প্রেমিক বা স্বামী নয়, তুমি সহযোদ্ধা হও
ভারতীয় Share the load নামে একটি বিজ্ঞাপন খুব সাড়া ফেলেছে বিভিন্ন মহলে। এরিইয়েলইন্ডিয়া পরিবেশিত বিজ্ঞাপনে দেখানো হচ্ছে বিয়ের পর মেয়ের বাসায় বেড়াতে এসে বাবা খুব দুঃখিত। মেয়ে দুই হাতে সংসার চালাচ্ছে, কানে ফোন নিয়ে অফিসে কথা বলছে আর রান্নাবান্না করছে, বাচ্চার খেলনা গুছাচ্ছে! কিন্তু ওদিকে পতিপ্রবর বসে বসে খেলা দেখছে। বউ এগিয়ে দিচ্ছে কফি। নিজের আদুরে কন্যাকে এত এত কাজ করা দেখে বাবা খুব বিমর্ষ। তাই যাবার আগে মেয়েকে চিঠি লিখে যায়, “ পৃথিবীর সব বাবার পক্ষ থেকে সরি। আমারই দোষ ছোটবেলায় রান্নাবাটা খেলতে দিয়েছি তোমাকে। তখন তোমাকে বলি নি, এই কাজগুলো তোমার একার না। তোমার বরেরও। তা তুমিই কি করে শিখবে, তোমার মাকেও তো আমি সাহায্য করি নি। তাই আজ আমি বদলে যাব। তোমার মাকে সাহায্য করব”। বিজ্ঞাপনের শেষে দেখা যায় বাবা নিজেই কাপড় কাচছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে, “ কে বলেছে! কাপড় কাচা কেবল মেয়েদের কাজ?”
বাবার অনুতপ্ত কণ্ঠে ‘সরি’ শুনে অনেক পুরুষই হয়তো অনুতপ্ত হবেন! ভোরে উঠে একটু বউকে চা বানানোর পাঁয়তারা করবেন! কিন্তু ঐ একদিনই! পরদিন থেকে আমূলে বদলে যাবে সব চিত্র! আবার মেয়ে উঠে দুহাতে ঘর সামলাবে, স্বামী-বাচ্চার নাস্তা তৈরি করে অফিসে ছুটবে! অফিস থেকে ফিরে এসে স্বামীর জন্য কাঁচকি মাছ রান্না করতে দৌড়ে রান্নাঘরে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা ভিডিও খুব ভাইরাল হয়েছে ইউটিউবে। “আমি রান্না করলে শুনে লোকে অবাক হয়”- শীর্ষক ভিডিওটি। সেখানে তিনি বলেছেন, তাঁর পুত্রবধু এবং তাঁর ছেলে কাজ ভাগ করে নেন। পুরুষরা নাকি সহজেই উইক হয়ে পড়েন! ঘরের কাজ করলে পুরুষের সম্মানহানি ঘটে না, এই কথাই বার বার করে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
আমার সংসারে আমি ছোট থেকেই দেখেছি বাবা রান্না করেছে। বরং মাংস রান্নাটা বাবা বেশি ভালো করে মায়ের চাইতে। সম্প্রতি আম্মুর জরায়ুর অপারেশন হবার ফলে বেড রেস্ট নিচ্ছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। বাবা পুরো সংসারটা সামলাচ্ছে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে। আমার ভাই কানাডায় গিয়ে রীতিমত দুর্দান্ত রান্না করে ছবি ইনবক্স করে আমাকে। ভাইয়া এখন বাথরুম ধুতে পারে, কাপড় কাচতে পারে। ছোটবেলা থেকে বুয়া না এলেই মা আমাদের ভাইবোন দুজনকে দুটো ঝাঁটা দিয়ে বলতো ঝাড়ু দিতে। আমি আমার ঘর, মায়ের ঘর আর ডাইনিং টেবিল ঝাঁট দিতাম। ভাইয়া ভাইয়ার ঘর, ড্রয়িং রুম আর বারান্দা ঝাঁট দিত। একসাথে কাপড় দিয়ে টেবিল মুছে বই গুছাতাম। বরং ভাইয়া আমার চাইতে বেশি গুছানো ছিল। বিছানা, বইপত্র ঠিক গুছিয়ে রাখত। এইসব কথা যখন আমার মা আমাদের আন্টিদের বলতেন, সবাই চোখ কপালে তুলতো “ কী, ছেলে কাজ করে! বরকে দিয়ে রান্না করান!” এই যে এখন আম্মু বিশ্রামে আছে, বাবা রান্নাবান্না করছে, কেউ ঠিক ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখছে না! ধাড়ী মেয়ে অফিস করে বাপের হাতে রান্না করা গরম ভাত খাবে! এই সহজ সাধারণ কথাটা এরা মেনে নিতে পারেই না! ফোনের পর ফোন, মাকে জিজ্ঞাসা “ মেয়ে কিছু করে না কেন ভাবি?”
ছোটবেলা থেকে মেয়ের কাজ, ছেলের কাজ বলে কিছু জানা ছিল না আমাদের! তবুও বাইরের মানুষ যখন মা কে বলতো “মেয়েকে ছেলের মতন করে মানুষ করলে হয়?” তখন আমি বুঝতাম না, আসলে কে কবে নির্ধারণ করে দিয়ে গেছে, রান্নাবান্না কেবল মেয়ের কাজ! ওগুলো না করলে একটা মেয়ে ছেলে হয়ে যায়! আমার এক প্রেমিকের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে ওকে বলেছিলাম “তুমি রান্না পার?” সে অপারগতা জানিয়েছিল বলে আমি মজা করে বলছিলাম, “ তুমি রান্না শিখে একদিন গরু মাংস রেধে খাওয়াবা আমাকে”। পরে শুনি এই কথাতে সে ভীষণ ভীষণ অপমানিতবোধ করেছিল। আমাদের প্রেমট্রেম ভেঙ্গে যাবার পর সে বলেছিল, তার মা নাকি আমার কথা শুনে সবসময় খোটা দিত, “কার সঙ্গে চলছিস, এ তো তোকে খাটিয়ে মারবে”। আমি বরাবরের মত বেকুব হয়ে গিয়েছিলাম, কোনো ছেলেকে রান্না করার কথা বললে সে অপমানিতবোধ করে! এ আমার ধারণার বাইরে ছিল!
Share the load বিজ্ঞাপন দেখার পর ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো চিন্তাধারার পরিবর্তন হয় নি। কারণ আমার পরিবারে আমার বাবা কখনই মাকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকেননি। আমার মা ভাইয়া বা আমাকে কখনও ছেলেমেয়ে বলে কাজ ভাগ করে দেননি। তাই প্রেম করতে যাবার সময় ছেলেরা যখন লিস্ট ধরে দিত “এই এই করতে হবে বউ হতে চাইলে” তখন আমি ধাক্কা খেতাম। তাই আমি মানি, দেশে ৯৬ পারসেন্ট ছেলেই এখনও ঘরের কাজ করাকে মেয়েদের কাজ বলে মানে। সেসব কাজ করতে বলা বা করাকে অপমান বলে গণ্য করে। মাসে একদিন মজা করে রান্না করাতেই তাদের উদারতা দেখানো শেষ হয়। এখনও দেশের কয়টা ছেলে অফিস থেকে বাসায় ফিরে বউ’র সঙ্গে কাজ ভাগ করে নেয়, সেটার সংখ্যা হয়তো হাতেগুণেই বলে দেওয়া যায়!
আমার সবচেয়ে ছোটখালামনি প্রেম করে বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর দুই বাচ্চাকাচ্চা সামলে চাকরি করতে গিয়ে পদে পদে তিনি বাধা পেয়েছেন, পাচ্ছেনও। কিন্তু তার সমবয়সী স্বামী, যার কিনা বন্ধু হওয়া উচিত! সে নিজেকে বরাবরের মত “স্বামী” প্রমাণ করেই গিয়েছে।
আসলে পুরুষ যতক্ষণ স্বামী বা প্রেমিক, ততক্ষণ কখনই এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারে না। স্বামীর চাইতে অনেক আগে তাদের হতে হবে সহযোদ্ধা। আর এই সহযোদ্ধা হবার মনমানসিকতা পরিবার থেকেই করে দিতে হবে। আজ যদি সব বাবারা ‘সরি’ হয়ে সত্যিই মায়ের হাতে হাতে কাজ লাগায়, হলুদটা একটু বেটে দেয়, ডিমটা একটু ভাজি করে দেয়! তখনই Share the load বিজ্ঞাপনের সঠিক মেসেজ বুঝতে পারবে জাতি। তখনই ছেলেরা বাবাকে দেখে হয়ে উঠবে আদর্শ সহযোদ্ধা!
এক বাবা ‘সরি’ হয়েছে দেখে কি আরও আরও বাবারা সরি হতে পারে না? আরও আরও ছেলেরা এসে হাত ধরার আগে বলতে পারে না, “আমি প্রেমিক হতে চাই না! চাই সহযোদ্ধা হতে’? দেরিতে হলেও চোখ খুলুক, ভেঙ্গে যাক ঘুণে ধরা দেয়াল।
লেখক : ফাউন্ডার, ফেমিনিজম বাংলা
এইচআর/এমএস