাদের সব কাজেকর্মে স্মরণ করা এক ধরনের নৈতিক দায়িত্ব। তাঁর আদর্শ ধারণ করে আমরা যেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়তে পারি এই কামনা করি। এটাই হোক আজকের দিনে আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

১৯৮০ সালে ২৬ মার্চকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হয়। মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু কারাভোগসহ নানা ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে সব সাম্প্রদায়িকতা রুখে একটি সুন্দর ও স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন। মার্চ মাস ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য এক ত্যাগের মাস, অন্যদিকে বাংলার মানুষের জন্য ছিল এক লক্ষ্য বাস্তবায়নের মাস। তাঁর সব প্রচেষ্টা ছিল দেশকে কীভাবে স্বাধীন করবেন। এই মহান নেতাকে আমাদের সব কাজকর্মে স্মরণ করা এক ধরনের নৈতিক দায়িত্ব।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।